বাংলাদেশ ব্যাংকের ভিতরে কয়েক মাস ধরে জমে থাকা অসন্তোষ এখন প্রকাশ্যে এসেছে। গভর্নর আহসান এইচ মনসুরের প্রশাসনিক পদক্ষেপ, সিদ্ধান্ত গ্রহণের ধরন এবং যোগাযোগব্যবস্থার ওপর তীব্র অসন্তোষ ব্যক্ত করা হয়েছে অফিসার্স ওয়েলফেয়ার কাউন্সিলের অভিযোগে। এক সময়ের স্থিতিশীল প্রতিষ্ঠান হিসেবে পরিচিত কেন্দ্রীয় ব্যাংক এখন প্রশাসনিক অস্থিরতা ও মনোবলহীনতার ঝুঁকিতে পড়ছে বলে মনে করছেন কর্মকর্তারা।
ঐতিহ্য ভেঙে ওপেন ডোর নীতি থেকে লকড ফ্লোর : বাংলাদেশ ব্যাংকে দীর্ঘদিন ধরে প্রচলিত ছিল ওপেন ডোর পলিসি যে নীতিতে কর্মকর্তারা সরাসরি গভর্নর বা ডেপুটি গভর্নরের সঙ্গে দেখা করে মতামত ও উদ্বেগ জানাতে পারতেন। কাউন্সিলের অভিযোগ, সেই সংস্কৃতি এখন ভেঙে পড়েছে। প্রধান ভবনের চতুর্থ তলায় অবস্থিত এক্সিকিউটিভ ফ্লোরের প্রবেশদ্বার তালাবদ্ধ, কর্মকর্তাদের শুধু লিফটের মাধ্যমে যাতায়াতের অনুমতি দেওয়া হচ্ছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন যুগ্ম পরিচালক বলেন, গভর্নরের দরজা নয়, এখন পুরো ফ্লোরটাই বন্ধ। আমরা যেন কোনো গোপন দুর্গে প্রবেশ করছি এমন পরিবেশ কর্মীদের মনে দূরত্ব তৈরি করছে। নারীকর্মীরা আরও অভিযোগ করেছেন, বাইরের লোকদের ব্যবহৃত করিডর দিয়ে তাদের চলাচল করতে হয়, যা নিরাপত্তা ও মর্যাদার জন্য অপমানজনক।
পদোন্নতি স্থবিরতা ও প্রশাসনিক শূন্যতা : বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রথম শ্রেণির ৬ হাজার ২৬০ পদের মধ্যে প্রায় ১ হাজার ৯৩৬টি শূন্য অর্থাৎ প্রায় ৩১ শতাংশ পদ ফাঁকা। নির্বাহী পরিচালকের চারটি পদ বহু বছর ধরে খালি, অতিরিক্ত পরিচালক পর্যায়েও ১৯ মের পর থেকে কোনো পদোন্নতি হয়নি। কাউন্সিলের ভাষায়, যোগ্য কর্মকর্তাদের উপেক্ষা ও ইচ্ছাকৃত বিলম্ব প্রতিষ্ঠানকে মনোবলহীন করে দিচ্ছে।
পরামর্শক নির্ভরতা ও অভ্যন্তরীণ অবিশ্বাস : অভিজ্ঞ কর্মকর্তাদের পাশ কাটিয়ে গভর্নরের ‘উপদেষ্টা ও কনসালট্যান্ট নির্ভরতা’ নিয়েও অসন্তোষ তীব্র। অভিযোগ উঠেছে, এসব উপদেষ্টা অনেকেই দেশের ব্যাংকিং বাস্তবতা ভালোভাবে জানেন না। ফলে তাদের দেওয়া প্রস্তাব বা বিশ্লেষণ বাস্তবতার সঙ্গে সাংঘর্ষিক হচ্ছে, যা নীতিনির্ধারণে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করছে।
লকার, ভাতা, গাড়ি সুবিধা এবং ছোট ছোট সিদ্ধান্তে বড় আঘাত : কর্মকর্তারা বলছেন, লকার ফ্রিজ, প্রশিক্ষণ ভাতা কমানো, গাড়ি সুবিধা না থাকা এসব ছোট ছোট সিদ্ধান্ত প্রতিদিনের কর্মজীবনে বড় প্রভাব ফেলছে। সরকারি অন্যান্য সংস্থার পঞ্চম গ্রেড কর্মকর্তারা গাড়ি সুবিধা পাচ্ছেন, কিন্তু কেন্দ্রীয় ব্যাংকে দীর্ঘদিন ধরে সেই প্রণোদনা স্থগিত। এর ফলে কর্মকর্তাদের মনে বঞ্চনা ও অবমূল্যায়নের অনুভূতি তৈরি হয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের অবস্থান কর্মীদের পাশে নয় বিপরীতে : দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) অনুরোধে বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শকরা বিভিন্ন স্থানে কাজ করলেও, দুদকের প্রতিবেদনে তাদেরই দায়ী করা হচ্ছে বলে অভিযোগ। কাউন্সিল বলেছে, বিষয়টি গভর্নরকে বহুবার জানানো হলেও তিনি উদ্যোগ নেননি। এতে কর্মকর্তারা মনে করছেন, প্রশাসন কর্মীদের পাশে নয়, বরং বিপরীতে দাঁড়াচ্ছে।
নীতি-বাস্তবায়নে ধীরগতি ও অনিশ্চয়তা : অর্থনীতিবিদদের মতে, বাংলাদেশ ব্যাংকের বর্তমান অস্থিরতা কেবল অভ্যন্তরীণ নয়, নীতি-বাস্তবায়নের গতিকেও প্রভাবিত করতে পারে। যেমন : মুদ্রানীতি কঠোর করা, ব্যাংক একীভূতকরণ, দুর্বল ব্যাংক পর্যবেক্ষণ, ডলারসংকট ব্যবস্থাপনা এসব গুরুত্বপূর্ণ কাজেই সিদ্ধান্ত গ্রহণ ধীর হতে পারে। ফলে আর্থিক খাতের সংস্কার বিলম্বিত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। তাই অভ্যন্তরীণ সংকট নিরসনে প্রতি ১৫ দিনে গভর্নর কাউন্সিল বৈঠক নিয়মিত করার বিষয়টি নিশ্চিত করা। খালি পদ দ্রুত পূরণ ও স্বচ্ছ পদোন্নতি প্রক্রিয়া পুনঃপ্রবর্তন। এ ছাড়া নীতিগত সিদ্ধান্তে দেশীয় অভিজ্ঞতাকে অগ্রাধিকার দেওয়া।
কর্মকর্তাদের মতে, বাংলাদেশ ব্যাংক দেশের অর্থনীতির কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্র, সেখানে যদি প্রশাসনিক অসন্তোষ ও অবিশ্বাস জন্ম নেয়, তার কম্পন পুরো আর্থিক ব্যবস্থায় ছড়িয়ে পড়তে পারে। গভর্নর আহসান এইচ মনসুর অভিজ্ঞ অর্থনীতিবিদ, কিন্তু এখন তার সামনে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ অর্থনৈতিক নীতি নয়, প্রশাসনিক আস্থা পুনর্গঠন।