জুলাই-আগস্ট গণ অভ্যুত্থানের ঘটনায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ তিন আসামির বিরুদ্ধে করা মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলার রায় কবে ঘোষণা করা হবে, সেই দিন জানা যাবে আজ। গত ২৩ অক্টোবর মামলার বিচারকাজ শেষে বিচারপতি মো. গোলাম মর্তূজা মজুমদারের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ রায়ের তারিখ জানানোর জন্য আজকের দিন ধার্য করে দিয়েছিলেন। সেদিন ট্রাইব্যুনাল জানিয়েছিলেন, রায়ের এই তারিখ হবে অল্প সময়ের মধ্যে। ট্রাইব্যুনালের অন্য দুই সদস্য হলেন-
বিচারপতি মো. শফিউল আলম মাহমুদ ও বিচারক মো. মোহিতুল হক এনাম চৌধুরী।
এদিকে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে করা এ মামলার রায়ের তারিখ ঘোষণাকে কেন্দ্র করে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল এলাকায় বাড়তি নিরাপত্তাব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। নিয়মিত দায়িত্বপালনকারী আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যের পাশাপাশি আজ অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হবে। পাশাপাশি সেনাবাহিনী, বিজিবি ও সাদা পোশাকে গোয়েন্দা সদস্যরা নিয়োজিত থাকবেন। সুপ্রিম কোর্ট এলাকায় দায়িত্ব পালনকারী এক গোয়েন্দা কর্মকর্তা বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ট্রাইব্যুনাল এলাকায় যে কোনো ধরনের গোলযোগ ঠেকাতে সব ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। নিরাপত্তা থাকবে চার স্থরে। এদিকে ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউশন টিমও ট্রাইব্যুনালের বাড়তি নিরাপত্তার কথা সংবাদিকদের জানিয়েছেন।
রায়ের তারিখ ঘোষণাকে কেন্দ্র করে কার্যক্রম নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগ ‘লকডাউন’ কর্মসূচি ঘোষণা করে। এ ঘোষণার পর গত ৯ অক্টোবর সার্বিক নিরাপত্তার স্বার্থে সুপ্রিম কোর্ট, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল, অ্যাটর্নি জেনারেলের কার্যালয় ও সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতি ভবন এলাকায় বহিরাগতদের প্রবেশও নিষিদ্ধ করা হয়। এদিকে প্রসিকিউটর মো. মিজানুল ইসলাম বলেছেন, সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিচারের রায়ের দিন ঘোষণা কার্যক্রম ঘিরে সরকারের বিরুদ্ধে প্রোপাগান্ডার অংশ হিসেবে দেশজুড়ে নৈরাজ্যের লক্ষ্যে বিভিন্ন কর্মকাণ্ড চালাচ্ছে আওয়ামী লীগ। তবে এটিকে থ্রেট টু জাস্টিস মনে করি না। বিচার প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করার জন্য তারা এমনটা করছে। গতকাল ট্রাইব্যুনাল প্রাঙ্গণে ব্রিফিংয়ে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে তিনি এসব কথা বলেন। বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি নিয়ে মিজানুল ইসলাম বলেন, আইনানুগভাবে বিচার কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। এখন দেশে যে বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি সৃষ্টি করার অপচেষ্টা চালানো হচ্ছে, দৃঢ়তার সঙ্গে এ ধরনের পদক্ষেপকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী রুখে দেবে বলে আমার বিশ্বাস।
শেখ হাসিনা ছাড়া তার সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ও তার সময়ের সর্বশেষ পুলিশপ্রধান (আইজিপি) চৌধুরী আবদুল্লাহ-আল-মামুনও এ মামলায় আসামি। তবে চৌধুরী মামুন দোষ স্বীকার করে হয়েছেন রাজসাক্ষী (অ্যাপ্রুভার)। রাজসাক্ষী হিসেবে ট্রাইব্যুনালে সাক্ষ্যও দিয়েছেন। এ মামলায় মোট ৫৪ জন সাক্ষী উপস্থাপন করে প্রসিকিউশন। ২৮ কার্যদিবসে এসব সাক্ষী উপস্থাপন করে তারা। তবে শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামান খান কামাল পলাতক থাকায় তাদের পক্ষে কোনো সাফাই সাক্ষী উপস্থাপন হয়নি ট্রাইব্যুনালে।
প্রসিকিউশনের তথ্য অনুযায়ী, এ মামলায় মোট ৮৪ জনকে সাক্ষী করা হয়েছিল। তবে রাজসাক্ষীসহ ৫৪ জনকে উপস্থাপন করা হয়েছে। এর মধ্যে চাক্ষুষ সাক্ষী সাতজন, আহত ভুক্তভোগী দুজন, ভুক্তভোগীর পরিবারের আটজন, আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী সাতজন, আহতদের চিকিৎসক সাক্ষী তিনজন এবং জব্দ তালিকার সাক্ষী রয়েছেন ১৪ জন। সাংবাদিক হিসেবে সাক্ষ্য দিয়েছেন একজন।
ময়নাতদন্তকারী চিকিৎসক একজন, ঘটনার সমর্থন সাক্ষী দুজন, রাজসাক্ষী একজন, বিশেষ তদন্তকারী কর্মকর্তা একজন ও মূল তদন্ত কর্মকর্তা হিসেবে একজনের সাক্ষ্য উপস্থাপন করা হয়েছে। এ ছাড়া ম্যাজিস্ট্রেট, বিশেষজ্ঞ, ওয়ারলেস বার্তার সাক্ষী হিসেবে একজন করে; ফরেনসিক, ঘটনার পটভূমির সাক্ষী হিসেবে দুজন করে জবানবন্দি দিয়েছেন ট্রাইব্যুনালে।
গত ২৩ অক্টোবর চূড়ান্ত যুক্তিতর্কে চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড দাবি করেন ট্রাইব্যুনালের কাছে। আর তাদের পক্ষে রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবী মো. আমির হোসেন দাবি করেন, তার মক্কেলরা নির্দোষ, তারা খালাস পাবেন।
গত বছরের ৫ আগস্ট গণ অভ্যুত্থানের পর মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের জন্য আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল পুনর্গঠন করা হয়। এরপর চলতি বছরের ২৫ মে থেকে ৮ অক্টোবরের মধ্যে মানবতাবিরোধী অপরাধে যেসব মামলায় আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিল করা হয়েছে, তার মধ্যে জুলাই গণ অভ্যুত্থানের সময় হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় করা মামলা আটটি। এর মধ্যে পাঁচটি মামলায় অভিযোগ গঠন করে বিচার শুরু করেছেন ট্রাইব্যুনাল। বিচারাধীন পাঁচটি মামলার মধ্যে শেখ হাসিনাসহ তিন আসামির বিরুদ্ধে এ মামলাটিই রায় ঘোষণার পর্যায়ে এসেছে সবার অগে।
এ মামলায় দালিলিক হিসেবে ৯০টি তথ্যচিত্র ও ৩৫টি বস্তুগত প্রমাণ জমা দেওয়া হয় প্রসিকিউশনের পক্ষ থেকে। এর মধ্যে তৎকালীন সরকারের সিদ্ধান্ত, গুলির নির্দেশনা, অডিও-ভিডিওসহ জব্দ করা বিভিন্ন নথিপত্র রয়েছে। মামলার বিশেষ তদন্ত কর্মকর্তা ও প্রসিকিউটর তানভীর হাসান জোহার সাক্ষ্যের দিন চারটি ফোনালাপের অডিও রেকর্ড বাজিয়ে শোনানো হয় ট্রাইব্যুনালে; যা যুক্তিতর্কে শক্তভাবে উপস্থাপন করে প্রসিকিউশন। ফোনালাপের একটি শেখ হাসিনা-শেখ ফজলে নূর তাপসের, একটি হাসিনার সঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি মাকসুদ কামালের এবং দুটি হাসিনার সঙ্গে জাসদ সভাপতি হাসানুল হক ইনুর। তাদের কথোপকথনে জুলাই-আগস্ট আন্দোলন দমনের নীলনকশা, নৃশংসতা ও হত্যাকাণ্ডের ইঙ্গিত মেলে। এ ছাড়া, সাক্ষীদের জবানবন্দিতেও উঠে আসে নানা তথ্য-উপাত্ত। ফলে আসামিদের বিরুদ্ধে আনা পাঁচটি অভিযোগই প্রমাণিত- দাবি প্রসিকিউশনের।
শেখ হাসিনার পতনের পর গত বছরের ১৪ আগস্ট আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে একটি অভিযোগ দায়ের হয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে দুই মাস পর অর্থাৎ ১৪ অক্টোবর তদন্তকাজ শুরু করেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। তদন্তে জুলাই-আগস্ট গণ অভ্যুত্থানে দেশজুড়ে সংঘটিত হত্যাকাণ্ড, লাশ পুড়িয়ে ফেলাসহ সব মানবতাবিরোধী অপরাধের প্রধান ‘মাস্টারমাইন্ড’ বা ‘সুপিরিয়র কমান্ডার’ হিসেবে শেখ হাসিনার নাম উঠে আসে। এরই ধারাবাহিকতায় জুলাই-আগস্টে গণহত্যার হুকুমদাতা হিসেবে শেখ হাসিনাসহ তিনজনের বিরুদ্ধে চলতি বছরের ১২ মে প্রতিবেদন জমা দেয় তদন্ত সংস্থা। এরপর ট্রাইব্যুনাল-১ এ আনুষ্ঠানিক অভিযোগ জমা দেয় প্রসিকিউশন।
দুই ধাপে শুনানি শেষে তাদের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ গঠন করে বিচার শুরুর আদেশ দেন ট্রাইব্যুনাল-১। গত ৩ আগস্ট সূচনা বক্তব্য উপস্থাপনের মাধ্যমে শুরু হয় এ মামলার বিচার। ওই দিন প্রধম সাক্ষীর সাক্ষ্য গ্রহণও করেছেন ট্রাইব্যুনাল। ৮ অক্টোবর তদন্ত কর্মকর্তা মো. আলমগীরের জেরার মাধ্যমে শেষ হয় মামলার সাক্ষ্য গ্রহণের ধাপ। পরে দুই পক্ষে যুক্তিতর্ক উপস্থাপনের মধ্য দিয়ে শেষ হয় মামলার বিচার। এ মামলায় শেখ হাসিনাসহ তিন আসামির বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের পাঁচটি অভিযোগ আনে প্রসিকিউশন। আনুষ্ঠানিক অভিযোগ মোট ৮ হাজার ৭৪৭ পৃষ্ঠার। এর মধ্যে তথ্যসূত্র ২ হাজার ১৮ পৃষ্ঠার, জব্দ তালিকা ও দালিলিক প্রমাণাদি ৪ হাজার পাঁচ পৃষ্ঠার ও শহীদদের তালিকার বিবরণ ২ হাজার ৭২৪ পৃষ্ঠার।