২০২৪ সালের ৫ আগস্টের পর বাংলাদেশ থেকে বিভিন্ন দেশে পাচার হয়ে যাওয়া অর্থ উদ্ধারে অন্তর্র্বর্তী সরকার নানা রকম উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। এসব অর্থ উদ্ধারে সরকারের বেশি মনোযোগ যুক্তরাজ্য, সংযুক্ত আরব আমিরাতসহ ইউরোপের কয়েকটি দেশের দিকে। কিন্তু পরিসংখ্যান বলছে, বাংলাদেশ থেকে পাচারকৃত অর্থের একটি বিপুল অংশ এসেছে কানাডায়। অর্থ পাচার করে কানাডায় এরা সম্পদের পাহাড় গড়েছেন। এদের মধ্যে অন্তত ১ হাজার জন এখন কানাডায় অবস্থান করছেন। ভারত, সংযুক্ত আরব আমিরাত, যুক্তরাজ্য এবং যুক্তরাষ্ট্রে যারা রয়েছেন; তাদের নিয়ে চর্চা হলেও কানাডায় অবস্থানরত অর্থ পাচারকারীদের নিয়ে তেমন কোনো আলোচনা নেই। উন্নত জীবনের খোঁজে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে স্থায়ীভাবে অভিবাসী হচ্ছেন বাংলাদেশিরা। কানাডা সরকারের তথ্যমতে ২০১৮ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত প্রতি বছর ৩ হাজারের অধিক বাংলাদেশি কানাডায় স্থায়ী বসবাসের সুযোগ পেয়েছেন। আর ২০০৬ থেকে ২০২৪ সালের নভেম্বর পর্যন্ত পিআর পেয়েছেন ৪৪ হাজার ১৮৬ জন বাংলাদেশি। অভিযোগ উঠেছে, সাম্প্রতিক বছরগুলোয় যেসব বাংলাদেশি বিনিয়োগকারী কোটায় কানাডায় পিআর সুযোগ পেয়েছেন, তাদের একটা অংশ মূলত অবৈধভাবে অর্জিত টাকায় এ বিনিয়োগ করেছেন। দেশ থেকে নেওয়া দুর্নীতি ও লুটের টাকায় সেখানে বিলাসী জীবনযাপন করছেন তারা। দেশের সম্পদ লুট করে কানাডায় যারা সম্পদ গড়েছেন তাদের মধ্যে শীর্ষে আছেন আমলারা। এ ছাড়া ব্যবসায়ী, রাজনীতিবিদরাও কানাডায় সম্পদ গড়েছেন। বাংলাদেশে দুর্নীতির মাধ্যমে বিপুল সম্পদের মালিক হওয়া বহু ব্যবসায়ী-আমলা-রাজনীতিক তাদের পরিবারের সদস্যদের পাঠিয়ে দিয়েছেন কানাডায়। তাদের নিয়েই গড়ে উঠেছে এ ‘বেগমপাড়া’। গণমাধ্যমের কল্যাণে দেশে বেগমপাড়া শব্দটি প্রায়ই উচ্চারিত হচ্ছে। কানাডার এ বিশেষ অঞ্চলের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ‘অর্থ পাচার’, ‘অর্থ লুট’ শব্দগুলো।
টরন্টোর পাশে লেক অন্টারিওর তীরে একটি শহর মিসিসাগা। শহরের একটি বড় কনডোমিনিয়াম হঠাৎ করেই কানাডার গণমাধ্যমের আগ্রহের কেন্দ্রে পরিণত হয় বছর দশেক আগে। সেই কনডোমিনিয়ামে মূলত থাকে দক্ষিণ এশিয়া থেকে আসা বহু অভিবাসী পরিবার। এসব পরিবারের স্বামীরা কাজ করেন মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে। স্বামীদের অনুপস্থিতিতে স্ত্রীদের নিঃসঙ্গ এবং কঠিন জীবনসংগ্রাম নিয়ে ভারতীয় পরিচালক রশ্মি লাম্বা তৈরি করলেন একটি ডকুমেন্টারি ফিল্ম। নাম ‘বেগমপুরা দ্য ওয়াইভস কলোনি’। রশ্মি লাম্বার ছবি বেগমপুরা থেকেই এসেছে বেগমপাড়া নাম। বেগমপুরা ছবি নিয়ে আলোচনা শুরু হলো কানাডার গণমাধ্যমে। আর এ ছবির সূত্র ধরে সেখানকার পত্রপত্রিকায়ও প্রকাশিত হতে থাকল অনেক ধরনের প্রতিবেদন। মধ্যপ্রাচ্যে তারা ভালোই আয় করেন। সেই অর্থ তারা কানাডায় স্ত্রীদের কাছে পাঠান পরিবারের ভরণপোষণের জন্য। মিসিসাগার কয়েকটি কনডোমিনিয়াম (বহুতল ভবন), যেখানে থাকত এ রকম অনেক পরিবার, সেগুলো পরিচিত হয়ে ওঠে বেগমপুরা নামে। যেখানে স্বামীর অনুপস্থিতিতে বেগম বা স্ত্রীরাই পরিবারের দায়িত্ব সামলাচ্ছেন একা। এ বেগমপুরার কাহিনি থেকেই মূলত প্রথম বাংলাদেশি বেগমপাড়ার কথা চালু হয়। এরপর বাংলাদেশের অনেকেই এ বেগমপাড়া কথাটি ব্যবহার করেছেন বাংলাদেশের দুর্নীতিগ্রস্ত ব্যবসায়ী-আমলা-রাজনীতিকদের কানাডায় পাড়ি জমিয়ে সেখানে দ্বিতীয় নিবাস স্থাপনের প্রতি ইঙ্গিত করে।
বেগমপুরার যে বেগমরা, তাদের সঙ্গে বাংলাদেশের কথিত বেগমপাড়ার বেগমদের অনেক তফাত। বেগমপুরার বেগমদের স্বামীরা পেশাজীবী, মধ্যপ্রাচ্যে কঠোর পরিশ্রম করে সেই অর্থ কানাডায় পাঠাচ্ছেন তাদের পরিবারের ভরণপোষণের জন্য। অন্যদিকে বাংলাদেশে যে বেগমপল্লির কথা আলোচিত হয়, সেটি কিন্তু একেবারেই ভিন্ন অর্থে, যেখানে দুর্নীতি ও লুটপাটের মাধ্যমে অর্জিত সম্পদ কানাডায় পাচার করে সেখানে আয়েশি জীবনযাপন করছে তারা সপরিবার।
দীর্ঘদিন ধরে রিয়েল এস্টেট এজেন্ট হিসেবে কাজ করছেন যারা, তারা বলেন, এ রকম বেগমপাড়া নামে হয়তো কোনো এলাকা নেই, কিন্তু এমন জায়গা বাস্তবে রয়েছে, যেখানে এ ধরনের বহু বাংলাদেশি গিয়ে বসতি গড়েছেন। বেগমপাড়া যে শুধু কথার কথা, লোকমুখে শোনা ব্যাপার, তা নয়। আমরা দেখি এখানে বাংলাদেশিরা অনেক সংখ্যায়, এমন সব জায়গায় বাড়িঘর কিনেছেন, যেটা একটু অভিজাত এলাকা। কিন্তু তাদের জ্ঞাত আয়ের সঙ্গে তাদের এ সম্পদ সংগতিপূর্ণ নয়। তারা এখানে তেমন কিছু করেন বলে তো আমরা দেখি না। কীভাবে তারা ১ বা ২ মিলিয়ন ডলারের একটি বাড়ি কেনার ক্ষমতা রাখেন? বাংলাদেশ প্রতিদিনের অনুসন্ধানে দেখা গেছে, বাংলাদেশের যেসব সন্দেহভাজন দুর্নীতিবাজ কানাডায় সম্পদ কিনেছেন, তাদের বেশির ভাগই সরাসরি তাদের লুণ্ঠিত অর্থ কানাডায় পাঠাননি। বরং এ ক্ষেত্রে তারা তৃতীয় একটি দেশ রুট হিসেবে ব্যবহার করেছেন। বাংলাদেশ থেকে অর্থ পাচার করে প্রথমে তৃতীয় একটি দেশে নেওয়া হয়েছে। তারপর সেখান থেকে অর্থ গেছে কানাডায়। যেমন ব্যাংক লুটেরারা বাংলাদেশ থেকে ব্যাংক লুটের অর্থ পাচার করেছেন প্রথমে সিঙ্গাপুরে। সিঙ্গাপুর থেকে সে টাকা বৈধ পথে নিয়ে গেছেন কানাডায়। সেখানে কিনেছেন বাড়ি এবং অন্যান্য সম্পদ। প্রধানমন্ত্রীর সাবেক মুখ্য সচিব ড. আহমদ কায়কাউস উচ্চশিক্ষার জন্য সরকারি চাকরিতে শিক্ষা ছুটি নিয়ে যান মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। সেখানে গ্রহণ করেন মার্কিন নাগরিকত্ব। পরে মার্কিন নাগরিকত্বের তথ্য গোপন করে দেশে এসে সরকারি চাকরিতে আবার যোগ দেন। বিদ্যুৎ সচিব হিসেবে পান পদোন্নতি। এরপর শুরু হয় দুর্নীতি এবং লুটপাট। এসব দুর্নীতির অর্থ পাচার করেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। স্ত্রী ও কন্যার নামে কোম্পানি করেন সেখানে। তারপর যুক্তরাষ্ট্র থেকে সহজেই অর্থ পাচার করেন কানাডায়। এভাবেই সিঙ্গাপুর, সংযুক্ত আরব আমিরাত, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য থেকে বাংলাদেশি লুটেরাদের অর্থ গেছে কানাডায়। পানামা পেপারসের তথ্যমতে ট্যাক্স হ্যাভেন হিসেবে পরিচিত দেশে অবৈধ অর্থ পাচার করেছেন অনেক বাংলাদেশি। গ্রহণ করেছেন সে দেশের নাগরিকত্ব। তারপর অর্থ নিয়ে গেছেন কানাডায়। অবৈধ অর্থে সম্পদ কিনেছেন। অবশ্য এর ব্যতিক্রমও আছে। অনেকে সন্তান ও পরিবারের সদস্যদের কানাডার পিআর (স্থায়ী অধিবাসী) করেছেন। এরপর তার কাছে এ দেশ থেকে পাঠিয়েছেন অর্থ। যেমন বিটিভির সাবেক জেনারেল ম্যানেজার মাহফুজা আক্তার। স্বামীকে কানাডায় পাঠিয়ে সেখানে পাচার করেছেন অবৈধ অর্থ। এভাবেই কানাডায় গড়ে উঠেছে বেগমপাড়ার বাংলাদেশ সংস্করণ। কানাডার সাধারণ প্রবাসী বাংলাদেশিদের ধারণা, কানাডায় অর্জিত সম্পদ দিয়ে তারা এসব বাড়ি কেনেননি, এ অর্থ এসেছে বাংলাদেশ থেকে। অনুসন্ধানে দেখা যায়, ২০০৮ থেকে ২০১৪ সময়ে কানাডায় বেশি গেছেন ব্যবসায়ীরা। তখন ইনভেস্টমেন্ট ক্যাটাগরিতে একটি ভিসা দেওয়া হতো, তখন কানাডায় একটি নির্দিষ্ট অঙ্ক বিনিয়োগ করে বা কানাডা সরকারের কাছে অর্থ জমা রেখে ইমিগ্রেশনের সুযোগ ছিল। কিন্তু ২০১৪ সালে কানাডা সরকার এটি বন্ধ করে দেয়। এর অন্যতম কারণ ছিল এই ক্যাটাগরিতে আসা অভিবাসীদের কর পরিশোধের রেকর্ড। কানাডার একেবারে সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষ যে পরিমাণ কর দেয়, এদের দেওয়া করের পরিমাণ তার চেয়েও কম বা তারা একেবারেই কর দেয় না। তখন সরকার এ স্কিম বন্ধ করে দেয়। ব্যাপকহারে এ ধরনের লোকজনের কানাডায় অভিবাসন প্রথম শুরু হয় ২০০৭-২০০৮ সালে, যখন বাংলাদেশে সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার দুর্নীতিবিরোধী অভিযান শুরু করে।
দীর্ঘদিন ধরে টরন্টোয় থাকা নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক বাংলাদেশি বলেন, ‘তখন বাংলাদেশ থেকে অনেক ব্যবসায়ীর একটি দল কানাডায় যায়। টরন্টোর বেলভিউ এলাকায় কিছু হাইরাইজ কনডোমিনিয়াম আছে। বেশ বিলাসবহুল। ডাউনটাউন থেকে বেশি দূরে নয়। প্রথম যে ব্যবসায়ীরা এসেছিলেন, তারা ওখানে উঠেছিলেন। তারপর ঝাঁক ধরে যারা এসেছেন, তারাও ওখানেই গিয়েছেন।’
তিনি আরও বলেন, ‘টরন্টোর একেবারে প্রাণ কেন্দ্র সিএন টাওয়ারের পাশে আরেকটি কনডোমিনিয়াম আছে, সেটি অনেক বেশি বিলাসবহুল। সেখানেও অনেক বাংলাদেশি রয়েছেন। অনেকের কনডোমিনিয়াম সেখানে আছে। কিনে রেখে চলে গেছেন, কারওটা হয়তো খালিও পড়ে আছে। তবে এর পরে যারা এভাবে কানাডায় অভিবাসী হয়েছেন, তারা ছড়িয়ে পড়েছেন আরও বিভিন্ন জায়গায়। এদের পছন্দ ছিল এমন জায়গা, যেখানে সাধারণ বাংলাদেশিদের সঙ্গে তাদের মিশতে হবে না। এরা ৬, ৭ বা ৮ হাজার স্কয়ার ফিটের বড় বড় বাড়ি কিনেছেন।
রিয়েল এস্টেট ব্যবসায়ীদের মতে যে কথিত অর্থ পাচারকারীদের বিরুদ্ধে এখন প্রতিবাদ শুরু হয়েছে, সে রকম খুবই বিত্তশালী বাংলাদেশির সংখ্যা বৃহত্তর টরন্টো এলাকাতেই দুই শর কম হবে না। টরন্টো এবং নিকটবর্তী শহর রিচমন্ড হিল, মিসিসাগা এবং মার্কহামের অভিজাত এলাকায় বাংলাদেশিরা এ রকম দামি বাড়ি কিনেছেন। এভাবেই কানাডায় গড়ে উঠেছে বাংলাদেশের দুর্নীতিবাজদের বেগমপাড়া; যেখানে কোটি কোটি টাকার ফাঁদ গড়েছেন লুটেরা আমলা, রাজনীতিক এবং ব্যবসায়ীরা।