বর্তমানে নিয়োগ পাওয়া জেলা প্রশাসকরা (ডিসি) রিটার্নিং অফিসার হিসেবে আসন্ন জাতীয় নির্বাচনে দায়িত্ব পালন করবেন। গুরুত্বপূর্ণ সেই ডিসি নিয়োগের বিতর্ক কাটাতে পারেনি সরকার। এমনকি সরকারের নেওয়া সিদ্ধান্তেই অটুট থাকতে পারেনি। বিশেষ করে, বিগত তিন জাতীয় নির্বাচনে দায়িত্ব পালনকারী কোনো কর্মকর্তাকে আগামী নির্বাচনে যুক্ত রাখা হবে না, ঘোষণা দিয়েও শেষ পর্যন্ত সেই অবস্থানে থাকতে পারেনি। এতে প্রশাসনের ভিতর-বাইরে নানা সমালোচনা হচ্ছে। একই সঙ্গে ডিসি নিয়োগে কেন বারবার বিতর্ক উঠে তা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। অভিযোগ উঠেছে, সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তাদের (এআরও) ডিসি নিয়োগের পাশপাশি মাঠ প্রশাসনে অভিজ্ঞতা নেই এমন কর্মকর্তাদেরও ডিসি পদে পদায়ন করা হয়েছে। তারা সমস্যা বাড়িয়ে দেবে বলে মনে করে প্রশাসন বিশেষজ্ঞ ও সংশ্লিষ্টরা। এতে যোগ্যরা হতাশ হবেন যাতে রাষ্ট্রেরও ক্ষতি হবে যোগ করে এক জনপ্রশাসন বিশেষজ্ঞ।
বিগত ৮ ও ৯ নভেম্বর দুটি আলাদা প্রজ্ঞাপনে ২৯ ডিসিকে পদায়ন করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। এর মধ্যে ৯ জনের জেলা পরিবর্তন আর ২১ জন নতুন ডিসি নিয়োজিত হয়েছেন। জনপ্রশাসনের সূত্র জানায়, সামনে আরও নতুন ডিসির কয়েকটি জেলার আদেশ আসতে যাচ্ছে। এ কারণে বুধবার রাতেও ২৫ ও ২৭ ব্যাচের ১৫ কর্মকর্তাকে ডিসির মৌখিকে ডাকা হয়।
সরকারের পক্ষ থেকে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা ও প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম বিভিন্ন সময় বলেছেন, মাঠ প্রশাসনে বিগত তিন নির্বাচনের কাজে যুক্ত ছিলেন এমন কোনো কর্মকর্তা ডিসি, এডিসি (অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক), ইউএনওসহ বিচারিক দায়িত্বে পদায়ন করা হবে না। নূ্যূনতম ভূমিকা থাকলেও তাঁকে এই নির্বাচনে দায়িত্বে রাখা হবে না। বিশেষ করে, যারা এআরও ছিলেন তাদের বিষয়ে কঠোরভাবে পদায়ন না করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। অথচ সরকারের ডিসির প্রজ্ঞাপনে কয়েকজনের ক্ষেত্রে তার উল্টোচিত্র দেখা গেছে। এ কারণে নতুন ডিসি হিসেবে নিয়োগ পাওয়াদের মধ্যে কয়েকজনকে নিয়ে প্রশাসনের ভিতরে ক্ষোভ দেখা দিয়েছে। নতুনদের মধ্যে বিগত নির্বাচনে এআরও ছিলেন এমন দুজনকে ডিসি করা হয়েছে। প্রজ্ঞাপন পর্যালোচনা করে দেখা যায়, বিসিএস ২৫তম ও ২৭তম ব্যাচের প্রশাসন ক্যাডারের দুজন কর্মকর্তাকে ডিসি করা হয়েছে, যাঁদের একজন ২০১৪ সালের জাতীয় নির্বাচনে, অন্যজন ২০১৮ সালের জাতীয় নির্বাচনে এআরও ছিলেন। এ ছাড়াও অন্তত তিনজন কর্মকর্তা আছেন যারা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) বা অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (এডিসি) বা স্থানীয় সরকারের উপপরিচালক পদে পুরোপুরি দুই বছর দায়িত্ব পালন করেননি। অথচ জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের পদায়ন নীতিমালায় বলা আছে, ডিসি হতে হলে প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তাদের উল্লিখিত পদে দুই বছর চাকরির অভিজ্ঞতা থাকতে হবে।
এ ছাড়া প্রশাসন ক্যাডারের সঙ্গে বিলুপ্ত ইকোনমিক ক্যাডারের তিন কর্মকর্তার ডিসি হিসেবে পদায়ন নিয়েও নানা আলোচনা চলছে। কর্মকর্তারা বলছেন, ইকোনমিক ক্যাডারের কর্মকর্তাদের মাঠ প্রশাসনে (সহকারী কমিশনার, সহকারী কমিশনার (ভূমি) এসব পদে কাজের অভিজ্ঞতা ছিল না। তাঁরা সরাসরি ইউএনও, এডিসি বা স্থানীয় সরকারের উপপরিচালকের দায়িত্বে ছিলেন। ইকোনমিক ক্যাডার ২০১৮ সালে প্রশাসন ক্যাডারের সঙ্গে একীভূত হয়। কিন্তু মাঠ প্রশাসনে কাজের অভিজ্ঞতা না থেকেও ডিসি হয়েছেন। অথচ ডিসিকে ভূমি ও জেলা ম্যাজিস্ট্রেসি জানতে হয়। বিষয়টি নিয়ে চাপা ক্ষোভ বিরাজ করছে।
প্রশাসনের কর্মকর্তারা জানান, বিগত নির্বাচনের কাউকে আসন্ন নির্বাচনে না রাখার সিদ্ধান্তটি সরকারের জন্য উত্তম ছিল। কিন্তু কেন সে সিদ্ধান্তে ব্যত্যয় হলো। দুয়েকজন কর্মকর্তার জন্য এ শর্ত শিথিল করার মানে ভিতরে ভিতরে গন্ডগোলের আভাস পাওয়া যাচ্ছ। এআরও থাকা এবং মাঠের অভিজ্ঞতার শর্ত পূরণ না হলে ফিটলিস্টেই থাকার কথা নয়, অথচ ডিসি হয়ে গেছেন সেটি নিয়ে বিস্ময় প্রকাশ করেন কর্মকর্তারা। ২৫, ২৭ ব্যাচের কর্মকর্তারা বলেন, এসব ফিটলিস্ট কার্যক্রম লোক দেখানো। এখানে কোনো যোগ্যতা দেখা হয় না, কে কার লোক সেটি বিবেচনায় নিয়ে নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে। সাবেক এআরওদের এবং মাঠের অভিজ্ঞতা না থাকাদের দায়িত্ব কীভাবে পেল এ নিয়ে মন্ত্রিপরিষদ ও জনপ্রশাসনের কর্মকর্তারা মন্তব্য করতে চাননি। নাম প্রকাশ না করে একজন অতিরিক্ত সচিব বলেন, ফিটলিস্ট কার্যক্রম এসব দেখার জন্য। প্রত্যেকবার কেন এই ডিসি নিয়োগ নিয়ে এত বিতর্কের জন্ম দেবে সেটি আমাদের মাথায় আসে না।
জনপ্রশাসন বিশেষজ্ঞ আবদুল আউয়াল মজুমদার বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ডিসি সরকারের একটা গুরুত্বপূর্ণ পদ। জেলায় সব মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে সমন্বয় করতে হয়। নিরপেক্ষ ও দক্ষতা না থাকলে কাজের ক্ষেত্রেই অসুবিধা হবে।