ঘাটে-মাঠে, বাজারে-বাসে, রাস্তায়-আড্ডায় যেখানেই যান না কেন, সর্বত্রই এ প্রশ্ন শুনতে পাবেন-দেশে হচ্ছেটা কী? যারা এ প্রশ্ন করেন, তাদের কাছে কোনো উত্তর নেই। নেই এর সূত্র উৎস নিয়ে কোনো খবর বা গুজবের বার্তাও। তবু প্রশ্ন রয়ে গেছে। বলা যায় দেয়ালেরও কান আছে, বাতাসের গতি আছে। কোন দেয়ালের কোনো কথা হয়তো বাতাসের বেগে ইথারে ভর করে হু হু করে এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে ছড়িয়ে পড়ছে; আর সে কথা মানুষের কান স্পর্শ করে যাচ্ছে। বিষয় কী, তা কারও জানা নেই। এক অজানা মনোভঙ্গি কাজ করছে। যেন সবকিছুই স্বাভাবিক। সেই যে কবি জীবনানন্দের কবিতার পঙ্ক্তি ‘কি কথা তাহার সাথে’? আসলে কথা কী? এর কি কোনো জবাব কোথাও আছে? না বলা দুষ্কর। গত কয়েক বছরের হিসাবে ফারাক থাকলেও, মাসের হিসাবে পরপর শ্রীলঙ্কায়, বাংলাদেশে, নেপালে তরুণদের যে বিপ্লব হয়ে গেল তার সর্বশেষ উদাহরণ এখন পর্যন্ত নেপাল। নেপালে ঘটনার পরপরই সেখানকার সাবেক প্রধান বিচারপতিকে অনুরোধ করে ক্ষমতায় বসিয়েছে তরুণরা।
নেপালের বিপ্লব নিয়ে নানা কথা আছে। অনেকে মনে করেন সেখানে প্রো-চায়নিজ সরকার থাকায় এই বিপ্লবে ভারতের হাত রয়েছে। মূল বিষয় সেটি নয়। দেখা যাচ্ছে, নেপালের অন্তর্বর্তী সরকার ছয় মাসের মধ্যে নির্বাচন দেওয়ার কথা প্রথম দিকেই ঘোষণা দিয়েছে। বোধ করি সেভাবেই কাজ চলছে। শ্রীলঙ্কার কথাও অনেকটা অনুরূপ। সেখানে বিপ্লব-পরবর্তী এখন শান্ত বাস্তবতা বিরাজ করছে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। সবচেয়ে বড় কথা, যে দুর্নীতিকে কেন্দ্র করে সেখানে বিপ্লব হয়েছিল সেখানে এখন দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। দেশটি অগ্রগতির দিকে যাচ্ছে। সে বিবেচনায় বাংলাদেশে ফ্যাসিবাদবিরোধী অভ্যুত্থান হয়েছে তা বছর উতরে গেছে। আসলে এ থেকে জনগণের কতটা উপকার হয়েছে, সেটি খুব স্পষ্ট করে বলা যাচ্ছে না। অভ্যুত্থানের মূল শক্তিই বলছে অভ্যুত্থান ব্যর্থ হয়েছে। তবে এ কথা নিঃসন্দেহে বলা যায়, দেশ স্বৈরাচারমুক্ত হয়েছে। ফ্যাসিবাদের জাঁতাকলে যেভাবে জনগণ পিষ্ট হচ্ছিল, তার থেকে খানিকটা হলেও নিস্তার মিলেছে। জনস্বার্থ বিবেচনায় দেখার রয়েছে আরও অনেক কিছু।
খুব সোজাসাপ্টা করে বললে এই দাঁড়ায় যে একটি স্বচ্ছ, সবার গ্রহণযোগ্য জাতীয় নির্বাচনের দাবিতে গোটা জাতি গত সাড়ে পনেরো বছর লড়াই করেছে। মূল দবি ছিল ভোটাধিকার, মৌলিক অধিকার, কথা বলার অধিকার, লেখার অধিকার ফেরত পাওয়া। আর ছিল কাজের সুযোগ লাভের অধিকার, বৈষম্য নিরসনের আকাক্সক্ষা। সব মিলিয়ে একটি স্বাধীন দেশের মানুষ যখন নিজ দেশে প্রবাসী হয়ে উঠেছিল তাদের দাবি যখন পদদলিত হচ্ছিল, তখনই তারা রুখে দাঁড়ায়। এই দাঁড়াবার পদ্ধতিটা এবার আলাদা ছিল। সাধারণত দেখা যায়, রাজনীতিবিদরাই লড়াই করে বিজয় অর্জন করেন। এবার কেবল রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মী নন, বরং শিক্ষার্থীরাই নেমে পড়েছিল সরকারবিরোধী আন্দোলনে। এবং সফলতা মূলত সেখানেই আসে। বলার অপেক্ষা রাখে না, এই খেলা যারা খেলেছেন তারা পাকা খেলোয়াড়, ওস্তাদের ওস্তাদ। অতিসতর্কে ঘুঁটি চালিয়েছেন। এই অভিজ্ঞতার আলোকে যদি বাংলাদেশের বিপ্লব বিবেচনায় নেওয়া হয়, তাহলে এটা বোঝা দুষ্কর যে আমাদের পরিণতি কোথায়? কারণ আমরা এখন পর্যন্ত কার্যত একটি নির্বাচনের কাছে পৌঁছাতে পারিনি। সরকারের পক্ষ থেকে আগামী ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচনের কথা বলা হলেও তা যে হালে খুব একটা পানি পাবে-ভাবসাব দেখে তা মনে হচ্ছে না। কথা এ কারণে যে গত কয়েক দিনের কিছু ঘটনা ভাবিয়ে তোলার সূত্র হিসেবে কাজ করছে। জাতিসংঘ অধিবেশনে প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে যাওয়া সফরসঙ্গীদের ছ্যারাব্যারা অবস্থাটা কোনো বিবেচনাতেই কাম্য ছিল না। আগে থেকেই মিডিয়ায় এ নিয়ে যথেষ্ট সতর্ক করা হয়েছিল। সেখানে যে একটা প্রতিরোধ পরিস্থিতি হতে পারে, সেটি কার্যত অজানা ছিল না। তা সত্ত্বেও যা ঘটেছে, তাতে সরকারের অবস্থান খুব শক্তপোক্ত মনে হওয়ার কোনো কারণ নেই। এরপর বলা হলো, সেখানে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনায় নির্বাচন নিয়ে আশঙ্কার অবসান হয়েছে। এটা বলা কষ্টকর, আসলে কী হয়েছে? সফরের বিশেষ মিশন কতটা সফল হয়েছে? সে কথা থাক। এই সফরের আগে বাংলাদেশে যে আলোচিত ঘটনাটি ঘটেছে, তা হলো একজন মার্কিন নাগরিকের গ্রেপ্তার। গ্রেপ্তার হওয়া ব্যক্তি কে? তার আসল পরিচয় কী? সেটি অবশ্যই তদন্তের ব্যাপার। এগুলো খুব জটিল অঙ্কের বিষয়। যারা ডিল করেন তারা ভালো বলতে পারবেন। তবে জনগণের জানা দরকার, ঐতিহ্যবাহী বাংলা একাডেমির বইমেলা স্থগিত করা হয়েছে। বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, অমর একুশে বইমেলা আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচন-পরবর্তী সময়ে অনুষ্ঠিত হবে। ডাকসু নির্বাচন নিয়ে এখনো চলছে তোলপাড়। নীলক্ষেতে ব্যালট পেপার ছাপার বিষয়টি ভিসিকে না জানিয়ে করা হয়েছে বলে তিনি নিজেই জানিয়েছেন। মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের হিসাব অনুযায়ী, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে ৩৩০টি, যার মধ্যে দলবদ্ধ ধর্ষণ ৬৬টি। ২২টি ছিল ধর্ষণের পর হত্যা। এ সময়ে গণপিটুনিতে নিহত হয়েছেন ৮৯ জন, যার মধ্যে ঢাকাতেই হত্যার শিকার হয়েছেন ৪৫ জন। এ সময়ে রাজনৈতিক সহিংসতায় মারা গেছেন ৪৪ জন। রাজনৈতিক সহিংসতায় এ পর্যন্ত বিএনপির ১ হাজার ৪৭৭ জন নিহত হয়েছেন। দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন খোদ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানসহ অনেকেই। বাড়তি পণ্যমূল্যে জনগণের নাজেহাল অবস্থা। ঘুষ-দুর্নীতির কোনো সুরাহা করা যায়নি। কীভাবে করা যাবে তার কোনো ফর্মুলাও সংশ্লিষ্টদের জানা আছে বলে মনে হয় না। এই বাস্তবতায় প্রকাশিত খবরে বলা হয়েছে, চলতি মাস খুবই বিপজ্জনক। পুলিশের উদ্ধৃতি দিয়ে প্রকাশিত রিপোর্টে বলা হয়েছে, যদি নির্বাচনমুখী প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সত্যিকার অর্থে ঐক্য না হয়, তাহলে ফ্যাসিস্টদের ষড়যন্ত্র আরও ঘনীভূত হবে। বলা হচ্ছে, জুলাই বিপ্লবের পক্ষে থাকা কয়েকটি দল ইতোমধ্যে আন্দোলন কর্মসূচি দিয়ে মাঠে নেমেছে। এটা মোটেই ভালো লক্ষণ নয়।
মার্কিন নাগরিককে কে আনল, কে ধরল, এটা জনগণের জানা দরকার। ডাকসু নির্বাচনে কে কীভাবে ভিসিকে না জানিয়ে নীলক্ষেতে ব্যালট ছাপল সেটি জানার অধিকার জনগণের রয়েছে। জননিরাপত্তা কেন নিশ্চিত করা যাচ্ছে না, সে উদ্বেগ নিরসন জরুরি। বিনিয়োগ স্থবিরতায় নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি হচ্ছে না। কেন বিনিয়োগ ত্বরান্বিত করা যাচ্ছে না, সেটি জানার অধিকার জনগণের রয়েছে। চাল ডাল তেলের দাম কেন মধ্যবিত্তের নাগালে নেই, সে ব্যাপারে পরিষ্কার ধারণা জনগণকে দেওয়া আবশ্যকীয়। এসব অতীব জরুরি প্রশ্নের কোনো সদুত্তর কারও কাছে না থাকার কারণেই নানা কথা হচ্ছে। কার গোয়ালে কে ধোঁয়া দেয়, সেটি সবার জানা নেই। গণ-ঔৎসুক্য নিরসনে কার্যকর না হলে, জন-আকাক্সক্ষার প্রত্যাশিত নির্বাচন করা কতটা সম্ভব হবে-সে প্রশ্ন থেকেই যাবে।
লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক, কলামিস্ট