তালেবান শাসিত আফগানিস্তানে মাত্র ৪৮ ঘণ্টার জন্য ইন্টারনেট ও ফোন সংযোগ বন্ধ করে পুরো দেশকে যেন সময়ের চাকা উল্টো ঘুরিয়ে দিল তালেবান সরকার। হঠাৎ করেই বিশ্বের সঙ্গে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিল দেশটির প্রায় ৪ কোটি ৩০ লাখ মানুষ।
দেশজুড়ে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। পরিবার, বন্ধু, সহকর্মীরা কেউ কারো সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারছিল না এ সময়জুড়ে। ব্যাংক লেনদেন থেমে যায়, ব্যবসা-বাণিজ্য বন্ধ হয়ে পড়ে, ফ্লাইট স্থগিত হয়, এমনকি আন্তর্জাতিক সাহায্য সংস্থাগুলোর কার্যক্রমও স্থবির হয়ে যায়।
কাবুলভিত্তিক সাংবাদিক হেওয়াদ ওয়াতান্দার (ছদ্মনাম) সিএনএনকে জানান, “মানুষের মুখে তখন যেন প্রাণ নেই। সবাই ভয়ে ও হতাশায় অবশ হয়ে পড়েছিল।
অঘোষিত আদেশে নীরব দেশ
এর আগে গত সোমবার বিকেল ৫টার পর কোনো পূর্বঘোষণা ছাড়াই ইন্টারনেট ও মোবাইল সংযোগ একযোগে বিচ্ছিন্ন করা হয় দেশটিতে। তাৎক্ষণিকভাবে এই পদক্ষেপের পেছনে কারণ না জানা গেলেও আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম ও মানবাধিকার সংগঠনগুলো এটিকে সরাসরি তালেবান সরকারের নির্দেশ হিসেবে ধরে নেয়।
এর আগে, উত্তরাঞ্চলের বালখ প্রদেশে ‘অনৈতিক কার্যকলাপ রোধে’ ইন্টারনেট বন্ধের নির্দেশ দিয়েছিল দেশটির প্রশাসন। প্রাদেশিক গভর্নরের মুখপাত্র হাজি জায়েদ জানিয়েছিলেন, এই আদেশ এসেছে তালেবানের সর্বোচ্চ নেতা মাওলভি হিবাতুল্লাহ আখুন্দজাদার কাছ থেকে। তিনি আরও বলেন, “প্রয়োজনীয় কার্যক্রমের জন্য বিকল্প ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”
কিন্তু এইবারের সারাদেশব্যাপী সংযোগ বিচ্ছিন্নের কোনো কারণ সরকারিভাবে জানানো হয়নি। যদিও গত বুধবার হঠাৎ করেই সংযোগ আবারও ফিরিয়ে আনা হয়।
দুই দিনের এই ব্ল্যাকআউটে দেশব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে ভয় ও অনিশ্চয়তা। বিশেষ করে নারীরা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হন, কারণ ইন্টারনেটই ছিল তাদের একমাত্র শিক্ষার ও বাইরের জগতের সঙ্গে সংযোগের মাধ্যম। বলছে সিএনএন।
শিক্ষা সংস্থা সোলাক্স এর সহ-প্রতিষ্ঠাতা মাতি আমিন বলেন, “আমাদের শিক্ষা প্রোগ্রামে অংশ নেওয়া শিক্ষার্থীরা হঠাৎ পুরোপুরি অদৃশ্য হয়ে গেছে। আমরা জানি না তারা নিরাপদ আছে কিনা।”
রেডিও বেগমের প্রতিষ্ঠাতা হামিদা আমান জানান, স্থানীয় রেডিও ও টিভি সম্প্রচারও বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। শুধু ফ্রান্স থেকে পরিচালিত স্যাটেলাইট টিভি ‘বেগম টিভি’ তখনও সম্প্রচার চালিয়ে যায়।
তিনি লিখেছেন, “স্যাটেলাইট টিভিই এখন আফগানদের একমাত্র জানালা।”
অর্থনীতিতে বড় ধাক্কা
সিএনএন এর খবর অনুযায়ী ইন্টারনেট বন্ধের প্রভাব পড়ে দেশের অর্থনীতিতেও। অনলাইন ব্যাংকিং, লেনদেন ও বৈদেশিক মুদ্রা ব্যবসা সবকিছুই থেমে যায়।
কাবুলের মানি এক্সচেঞ্জার আব্দুল হামিদ বলেন, “আমি জানতাম না ডলার রেট কত। তাই ট্যাক্সি নিয়ে ৪ ঘণ্টা দূরে গিয়ে বাজারে খোঁজ নিতে হয়েছিল। পরদিন দোকানই খুলি নাই।”
বাণিজ্যিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় কৃষি রপ্তানিও। পাকিস্তানের পেশোয়ারে অবস্থানরত ফল ব্যবসায়ী সাবির শাহ জানান, “আফগানিস্তান থেকে কত ট্রাক আসছে, কোথায় যাচ্ছে কিছুই জানতে পারছি না। ইন্টারনেট আর ফোন ছাড়া কিছুই সম্ভব নয়।”
কাবুলের স্কুলশিক্ষিকা মাইমুনা দুরানি (ছদ্মনাম) বলেন, “কেউ কারো সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারছিল না। মনে হচ্ছিল আমরা একেবারে অতীতে ফিরে গেছি।”
১৯ বছর বয়সী ছাত্রী সামিরা বলেন, “যখন ইন্টারনেট ফিরে আসে, সবাই ক্লাস থেকে দৌড়ে বাড়ি ফিরছিল, যেন কোনো উৎসব হচ্ছে। আমি পথে দেখেছি প্রায় সবাই মোবাইলে কথা বলছে, কেউ মেসেজ পড়ছে।”
আন্তর্জাতিক নিন্দা ও উদ্বেগ
জাতিসংঘ, হিউম্যান রাইটস ওয়াচ ও অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালসহ একাধিক মানবাধিকার সংস্থা এই পদক্ষেপের তীব্র নিন্দা জানায়। জাতিসংঘের আফগানিস্তানবিষয়ক বিশেষ প্রতিনিধি রিচার্ড বেনেট সতর্ক করে বলেন, “এই ধরনের সংযোগ বিচ্ছিন্নতা মানবাধিকার সংকট আরও বাড়াবে এবং অর্থনীতি সম্পূর্ণভাবে ধসিয়ে দিতে পারে।”
মূল লেখক: হিলারি হুইটম্যান
সিএনএন সূত্রে অনুবাদ
বিডি প্রতিদিন/আশিক