বাংলাদেশে তামাকজাত পণ্য ও নিরাপদ বিকল্পের অবৈধ বাণিজ্য নিয়ে বেশ কথা উঠছে। এই বিতর্কে স্পষ্টভাবে দুইটি মতামত সামনে এসেছে। একদল মনে করে, বাস্তবসম্মত ও ভারসাম্যপূর্ণ নীতিই হতে পারে সবচেয়ে ভালো পথ— যেখানে জনস্বাস্থ্য সুরক্ষিত থাকবে, বাজারের বাস্তবতাকেও গুরুত্ব দেওয়া হবে, আর ধূমপায়ীরা পাবে নিরাপদ ও নিয়ন্ত্রিত বিকল্পের সুযোগ। যদিও ধূমপান কোনোভাবে গ্রহণযোগ্য নয়। তারপরও মন্দের ভাল-অনেকেই নিয়ন্ত্রিত বিকল্প খোঁজার চেষ্টা করছেন। অন্যদিকে, কিছু প্রভাবিত গোষ্ঠী সব ধরনের বিকল্প পুরোপুরি নিষিদ্ধ করার দাবি তুলেছে। কিন্তু অনেকে মনে করছেন, তারা বাস্তবতা বোঝে না, না বোঝে বিশ্বজুড়ে পাওয়া প্রমাণ। এই একপেশে ভাবনা শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশের জনস্বাস্থ্য নীতি ও অর্থনীতির অগ্রগতির পথে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে। এমনটাই ভাবছেন অনেকে।
চলতি বছরের শুরুর দিকে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) চেয়ারম্যান মো. আব্দুর রহমান খান উল্লেখ করেছিলেন যে, তামাকজাত পণ্য ও নিরাপদ বিকল্পের অবৈধ বাণিজ্যের কারণে বাংলাদেশ বিপুল পরিমাণ রাজস্ব হারাচ্ছে। তিনি এ ধরনের পণ্যের অবাধ প্রচারের পক্ষে না হলেও, সরাসরি নিষিদ্ধ করার পরিবর্তে ভারসাম্যপূর্ণ নীতিমালার প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দেন। তার মতে, সম্পূর্ণ নিষেধাজ্ঞা সাধারণত ভোক্তাদের অবৈধ ও নিয়ন্ত্রণহীন কালোবাজারের দিকে ঠেলে দেয়, ফলে সরকার রাজস্ব হারায়, আর মানুষ আরও ক্ষতিকর পণ্যের সংস্পর্শে আসে। অস্ট্রেলিয়া, ভারত ও থাইল্যান্ডের অভিজ্ঞতা এই বাস্তবতারই প্রমাণ।
আজও বাংলাদেশ এশিয়ার সেই দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম, যেখানে তামাক ব্যবহারের প্রভাব সবচেয়ে বেশি। জাতীয় স্বাস্থ্য তথ্য অনুযায়ী, দেশের ৩৫ শতাংশেরও বেশি প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ কোনো না কোনোভাবে তামাক ব্যবহার করেন। বহু বছর ধরে সচেতনতা কার্যক্রম, ভয়াবহ স্বাস্থ্য সতর্কবার্তা ও কর বৃদ্ধি সত্ত্বেও তামাক আসক্তির প্রভাব দেশে এখনো শক্তভাবেই রয়ে গেছে।
অন্যদিকে, সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাত (ইউএই) তাদের নাগরিকদের ধূমপান ছাড়তে সহায়তা করার মাধ্যমে জনস্বাস্থ্য উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নিচ্ছে। সৌদি আরবের পাবলিক ইনভেস্টমেন্ট ফান্ড (পিআইএফ) ২০২৩ সালে ‘বাদাইল’ নামে একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলে, যা তাদের ধূমপান ত্যাগে সহায়তা করে। প্রতিষ্ঠানটি তাদের প্রধান পণ্য ‘ডিজার্ট’ – একটি তামাকমুক্ত নিকোটিন পাউচ এর মাধ্যমে ১০ লাখ মানুষকে ধূমপান ছাড়তে সহায়তা করার লক্ষ্য নিয়েছে। দুই বছরেরও কম সময়ে, বাদাইল প্রায় ৪ লাখ ধূমপায়ীকে সিগারেট থেকে দূরে সরিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছে, যার মধ্যে প্রায় ১ লাখ ৪০ হাজার মানুষ সম্পূর্ণভাবে নিকোটিন ত্যাগ করেছেন। এই উদ্যোগ সৌদি আরবের দীর্ঘমেয়াদি ‘তামাকমুক্ত দেশ’ গড়ার লক্ষ্যকে সমর্থন করে, যেখানে সরকার ক্ষতি হ্রাস নীতিকে জনস্বাস্থ্য রক্ষার একটি কার্যকর ও বাস্তবসম্মত উপায় হিসেবে দেখছে।
একইভাবে, সংযুক্ত আরব আমিরাতও (ইউএই) দেশে ধূমপানজনিত সমস্যা মোকাবিলায় তামাকমুক্ত ওরাল নিকোটিন পাউচ নিয়ন্ত্রণে নিয়ম প্রণয়নের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ইউএই’র শিল্প ও উন্নত প্রযুক্তি মন্ত্রণালয় (এমওআইএটি) তামাকমুক্ত ওরাল নিকোটিন পাউচের জন্য একটি টেকনিক্যাল স্ট্যান্ডার্ড বা প্রযুক্তিগত মানদণ্ড নির্ধারণ করেছে। এই সিদ্ধান্ত সরকারের জনস্বাস্থ্য সুরক্ষা ও পণ্যের গুণগত মান নিয়ন্ত্রণে দৃঢ় অঙ্গীকারেরই প্রতিফলন।
মধ্যপ্রাচ্য ও ইউরোপের গবেষণায় দেখা গেছে, সঠিকভাবে নিয়ন্ত্রিত ও ব্যবহৃত হলে নিকোটিন পাউচ দহনযোগ্য সিগারেটের তুলনায় অনেক কম ক্ষতিকর। ২০০৮ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) সিগারেটের ধোঁয়ায় থাকা নয়টি প্রধান বিষাক্ত উপাদান শনাক্ত করেছিল। পরবর্তী গবেষণায় দেখা যায়, তামাকমুক্ত নিকোটিন পাউচে এই ক্ষতিকর উপাদানগুলো ৯৯ শতাংশেরও বেশি কমে যায়।
চলতি বছরের শুরুর দিকে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (এফডিএ) দেশটিতে জেডওয়াইএন নিকোটিন পাউচের বিপণন অনুমোদন দিয়েছে। এফডিএ জানিয়েছে, পর্যাপ্ত প্রমাণ রয়েছে যে এই নতুন পণ্যগুলো জনস্বাস্থ্যের জন্য ঝুঁকির চেয়ে বেশি সুবিধা প্রদান করে। এফডিএ-এর সেন্টার ফর টোবাকো প্রোডাক্টস-এর অফিস অফ সায়েন্সের পরিচালক ম্যাথু ফ্যারেলি (পিএইড.ডি) বলেছেন, এই ক্ষেত্রে তথ্য দেখাচ্ছে যে, যারা সিগারেট বা নন-স্মোকিং টোবাকো ব্যবহার করেন এবং পরে সম্পূর্ণভাবে এই নিকোটিন পাউচে তাদেরকে পরিবর্তন করেন, তাদের জন্য এই পণ্যগুলো কার্যকরভাবে সুবিধা প্রদান করে।
সংযুক্ত আরব আমিরাত ও সৌদি আরবের ভারসাম্যপূর্ণ অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়ে বিশ্বের অনেক দেশ এদিকে ধাবিত হওয়ার চেষ্টা করছে। তাদের মতে এধরণের একটি দূরদর্শী পদক্ষেপ যা ক্ষতি কমাবে, রাজস্ব পুনরুদ্ধার করবে এবং প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য নিরাপদ বিকল্পের সুযোগ সৃষ্টি করে এমন একটি স্বাস্থ্যসম্মত ও আরও স্থিতিশীল ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করবে।
লেখক : আইনজীবী, ঢাকা জজ কোর্ট ও মানবাধিকার কর্মী।
(লেখার প্রকৃতি ও ধরণ এবং চিন্তাধারা লেখকের সম্পূর্ণ নিজস্ব)
বিডি-প্রতিদিন/শআ/বিজ্ঞাপন বার্তা