আদর্শ মানুষ গড়ার কারিগর শিক্ষকরা ভালো নেই। নিম্ন বেতন, অভাব-অনটন আর পদমর্যাদায় পিছিয়ে আছেন তাঁরা। অন্য পেশায় নিয়মতান্ত্রিক পদোন্নতি থাকলেও শিক্ষকতা পেশায় হয় না সময়মতো পদোন্নতিও। এসব কারণে পেশাও পরিবর্তন করছেন অনেক শিক্ষক। এমন পরিস্থিতির মধ্যেই আজ (৫ অক্টোবর) পালিত হচ্ছে বিশ্ব শিক্ষক দিবস। অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও দিবসটি উপলক্ষে নানান কর্মসূচি হাতে নিয়েছে সরকার। রাজধানীর ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে দিবসটি উপলক্ষে আজ এক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। এতে প্রধান অতিথি থাকবেন শিক্ষা উপদেষ্টা অধ্যাপক সি আর আবরার। বিশেষ অতিথির বক্তব্য দেবেন প্রাথমিক ও গণশিক্ষা উপদেষ্টা বিধান রঞ্জন রায় পোদ্দার। এবারের শিক্ষক দিবসটির প্রতিপাদ্য ‘শিক্ষকতা পেশা : মিলিত প্রচেষ্টার দীপ্তি’।
ছাত্রছাত্রীদের পড়াশোনার ভিত গঠন করে দেন প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা। অথচ দেশের সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষকরা এখনো বিবেচিত হচ্ছেন কর্মচারী হিসেবে। তাঁরা বেতন পান ১৩তম গ্রেডে। দীর্ঘদিন থেকে এ শিক্ষকরা ১১তম গ্রেডে বেতনের দাবিতে আন্দোলন করে যাচ্ছেন। সহকারী শিক্ষকরা যোগদানের পর অবসরে যাচ্ছেন কোনোরকম পদোন্নতি না পেয়েই। ২০০৯ সাল থেকে তাঁদের পদোন্নতি বন্ধ রয়েছে। প্রাথমিক বিদ্যালয় সহকারী শিক্ষক সমিতির সভাপতি মোহাম্মদ শামছুদ্দীন মাসুদ গতকাল বলেন, ‘সবাই মুখে মুখে শিক্ষকতাকে সম্মানজনক পেশার মর্যাদা দিলেও বাস্তবে তাঁদের অবহেলায় রাখা হয়েছে। দীর্ঘদিন থেকে প্রধান শিক্ষকরা দশম ও সহকারী শিক্ষকরা ১১তম গ্রেডের জন্য আন্দোলন করে আসছেন। আদালতের রায়ে প্রধান শিক্ষকদের দশম গ্রেড বাস্তবায়ন হলেও সহকারী শিক্ষকরা ১৩তম গ্রেডেই পড়ে আছেন। এ ব্যাপারে সরকারও নিশ্চুপ। শিক্ষক দিবসে আমাদের প্রত্যাশা-সরকার শিক্ষকদের বেতনবৈষম্য নিরসন করবে।’
দেশের মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক স্তরে প্রায় ৩ লাখ বেসরকারি শিক্ষক রয়েছেন। তাঁরা অত্যন্ত অমানবিক জীবনযাপন করছেন। মাধ্যমিক স্তরে একজন বেসরকারি এমপিওভুক্ত শিক্ষকের বেতন স্কেল ১২ হাজার ৫০০ টাকা। আর মাদরাসায় সংযুক্ত ইবতেদায়ি শিক্ষকরা বেতন পান মাত্র ৯ হাজার ৩০০ টাকা। এঁরা ৫০০ টাকা চিকিৎসা ভাতা আর ১ হাজার টাকা বাসা ভাড়া পান, যা দিয়ে বর্তমান সময়ে ব্যয় নির্বাহ একেবারেই অসম্ভব। এমপিওভুক্ত শিক্ষা জাতীয়করণপ্রত্যাশী জোটের সদস্যসচিব অধ্যক্ষ দেলাওয়ার হোসেন আজিজী বলেন, ‘শিক্ষা সেক্টরে সরকারি-বেসরকারি বৈষম্য নিরসনে সব বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান জাতীয়করণের দাবি আমাদের। আমাদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে বেসরকারি শিক্ষকদের ২০ শতাংশ বাড়ি ভাড়া করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে সরকার। ১০ অক্টোবরের মধ্যে এ দাবি মেনে নেওয়া না হলে ১২ তারিখ থেকে আন্দোলনে নামব আমরা।’
এদিকে সরকারি মাধ্যমিকে বর্তমানে শূন্যপদের সংখ্যা পর্যাপ্ত থাকলেও এখানে কর্মরত শিক্ষকদের দীর্ঘদিন ধরে পদোন্নতি দেওয়া হচ্ছে না। ৭ শতাধিক সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষক রয়েছেন মাত্র দেড় শতাধিক। বাকিগুলো ভারপ্রাপ্ত দিয়েই চলছে দীর্ঘদিন ধরে। সিনিয়র শিক্ষক পদ থেকে সহকারী প্রধান শিক্ষক এবং সহকারী জেলা শিক্ষা অফিসারের পদে পদোন্নতিযোগ্য শিক্ষক কর্মরত থাকলেও নিয়োগবিধি সংশোধন না হওয়ার অজুহাতে দীর্ঘদিন ধরে শিক্ষকদের পদোন্নতি বন্ধ রয়েছে। প্রায় দেড় হাজার সহকারী শিক্ষক দীর্ঘদিন ধরে সিনিয়র শিক্ষক পদে পদোন্নতির যোগ্য থাকলেও তাঁদের পদোন্নতি দেওয়া হচ্ছে না বলে শিক্ষকরা জানিয়েছেন। সরকারি করোনেশন বালিকা মাধ্যমিক বিদ্যালয় খুলনার সহকারী শিক্ষক ও সরকারি মাধ্যমিক শিক্ষক সমিতির কেন্দ্রীয় সমন্বয়ক মো. ওমর ফারুক বলেন, ‘মাধ্যমিক শিক্ষার গুণগত মান উন্নয়নে দীর্ঘদিন ধরে মাধ্যমিকের জন্য একটি স্বতন্ত্র অধিদপ্তর প্রতিষ্ঠার দাবি করছি আমরা। স্বতন্ত্র মাধ্যমিক শিক্ষা অধিদপ্তর প্রতিষ্ঠা, সরকারি মাধ্যমিকের সহকারী শিক্ষকের প্রবেশপদ নবম গ্রেডে উন্নীতকরণসহ পাঁচ দফা দাবি রয়েছে আমাদের।’
প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার মাধ্যমে বিসিএস উত্তীর্ণ হওয়ার পর শিক্ষা ক্যাডারে যোগদান করা সরকারি কলেজের শিক্ষকরাও রয়েছেন নাজুক পরিস্থিতিতে। একই সঙ্গে অন্য ক্যাডারে যোগদান করা কর্মকর্তাদের সঙ্গে এ শিক্ষকদের বেতন-মর্যাদার ফারাক অনেক। শিক্ষা ক্যাডারের সঙ্গে অন্য ক্যাডারের আকাশপাতাল বৈষম্য সৃষ্টি করা হয়েছে। পদোন্নতিতেও পিছিয়ে শিক্ষা ক্যাডার কর্মকর্তারা। অন্য ক্যাডারে অতিরিক্ত পদোন্নতি দিয়ে মাথা ভারী করা হলেও শিক্ষা ক্যাডারে পদোন্নতি যেন সোনার হরিণ। প্রাপ্যতা হওয়ার বছরের পর বছর অতিক্রান্ত হলেও অনেক ক্ষেত্রেই পদোন্নতি পান না শিক্ষকরা। ফলে শিক্ষা ক্যাডার হওয়ার পর অনেকে অন্য ক্যাডারে চলে যাচ্ছেন। বিসিএস সাধারণ শিক্ষা সমিতির সাবেক মহাসচিব মো. শওকত হোসেন মোল্যা বলেন, ‘অদক্ষ, অশিক্ষক, অপেশাদার দ্বারা শিক্ষাব্যবস্থা পরিচালিত হওয়ায় মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিতকরণের চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে বাংলাদেশ।’
শিক্ষাসংশ্লিষ্টরা বলছেন, একটি দেশের জিডিপির ৬ শতাংশ শিক্ষা খাতে বরাদ্দ করা উচিত। কিন্তু অদ্যাবধি দেশের কোনো বাজেটেই ২ শতাংশের বেশি শিক্ষা খাতে বরাদ্দ করা হয়নি। ফলে শিক্ষকরাও প্রাপ্য সম্মান বা বেতনভাতা কোনোটিই পাচ্ছেন না।