নদীমাতৃক বাংলাদেশে মাছ মানুষের খাদ্যতালিকার অন্যতম প্রধান উপাদান। মাছ যেমন আমাদের প্রোটিনের চাহিদা পূরণ করে, তেমনি গ্রামীণ অর্থনীতি ও জীবিকার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। কিন্তু দীর্ঘদিনের প্রচলিত মাছ চাষ পদ্ধতিতে উৎপাদনের সীমাবদ্ধতা দেখা দিয়েছে। জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে মাছের চাহিদা বাড়ছে, সম্ভাবনা রয়েছে বৈশ্বিক বাজারেও। এই বাস্তবতায় আধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর মাছ চাষের দিকে এগিয়ে যাওয়া সময়ের দাবি। এর মধ্যে অন্যতম সম্ভাবনাময় একটি পদ্ধতি হলো ইন-পন্ড রেসওয়ে সিস্টেম (আইপিআরএস)। প্রচলিত পুকুর বা জলাশয়ে মাছ পুরো জায়গাজুড়ে ছড়িয়ে থাকে। কিন্তু আইপিআরএসে পুকুরের ভিতর কংক্রিট বা শক্ত প্লাস্টিক দিয়ে আলাদা ঘের বা চ্যানেল তৈরি করা হয়। মাছ রাখা হয় মূলত এই রেসওয়ের ভিতরে। এখানে পানির সঞ্চালন সব সময় চালু থাকে, যেটি শক্তিশালী এয়ার ব্লোয়ার বা মেশিনের মাধ্যমে তৈরি হয়। এর ফলে পানিতে অক্সিজেন পর্যাপ্ত থাকে এবং মাছের দ্রুত বৃদ্ধি নিশ্চিত হয়। এ পদ্ধতিতে মাছকে নির্দিষ্ট জায়গায় খাবার দেওয়া হয়, ফলে খাবারের অপচয় হয় না। মাছের বর্জ্য বা মলমূত্র বিশেষ একটি অংশে জমা হয়, যেখান থেকে সহজেই তা পরিষ্কার করা যায়। এর ফলে পানি দূষিত হয় না। পুকুরের বাকি অংশটি প্রাকৃতিকভাবে মাছ চাষের জন্য ব্যবহার করা যায়। অর্থাৎ পুরো জায়গাটির সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত হয়।
সবচেয়ে আকর্ষণীয় দিক হলো, পানিতে স্রোত তৈরি হওয়ায় মাছগুলো অনেকটা নদীর মাছের মতো সক্রিয়ভাবে বেড়ে ওঠে। তাই এর স্বাদও নদীর মাছের কাছাকাছি হয়, যা বাজারে বিশেষভাবে জনপ্রিয়। বছর দুয়েক আগে চীনের সুজু শহরে সাংহাই ওশান ইউনিভার্সিটির উদ্যোগে একটি আধুনিক আইপিআরএস প্রকল্প দেখার সুযোগ হয়েছিল। সেখানে আন্তর্জাতিক গবেষণা সংস্থা ও ব্যবসায়ীদের সহযোগিতায় নতুন সব উদ্ভাবন যুক্ত করা হয়েছে। আমার সঙ্গে ছিলেন চীনের উদ্যোক্তা টাইগার এবং বাংলাদেশের আইপিআরএস বিষয়ে দক্ষ উদ্যোক্তা ফেরদৌস মুরাদ। বাংলাদেশে যতগুলো আইপিআরএস স্থাপিত হয়েছে সবগুলোর সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন মুরাদ। সাংহাই ওশান ইউনিভার্সিটির আইপিআরএস বিশাল এক কার্যক্রম। উদ্যোক্তা টাইগার এই প্রকল্পের বিশেষত্ব তুলে ধরে জানান, তারা মাছের বর্জ্য নিষ্কাশনের জায়গা দ্বিগুণ করেছেন, যাতে দ্রুত বর্জ্য সরিয়ে পানির মান বজায় রাখা যায়। চ্যানেলের বাইরের অংশে ওয়াটার গ্রাস বা জলজ উদ্ভিদ চাষ করা হয়েছে, যা পানিকে প্রাকৃতিকভাবে শুদ্ধ রাখে। এ ছাড়া পানিতে কিছু ‘ক্লিনার ফিশ’ রাখা হয়েছে, যারা অন্যান্য মাছকে বিরক্ত না করেও পুকুরের ভিতরের অবাঞ্ছিত বর্জ্য খেয়ে পরিবেশ পরিচ্ছন্ন রাখে। এর পাশাপাশি ব্যবহার করা হয়েছে কিছু অ্যান্টি-ব্যাকটেরিয়াল উপাদান, যা পানির ভিতরে রোগজীবাণুর বিস্তার রোধ করে। প্রকল্পটিতে মাছের খাবার দেওয়ার ব্যবস্থা পর্যন্ত অটোমেটিক করা হয়েছে। আধুনিক এই প্রযুক্তিগুলোর সমন্বয়ে কম খরচে, কম জায়গায় এবং কম সময়ে গুণগতমানসম্পন্ন মাছ উৎপাদন সম্ভব হচ্ছে।
ফেরদৌস মুরাদ জানালেন, বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত প্রায় ১০টি আইপিআরএস প্রকল্প চালু হয়েছে, যেখানে ৬৪টি চ্যানেলে অধিক ঘনত্বে মাছ চাষ করা হচ্ছে। প্রচলিত পুকুরে হেক্টরপ্রতি বছরে ৫ থেকে ৮ টন মাছ পাওয়া গেলেও আইপিআরএস ব্যবস্থায় ৪০ থেকে ৮০ টন পর্যন্ত উৎপাদন সম্ভব। এটি বাংলাদেশের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করা এবং আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিযোগিতা করার জন্য অত্যন্ত কার্যকর হতে পারে। প্রজাতির দিক থেকে তেলাপিয়া, পাঙাশ, রুই, কাতল ও দেশীয় ক্যাটফিশ আইপিআরএসে খুব ভালো ফলন দিচ্ছে। ফলে স্থানীয় বাজারের চাহিদা মেটানোর পাশাপাশি রপ্তানিরও সুযোগ তৈরি হচ্ছে। তবে সবকিছু এত সহজ নয়। আইপিআরএস চালু করতে প্রাথমিক বিনিয়োগ অনেক বেশি। রেসওয়ে তৈরি, এয়ারেশন সিস্টেম বসানো, বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিত করা, এসবের জন্য বড় অঙ্কের অর্থ প্রয়োজন। ছোট ও প্রান্তিক কৃষকের পক্ষে এককভাবে এই বিনিয়োগ সম্ভব নয়।
আরেকটি বড় চ্যালেঞ্জ হলো বিদ্যুতের ওপর নির্ভরতা। এয়ারেশন ও পানির প্রবাহ অব্যাহত রাখতে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ দরকার। গ্রিড বিদ্যুৎ না থাকলে সোলার বা ডিজেল ব্যবহার করতে হয়, যা খরচ বাড়ায়।
এ ছাড়া এই প্রযুক্তি ব্যবহারে দক্ষ জনশক্তির প্রয়োজন। পানির মান নিয়ন্ত্রণ, সঠিকভাবে খাবার প্রয়োগ, অক্সিজেনের মাত্রা পর্যবেক্ষণ এসব বিষয়ে প্রশিক্ষণ ছাড়া সফল হওয়া কঠিন। ব্যবস্থাপনায় সামান্য ভুলও বড় ধরনের ক্ষতির কারণ হতে পারে। মাছ চাষের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ হলো মানসম্মত পোনা। সুজুতে যে প্রকল্পটি দেখে এসেছি, সেখানে তারা মাছের পোনা উৎপাদনের জন্য রিসার্কুলেন্টিং অ্যাকুয়াকালচার সিস্টেম আরএএস ব্যবহার করছে। এ পদ্ধতিতে মানসম্মত পোনা উৎপাদনের জন্য ৪৮টি বড় ড্রাম বসানো হয়েছে। উদ্যোক্তা টাইগার বলেন, ‘ভালো মানের পোনা ছাড়া ভালো মাছ উৎপাদন সম্ভব নয়। ভালো মানের পোনা দ্রুত বৃদ্ধি পায়, মৃত্যুহার কম থাকে, খাবার ভালোভাবে গ্রহণ করে এবং সমানভাবে বড় হয়। বাজারজাতের সময় একরকম আকারের মাছ পাওয়া যায় বলে দামও ভালো পাওয়া যায়। অন্যদিকে রোগমুক্ত পোনা ব্যবহার করলে পুকুরে রোগ ছড়ায় না, ফলে পরিবেশ সুরক্ষিত থাকে এবং খরচও কমে।’
দেশে আইপিআরএস নিয়ে সম্ভাবনা অনেক। প্রথমত এটি কম জায়গায় বেশি উৎপাদন নিশ্চিত করতে পারে, যা জমি ও পানির ঘনত্বপূর্ণ ব্যবহারের একটি উদাহরণ। দ্বিতীয়ত এর মাধ্যমে উৎপাদন খরচ তুলনামূলক কমানো সম্ভব, কারণ খাবারের অপচয় হয় না এবং পানিদূষণও নিয়ন্ত্রণে থাকে। তৃতীয়ত আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারে মাছ দ্রুত বাড়ে, রোগবালাই কম হয় এবং আন্তর্জাতিক বাজারে রপ্তানির জন্য গুণগত মানসম্পন্ন মাছ পাওয়া যায়। তবে এই সম্ভাবনা বাস্তবে রূপ দিতে হলে কিছু করণীয় রয়েছে। সরকার ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। বেসরকারি উদ্যোক্তাদের সঙ্গে সমবায়ভিত্তিক মডেল গড়ে তুলতে হবে। নবায়নযোগ্য জ্বালানির ব্যবহার নিশ্চিত করলে বিদ্যুতের খরচ অনেক কমে যাবে। চাষিদের প্রশিক্ষণ ও কারিগরি সহায়তা দিতে হবে। সবচেয়ে বড় কথা, মানসম্মত পোনা উৎপাদন ও সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে।
সম্প্রতি কক্সবাজারে মৎস্য ও চিংড়ি খাতের প্রযুক্তিগত উন্নয়ন ও সহযোগিতা বাড়াতে সেন্টার অব এক্সেলেন্স উদ্বোধন করা হয়েছে। বাংলাদেশ ও নেদারল্যান্ডসের যৌথ উদ্যোগে ফুডটেক বাংলাদেশ কর্মসূচির আওতায় প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে সেন্টার অব এক্সেলেন্স। উদ্যোক্তারা জানান, এর মাধ্যমে মৎস্য ও চিংড়ি খাতে আধুনিক প্রযুক্তি ইন পন্ড রেসওয়ে সিস্টেম ব্যবহার করে উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি, বাজার সম্প্রসারণ এবং টেকসই খামারব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করা এর লক্ষ্য।
দেশের মাছ চাষকে আধুনিক প্রযুক্তির ছোঁয়ায় নিয়ে যেতে হলে আইপিআরএসের মতো উদ্যোগ অপরিহার্য। পুরোনো পদ্ধতিতে উৎপাদন সীমিত, অথচ মানুষের চাহিদা প্রতিদিন বাড়ছে। প্রযুক্তিনির্ভর মাছ চাষ করলে কম জায়গায় বেশি উৎপাদন সম্ভব, খরচও নিয়ন্ত্রণে থাকে, খাবার অপচয় হয় না এবং পানিদূষণ কমে। সবচেয়ে বড় বিষয় হলো, বৈশ্বিক প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে হলে আমাদের এখনই আধুনিক প্রযুক্তি গ্রহণ করতে হবে। আইপিআরএস সেই আধুনিক প্রযুক্তিগুলোর অন্যতম। এটি শুধু বাংলাদেশের খাদ্যনিরাপত্তার জন্যই নয়, বরং আন্তর্জাতিক বাজারে মাছ রপ্তানির ক্ষেত্রেও নতুন দিগন্ত খুলে দিতে পারে।
লেখক : মিডিয়াব্যক্তিত্ব