গত বছরের আগস্ট মাসে দায়িত্ব গ্রহণের পর অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষে এক বছরের মধ্যে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠান এবং নির্বাচিত প্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের কাজটি কী দুরূহ ছিল? এ কথা সত্য, জুলাই অভ্যুত্থান অন্তর্বর্তী সরকারের ওপর নির্দিষ্ট কিছু দায়িত্ব অর্পণ করেছে- নির্বাচনের আগে প্রয়োজনীয় সংস্কার এবং গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধে জড়িত পলাতক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার সহযোগীদের বিচার। যে কোনো অনির্বাচিত সরকারের ওপর এ ধরনের দায়িত্ব পালনে জটিলতা থাকা সত্ত্বেও জাতীয় প্রয়োজনে নিঃসন্দেহে এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব। কিন্তু ক্ষমতা গ্রহণের পর এক বছর দুই মাস কাটিয়ে দিলেও এখন পর্যন্ত তারা সংস্কারকাজ সম্পন্ন করতে পারেনি। এ সময়ের মধ্যে পুনর্গঠিত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে (আইসিটি) সরকার পক্ষ গত জুন মাস পর্যন্ত জুলাই চব্বিশের অভ্যুত্থানে মানবতাবিরোধী অপরাধে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে দায়ের করা পাঁচটি মামলায় অভিযোগের সমর্থনে আনুষ্ঠানিকভাবে সাড়ে আট হাজার পৃষ্ঠার চার্জশিট দাখিল করা ছাড়া আর কিছু করতে পারেনি। বিচার সম্পন্ন হতে কত দিন লাগবে তা নির্ভর করে ট্রাইব্যুনালের ওপর।
কিন্তু নির্বাচন অনুষ্ঠানে বিলম্ব ইতোমধ্যে নানা প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। বিশেষ করে অন্তর্বর্তী সরকারের সাংবিধানিক বৈধতার প্রশ্ন। এ সরকার দায়িত্ব গ্রহণ করেই যেহেতু সংবিধান বাতিল করেনি এবং সংবিধানে অন্তর্বর্তী সরকারের বিধান নেই, সেজন্য সরকারকে যতই জুলাই বিপ্লবের ফলাফল হিসেবে ক্ষমতা গ্রহণকারীদের জনগণের সরকার বলা হোক না কেন, বিপ্লবকে আইনগত ভিত্তির ওপর দাঁড় করাতে এবং ২০২৪ সালের ৮ আগস্ট থেকে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ অধিবেশন শুরু হওয়ার পূর্ববর্তী সময় পর্যন্ত অন্তর্বর্তী সরকারের কর্মকাণ্ডের বৈধতা দেওয়ার জন্যই অন্তর্বর্তী সরকারের উচিত ছিল যত দ্রুত সম্ভব নির্বাচন অনুষ্ঠান করা। বাংলাদেশে নির্দলীয় কেয়ারটেকার সরকারের অধীনে চারটি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। সংবিধান নির্বাচন অনুষ্ঠানে কেয়ারটেকার সরকারগুলোকে বেঁধে দিয়েছিল মাত্র তিন মাস সময়। মাত্র নব্বই দিনে নির্বাচন অনুষ্ঠানে কোনো সমস্যা হয়নি। সে ক্ষেত্রে বিপ্লব-উত্তর অন্তর্বর্তী সরকারের চৌদ্দ মাস কাক্সিক্ষত সংস্কার, বিচার ও নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য পর্যাপ্ত সময় ছিল। জুলাই বিপ্লব ছিল স্বৈরাচারী শাসকের বিরুদ্ধে দেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর ব্যাপক ক্ষোভের অনিবার্য পরিবর্তনের আকাক্সক্ষার ফলশ্রুতি। যে কোনো দেশে বিপ্লব-উত্তর সরকারের কাছে যা আশা করা হয়, তাহলো, সাবেক সরকারের অন্যায়ের সব শিকড় উপড়ে ফেলা এবং প্রাতিষ্ঠানিক শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা। সে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যেই তড়িঘড়ি নির্বাচন অনুষ্ঠান জরুরি ছিল, যা করতে সরকার ব্যর্থ হয়েছে।
কেবল তা-ই নয়, নির্বাচন অনুষ্ঠানে বিলম্বের সুযোগ নিয়ে ছোটবড় সব রাজনৈতিক দল, এমনকি যারা বিপ্লবের সঙ্গে কোনোভাবেই সংশ্লিষ্ট ছিল না, তারাও বিপ্লবে তাদের কৃতিত্ব দাবি করে জাতিকে তাদের নিজ নিজ তত্ত্বের ভিত্তিতে জ্ঞান দান করতে শুরু করেছে, যা এখনো বন্ধ হয়নি। জাতীয় ঐকমত্য কমিশন চলতি বছরের মার্চ থেকে মে মাস পর্যন্ত সময়ে ৩৫টি রাজনৈতিক দল ও জোটের সঙ্গে ১৬৬টি প্রস্তাব নিয়ে ৪৫ দফা অধিবেশনে বসেছে এবং ৬২টি প্রস্তাবে অধিকাংশ দল ঐকমত্য প্রকাশ করেছে। বোঝাই যায়, প্রক্রিয়াটি দীর্ঘ, জটিল ও সময়ক্ষেপণকারী এবং কোনোভাবেই বৈপ্লবিক চেতনা ও গতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ ছিল না। বিপ্লব মানেই দ্রুত পরিবর্তন, যে গতিতে বিপ্লব চূড়ান্ত লক্ষ্যে পৌঁছেছে, সেই গতিতেই পরিবর্তন ঘটিয়ে বিপ্লবের আকাক্সক্ষার চূড়ান্ত রূপ দেওয়া হলে অন্তর্বর্তী সরকারকে এত প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হতো না। বিপ্লবের সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে সংশ্লিষ্ট বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা নতুন রাজনৈতিক সংগঠন জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) গঠন করেছে। শেখ হাসিনার পলায়নের দিন গত বছরের ৫ আগস্ট তারা যদি নিজেদের উদ্যোগেই সরকার গঠন করতে চাইত, তাহলে সহজেই তারা তা পারত। তাহলে পরিস্থিতি সম্পূর্ণ ভিন্ন হতো। কিন্তু বিপ্লবীরা রাজনৈতিক দায়িত্ব গ্রহণের পথে অগ্রসর না হয়ে তাদের সদিচ্ছা ও বিচক্ষণতার প্রমাণ দিয়েছে। তারা দেশে ও বিদেশে সবার গ্রহণযোগ্য ব্যক্তিত্ব নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের ওপর অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের দায়িত্ব ন্যস্ত করে নির্ভার থাকতে চেয়েছে।
কিন্তু অবিলম্বে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত না হওয়ায় যত দিন যাচ্ছে, তাদের বিপদের ঝুঁকি বাড়ছে। পতিত আওয়ামী লীগও তার অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠন এবং ২০০৯ থেকে পরবর্তী দেড় দশক ধরে আওয়ামী শাসনের সুবিধাভোগীদের আক্রোশের মুখ্য টার্গেট শেখ হাসিনা ও তার সরকারকে উৎখাতকারী বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক ও অন্যান্য নেতৃস্থানীয়রা। তাদের ওপর ক্ষোভের ঝাল ঝেড়েছে নিউইয়র্ক ও লন্ডনে তথ্য ও সম্প্রচারবিষয়ক উপদেষ্টা মাহফুজ আলমের ওপর হামলার চেষ্টা করে এবং জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে যোগদান করতে নিউইয়র্কে আগত বাংলাদেশ প্রতিনিধিদলের দুই সদস্য এনসিপির সদস্যসচিব আখতার হোসেন ও যুগ্ম সচিব ডা. তাসনীম জারার ওপর হামলা চালিয়ে। জুলাই বিপ্লবের স্বীকৃতি ও বিপ্লবকে গণভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠা করার উদ্দেশে পরবর্তী জাতীয় সংসদ অধিবেশনে বসলে বিপ্লবসহ অন্তর্বর্তী সরকারের সব কাজের বৈধতা দিতে হবে। সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী শিশির মনির সম্প্রতি এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, জুলাই বিপ্লবকে আইনি ভিত্তি না দেওয়া কারও জন্য নিরাপদ নয়।
সংস্কার ও বিচারের নামে সময়ক্ষেপণ একদিকে জনমনে অন্তর্বর্তী সরকারের অভিপ্রায় নিয়ে প্রশ্ন তোলার সুযোগ করে দিচ্ছে, অপরদিকে ভারতের রাজধানী দিল্লিতে অবস্থানরত সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ঔদ্ধত্যপূর্ণ ও উসকানিমূলক কথাবার্তায় দেশবিরোধী অপশক্তি ‘শেখ হাসিনা এখনো বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী’, ‘ড. ইউনূসের সরকার অবৈধ ও অসাংবিধানিক’ ইত্যাদি বলে দেশে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির চেষ্টা চালাচ্ছে। দেশবাসী অবগত যে ‘নিজের নাক কেটে পরের যাত্রা ভঙ্গে’ আওয়ামী লীগের জুড়ি নেই। তারা পঁচাত্তর থেকে শিক্ষা নেয়নি, চব্বিশের জুলাই-আগস্টে নজিরবিহীন হত্যা ও তাণ্ডবের পরিণতিতে ক্ষমতা থেকে উৎখাত ও সদলবলে পলায়নের পরও কৃতকর্মের জন্য তাদের মাঝে অনুশোচনার লেশমাত্র নেই। কোনো ধরনের আত্মসমালোচনা নেই। অতএব তাদের ব্যাপারে সামান্য ছাড় দেওয়া হলে তারা প্রথম সুযোগেই যাকে পাবে তার ওপর মরণকামড় বসাতে কোনো দ্বিধা করবে না। আবারও দেশজুড়ে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করতে দ্বিতীয়বার চিন্তা করবে না। কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতাংশ তাদের বেলায় প্রযোজ্য : ‘নাগিনীরা চারি দিকে ফেলিতেছে বিষাক্ত নিঃশ্বাস/শান্তির ললিত বাণী শোনাইবে ব্যর্থ পরিহাস-।’
শুধু নির্বাচন নয়, যে কোনো কাজে বিলম্ব মানেই সমমনাদের মধ্যে বিভ্রান্তি এবং যে কোনো দুর্বলতার অর্থ বাংলাদেশের জন্য চির-অভিশাপতুল্য রাজনৈতিক অপশক্তি আওয়ামী লীগের জন্য মাথা চাড়া দিয়ে ওঠার সুযোগ সৃষ্টি করে দেওয়া। বিএনপির ভূমিকাতেই তা স্পষ্ট। দেশে যখন ঐক্য জরুরি তখন বিএনপি নেতারা তাদের সমমনাদের ব্যাপারে আক্রমণাত্মক কথাবার্তা বলছে বিপ্লব সফল হওয়ার পর থেকেই। এনসিপি গঠন নিয়ে তাদের ঘোর আপত্তি। তারা আশা করেছিলেন, এনসিপি তাদের সঙ্গে থাকবে। কিন্তু বিএনপির সে ইচ্ছা পূরণ না হওয়ায় তাদের নেতারা বিভিন্ন সময়ে এনসিপির নেতাদের আক্রমণ করে কথা বলেছেন, যা এখনো থেমে নেই। এনসিপির যুগ্ম আহ্বায়ক মনিরা শারমিন এক টেলিভিশন টক শোতে দুঃখ করে বলেছেন, ‘আমাদের নিয়ে বিএনপির অনেক বর্ষীয়ান নেতা যেভাবে আক্রমণাত্মক বক্তব্য দেন, তাতে আমরা খুব আহত হই। আমরা আশা করেছিলাম বাংলাদেশে অভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ে রাজনৈতিক সংস্কৃতিরও পরিবর্তন হবে। কিন্তু তা হয়নি।’
শুধু এনসিপি নয়, জামায়াতে ইসলামীকে নিয়েও বিএনপির আপত্তির শেষ নেই। অথচ জামায়াতকে নিয়ে বিএনপি একাধিকবার জোট গঠন করেছিল এবং ১৯৯১ সালে জামায়াতের সমর্থন নিয়েই বিএনপি বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে সরকার গঠন করেছিল। তা না হলে তখন বিএনপির পক্ষে সরকার গঠন করা সম্ভব হতো না। জামায়াত ছাড়াও দেশের গুরুত্বপূর্ণ আরও চারটি ইসলামী সংগঠন বিএনপির নেতৃত্বাধীন ২০-দলীয় জোটের শরিক ছিল। সেগুলো হচ্ছে ইসলামী ঐক্যজোট, খেলাফত মজলিশ, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম ও বাংলাদেশ ইসলামিক পাটি। কিন্তু বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান এবং দলের অন্যান্য নেতা এখন ‘ধর্মকে কেন্দ্র করে কোনো রাজনৈতিক দল হতে পারে না’ মর্মে বক্তব্য দিয়ে ইসলামি দলগুলোর সঙ্গে দূরত্ব সৃষ্টি করতে চেষ্টা করছেন, যা আগামী নির্বাচনে বিএনপির ওপর ক্ষতিকর প্রভাব ফেলতে পারে। এসব দল বিএনপির সঙ্গে ছিল ইসলাম সম্পর্কে দলটির লিবারেল দৃষ্টিভঙ্গির কারণে। কিন্তু দেশ ও জাতির এই যুগসন্ধিক্ষণে ইসলামপন্থি দলগুলোকে দূরে সরিয়ে রাখার কৌশল অবলম্বন করা বিএনপির নিজস্ব নীতিগত সিদ্ধান্ত, নাকি কোনো মহলের আরোপিত সিদ্ধান্তের বহিঃপ্রকাশ তা নিয়ে নানা গুজব রয়েছে।
সবকিছু দেখে মনে হয়, বিপ্লব-উত্তর পরিস্থিতিতে বিএনপির মাঝে আওয়ামী লীগের চরিত্রেরই প্রতিফলন ঘটেছে। তাদের শীর্ষ নেতা থেকে অধস্তন নেতাদের কথাবার্তা, বডি ল্যাঙ্গুয়েজ ও আচার-আচরণেই তা স্পষ্ট। ক্ষমতার রাজনীতিতে অতীতেও দুটি দলের মধ্যে মৌলিক কোনো পার্থক্য দেখা যায়নি। দুর্নীতিপরায়ণতার ক্ষেত্রেও নয়। বিএনপি ক্ষমতায় থাকাকালে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের দুর্নীতিসূচকে বাংলাদেশ বেশ কবার শীর্ষ অবস্থানে ছিল। এ স্বভাব সহজে পরিবর্তনযোগ্য নয়। গত বছরের ৫ আগস্টের পর চাঁদাবাজি, দখল-লুণ্ঠনের আওয়ামী রাজত্ব হাতবদল হয়ে বিএনপির হাতে এসেছে। নির্বাচনে তারা যদি আওয়ামী লীগের কেন্দ্র দখল ও ভোটারদের ভোট কেন্দ্র থেকে বহিষ্কার করে ধানের শীষে সিল মেরে ব্যালট বাক্স পূর্ণ করে তাহলে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না।
অন্তর্বর্তী সরকারের কাজগুলো সহজ হতো জুলাই সনদের ভিত্তিতে বিভিন্ন ক্ষেত্রে আবশ্যিক সংস্কারসাধন, বিশেষ করে যথাসম্ভব সংক্ষিপ্ত সময়ের মধ্যে সংবিধান সংস্কার প্রস্তাব বাস্তবায়ন এবং বেঁধে দেওয়া সময়ের মধ্যে জুলাই গণহত্যা এবং মানবতাবিরোধী অন্যান্য অপরাধের মামলার মধ্যে প্রতীকী হলেও অন্তত একটি মামলায় পলাতক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অনুপস্থিতিতে বিচারপ্রক্রিয়া সম্পন্ন করে রায় ঘোষণা করা। ট্রাইব্যুনাল বিশেষ ধরনের আদালত, যার কাজ দ্রুত বিচার নিষ্পন্ন করা। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ দলের শীর্ষ নেতাদের বিচারিক হত্যার মাধ্যমে নির্মূল করার উদ্দেশ্যে শেখ হাসিনা স্বয়ং বাংলাদেশে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তার গড়া ট্রাইব্যুনালে এখন তিনি ও তার সহযোগীরাই আসামি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-উত্তর ন্যুরেমবার্গ ‘ইন্টারন্যাশনাল মিলিটারি ট্রাইব্যুনাল’ গঠিত হওয়ার এক বছরের কম সময়ে নাৎসি জার্মানির ২২ জন রাজনৈতিক ও সামরিক নেতা এবং ছয়টি জার্মান সংগঠনের বিচার সম্পন্ন করে ১০ জনকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করেছিল। বিচারে ও ট্রাইব্যুনালে বিচারক, আইনজীবীরা ছিলেন মিত্রবাহিনীর সদস্য দেশগুলোর। বহু জটিলতা সত্ত্বেও বিচার সম্পন্ন ও দোষীদের শাস্তি নিশ্চিত করতে তারা বিলম্ব করেননি। অনেক ক্ষেত্রে দৃষ্টান্ত স্থাপনের জন্যই বিচারের ব্যবস্থা করা হয়। বাংলাদেশে ভবিষ্যতে কোনো সরকারপ্রধান বা সরকারি দল যাতে ক্ষমতা প্রয়োগে সংবিধানপ্রদত্ত এখতিয়ারের বাইরে চলে না যায়, সেজন্য আইসিটির উচিত ছিল দ্রুত বিচার সম্পন্ন করা। তাতে অন্তর্বর্তী সরকারের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হতো এবং কোনো প্রশ্নে বিড়ম্বনার মুখে পড়তে হতো না।
আগামী ফেব্রুয়ারি মাসের মাঝামাঝি সময়ে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের লক্ষ্যে প্রস্তুতি জোরেশোরে চলছে। কেউ কেউ বলার চেষ্টা করছেন, আওয়ামী লীগকে ছাড়া নির্বাচন অন্তর্ভুক্তিমূলক বলে গণ্য হবে না। তারা যে কোনোভাবে আওয়ামী লীগকে নির্বাচনে অংশগ্রহণের সুযোগ করে দিতে চান। কিন্তু দেশে অতীতেও একাধিক নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে, যে নির্বাচন অন্তর্ভুক্তিমূলক ছিল না। কখনো আওয়ামী লীগ নির্বাচন বর্জন করেছে, আবার কখনো বিএনপি নির্বাচন বর্জন করেছে। আওয়ামী লীগ বা বিএনপির প্রতিনিধিত্ব ছাড়াই রাষ্ট্র পরিচালিত হয়েছে। সরকারব্যবস্থা এক চলমান প্রক্রিয়া, কোনো দল সরকারে না থাকলেও সরকার পরিচালনব্যবস্থা থেমে যাবে না। বর্তমানে দেশে একটি বিশেষ অবস্থা চলছে, বিশেষ ধরনের সরকার ক্ষমতায় আছে। সরকার আওয়ামী লীগের কার্যক্রমের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। তাদের নির্বাচনে অংশগ্রহণের সুযোগ নেই। বিভিন্ন মহল থেকে দাবি উঠেছে আওয়ামী লীগ ও তাদের সরকার রাষ্ট্র পরিচালনা করার নামে জনগণের ওপর যেভাবে জুলুম চালিয়েছে, হত্যা করেছে এবং রাষ্ট্রীয় সম্পদ লুণ্ঠন করেছে, সেসব অপরাধের কারণেই আওয়ামী লীগকে আরও কয়েক মেয়াদ পর্যন্ত নির্বাচনে অংশগ্রহণের সুযোগ থেকে বিরত রাখা উচিত।
লেখক : যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী সিনিয়র সাংবাদিক ও অনুবাদক