চব্বিশ পরবর্তী নতুন রাজনৈতিক অবস্থায় আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিভিন্ন দেশে বসবাসরত প্রবাসীদের অনেকেই প্রার্থী হতে আগ্রহী হয়েছেন, এদের মধ্যে কেউ কেউ হয়তো দ্বৈত নাগরিক হিসেবে বিভিন্ন দেশে বসবাস করছেন। বিভিন্ন দলের প্রাথমিক মনোনয়নও পেয়েছেন অনেকে। কিন্তু স্বচ্ছ আইনী বিধান না থাকলে এসব প্রার্থীরা নির্বাচনে পাশ করলেও নিজ দলের প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের দ্বারা অথবা অন্য দলের প্রতিদ্বন্দ্বিদের দ্বারা নানা আইনী জটিলতায় পড়তে পারেন।
বিদ্যমান বিধিমালার অধীনে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দ্বৈত নাগরিকত্ব গ্রহণকারী বাংলাদেশীদের প্রার্থিতা সংবিধান অনুযায়ী বৈধ নয়।
সংবিধানের ৬৬(২) গ ধারা অনুযায়ী “কোন বাংলাদেশী বিদেশি রাষ্ট্রের নাগরিকত্ব অর্জন করলে বা বিদেশি রাষ্ট্রের প্রতি আনুগত্য ঘোষণা করলে” তিনি সংসদ নির্বাচনে নির্বাচিত হতে পারবেন না বা নির্বাচিত থাকবেন না।
আরপিও ১৯৭২ এর আর্টিকেল অনুসারে প্রার্থী-হিসাবে নির্বাচনে দাঁড়াতে গেলে “বিদেশি নাগরিকত্ব” আছে কি না তা বিবেচনায় নেওয়া হয়।
প্রবাসীরা দীর্ঘদিন থেকে জাতীয় নির্বাচনে প্রার্থী হতে আইনী বিধানের দাবী জানিয়ে আসছিলেন। নানা সময়ে তাদের আশ্বাসও দেয়া হয়েছে কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয়নি। চব্বিশ পরবর্তী নতুন নির্বাচনী প্রেক্ষাপটে এই দাবি বাস্তবায়িত হবে বলে আশা ছিল প্রবাসীদের।
সদ্য সমাপ্ত জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে যোগদানের ফাঁকে প্রবাসীদের সাথে এক মতবিনিময় সভায় যোগ দিয়েছিলেন প্রধান উপদেষ্টা ও উপদেষ্টামণ্ডলীর গুরুত্বপূর্ণ কয়েকজন সদস্য। প্রধান উপদেষ্টার কাছে প্রবাসীদের প্রার্থিতার বিষয়ে পরিষ্কার আইনের বিধান করার বিষয়টি তোলা হয়, উত্তরে প্রবাসীদের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন “সবই হবে, আমরা আর গ্যালারিতে বসে থাকব না, এখন থেকে নিজেরাই খেলব”। কিন্তু এখন পর্যন্ত এ ব্যাপারে কোনো আইনি পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি।
গত জাতীয় নির্বাচনে, নির্বাচন কমিশন আওয়ামী লীগের দুইজন প্রার্থী, শাম্মী আহমদ (বারিশাল-৪) ও শামীম হক (ফরিদপুর-৩) এর প্রার্থিতা বাতিল করে তাদের বিরুদ্ধে “দ্বৈত নাগরিকত্ব” থাকার অভিযোগ ছিল বলে। শামিম হক এর প্রার্থিতা বাতিলের কারণ ছিল, বাংলাদেশের পাশাপাশি তার নেদারল্যান্ডসের নাগরিকত্বও ছিল। শাম্মী আহমেদ এর অস্ট্রেলিয়ার নাগরিকত্ব রয়েছে এই অভিযোগে তার প্রার্থিতা বাতিল করা হয়।
অস্ট্রেলিয়ায় বিদেশি নাগরিকত্ব থাকায় প্রার্থী হওয়া বা নির্বাচিত হওয়া অনেকের ক্ষেত্রে নিবার্চন বাতিল হয়েছে। ভারতীয় আইন অনুযায়ী, সাধারণ মূল নীতি হলো– ভারত অন্যান্য দেশের নাগরিকত্ব মেনে নেয় না। অর্থাৎ, ভারতীয় নাগরিক হলে অন্য দেশের নাগরিক হিসেবে থাকা আইনগতভাবে অনুমোদিত নয়। ইউরোপীয় সংসদীয় গবেষণা অনুযায়ী, “দ্বৈত ইউরোপীয়/বহু দেশের নাগরিক” যাদের একাধিক সদস্য রাষ্ট্রের নাগরিকত্ব রয়েছে, তারা নির্দিষ্ট শর্তে ভোটার বা নির্বাচিত হতে পারছেন— কিন্তু সদস্য রাষ্ট্রের আইন ও নিয়ন্ত্রণ ভিন্ন ভিন্ন। ইউক্রেইন সম্প্রতি একটি আইন পাশ করেছে যেখানে “দ্বৈত নাগরিকত্ব” অনুমোদনের দিকে যাচ্ছে দেশটি।
ইউরোপের কিছু দেশে সীমিত বা পরিবর্তনশীলভাবে দ্বৈত নাগরিকত্বসহ নির্বাচনী অংশগ্রহণ সম্ভব হচ্ছে। অস্ট্রেলিয়া, ভারত ও ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের দেশগুলোসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে নানা ভিন্নতা থাকলেও বাংলাদেশের আইনে দ্বৈত নাগরিকদের সংসদ নির্বাচনে প্রার্থী হওয়া পরিষ্কার নিষিদ্ধ।
বাংলাদেশের আইনে স্পষ্ট রয়েছে, যদি কেউ “বিদেশি রাষ্ট্রের নাগরিকত্ব” লাভ করে থাকেন তাহলে তিনি (আরো কয়েকটি সাংবিধানিক পদ সহ) সংসদে নির্বাচিত হতে পারবেন না। (বাংলাদেশের সংবিধান ও আরপিও অনুযায়ী)।
আইনের সব দিক, প্রয়োজনীয় নির্দেশনাবলী ও দেশের সার্বিক স্বার্থ বিবেচনা করে বিষয়টির আশু মীমাংসা নির্বাচনের আগেই আইনগত ভাবে হওয়া দরকার যাতে প্রবাসীরা প্রতারিত না হয়। অতীতে লুকোচুরি করে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে বিজয়ী দ্বৈত নাগরিকদের নানা আইনী জটিলতায় পড়ার নজির আমাদের দেশে রয়েছে। সুতরাং বিষয়টি গুরুত্বের সাথে বিবেচনায় নেয়া উচিত।
বর্তমানে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে অভিবাসন ও অভিবাসীদের নিয়ে নানা জটিলতা চলছে সুতরাং আসন্ন নির্বাচনে অংশ নিতে আগ্রহী দ্বৈত-নাগরিক প্রবাসী প্রার্থীদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ সতর্কতা অবলম্বন করা জরুরি । অন্যথায় প্রবাসীরা তাদের দ্বৈত নাগরিকত্ব নিয়ে দেশে-বিদেশে ঝুঁকির মধ্যে পড়তে পারেন এবং কোর্ট-কাছারিতে দৌড়ঝাঁপ করে তাদের জনবল, মনোবল ও অর্থবলের অযথা অপচয় হবে।
বিডি-প্রতিদিন/সালাহ উদ্দীন/বি