মানুষের জীবনের বিভিন্ন পর্যায়ে সেসব সৎ গুণের বিকাশ ঘটে তার সবই মহানবী (সা.)-এর জীবনে বিদ্যমান ছিল। এটি শুধু বললে অবিচার হবে। তিনি ছিলেন সব মানবীয় গুণের সর্বোত্তম দৃষ্টান্ত। তাঁর পবিত্র সত্তাজুড়ে বিকশিত হয়েছিল এসব গুণ।
তিনি ছিলেন চিন্তা-ভাবনা ও মনোভাবের যথার্থতা, পারদর্শিতা ও ন্যায়পরায়ণতার উজ্জ্বল প্রতীক। রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে দান করা হয়েছিল সুষমামণ্ডিত দেহ সৌষ্ঠব, তীক্ষ বুদ্ধি, যাবতীয় জ্ঞানের পরিপূর্ণতা এবং উদ্দেশ্য সাধন ও সাফল্য লাভের নিশ্চয়তা। তিনি দীর্ঘ সময় নীরবতা অবলম্বন করে নিরবছিন্ন ধ্যান ও অনুসন্ধানে রত থাকতে এবং বিষয়ের খুঁটিনাটি সম্পর্কে সুদূরপ্রসারী চিন্তা-ভাবনার মাধ্যমে ন্যায় ও সততার উদ্ঘাটনে সক্ষম ছিলেন। তিনি তাঁর সুতীক্ষ বুদ্ধি বিবেচনা, নির্ভুল নিরীক্ষণ ও পর্যবেক্ষণ ক্ষমতার দ্বারা মানবসমাজের প্রকৃত অবস্থা, দল বা গোত্রগুলোর গতিবিধি ও মনমানসিকতা, মানুষের পারস্পরিক সম্পর্ক ইত্যাদি বিষয় অনুধাবনে করে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারতেন।
ফলে শত অন্যায়, অশালীনতা এবং অনাচার পরিবেষ্টিত সমাজে বসবাস করেও তিনি ছিলেন সব কিছুর ঊর্ধ্বে, সব কিছু থেকে মুক্ত ও পবিত্র।
মদ্যপদের সঙ্গে বসবাস করেও কোনো দিন তিনি মাদক স্পর্শ করেননি, দেব-দেবীর আস্তানায় জবাইকৃত পশুর গোশত কখনো খাননি এবং মূর্তির নামে অনুষ্ঠিত কোনো প্রকার খেলাধুলায় তিনি অংশ নেননি। তিনি জীবনের প্রথম ভাগ থেকেই তৎকালীন সমাজে প্রচলিত সব মিথ্যা উপাস্যকে ঘৃণা করতেন এবং সে ঘৃণার মাত্রা এতই অধিক ছিল যে তাঁর দৃষ্টিতে আর অন্য কোনো জিনিস এত নিন্দনীয় ও অপছন্দনীয় ছিল না।
রাসুলুল্লাহ (সা.) আল্লাহর যে বিশেষ অনুগ্রহ, নিরাপত্তা, রক্ষণাবেক্ষণ, প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে পরিচালিত ও নিয়ন্ত্রিত হয়েছেন।
ফলে যখনই পার্থিব কোনো লাভের দিকে প্রবৃত্তি আকৃষ্ট বা আকর্ষিত হয়েছে অথবা অপছন্দনীয় কিংবা অনুসরণীয় রীতিনীতি অনুসরণের প্রতি আখলাক আকৃষ্ট হয়েছে, তখন আল্লাহর প্রত্যক্ষ নিয়ন্ত্রণ সেখানে প্রতিবন্ধক হয়ে উঠেছে। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘আইয়ামে জাহেলিয়াতের লোকেরা যেসব কাজ করেছে দুইবার ছাড়া আর কখনো সে ব্যাপারে আমার খেয়াল জাগেনি। কিন্তু সে দুইবারই আল্লাহ তাআলা আমার এবং সে কাজের মধ্যে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে দিয়েছেন। এরপর কখনো সে ব্যাপারে আমার কোনো খেয়াল জন্মায়নি। এমনকি আল্লাহ আমাকে নবুয়ত দান করেন।
ঘটনা ছিল, যে বালকের সঙ্গে আমি মক্কার উপকণ্ঠে ছাগল চরাতাম এক রাতে তাকে বললাম, তুমি আমার ছাগলগুলো একটু দেখাশোনা কোরো, আমি মক্কায় যাই এবং সেখানে অন্যান্য যুবকের মতো যৌবনসংশ্লিষ্ট আবৃত্তি অনুষ্ঠানে যোগদান করি। সে বলল, ঠিক আছে। এরপর আমি বের হলাম। আমি যখন মক্কার প্রথম ঘরের কাছে ছিলাম তখন কিছু বাদ্যযন্ত্রের শব্দ কানে এলো। আমি জিজ্ঞাসা করলাম, কোথা থেকে বাদ্যযন্ত্রের শব্দ আসছে? লোকেরা বলল, অমুকের বিয়ে হচ্ছে, এটা তারই বাজনা। আমি সেই যন্ত্রসংগীত শ্রবণের জন্য সেখানে বসে পড়লাম। অমনি আল্লাহর নিয়ন্ত্রণ আমার শ্রবণশক্তির ওপর আরোপিত হলো। তিনি আমার কর্ণের কাজ বন্ধ করে দিলেন এবং আমি সেখানে শুয়ে পড়লাম। তারপর সূর্যের তাপে আমার ঘুম ভেঙে গেল। তার পর আমি আমার সেই সঙ্গীর কাছে গেলাম এবং তার জিজ্ঞাসার জবাবে ঘটনাটি বিস্তারিত বর্ণনা করলাম। এরপর আবার এক রাতে আমার বন্ধুর কাছে বসেছিলাম এবং মক্কায় পৌঁছে অনুরূপ ঘটনার সম্মুখীন হলাম।
নবী করিম (সা.)-এর কাজকর্ম ছিল সবচেয়ে আকর্ষণীয়, চরিত্র ছিল সর্বোত্তম এবং মহানুভবতা ছিল সর্বযুগের সবার জন্য অনুসরণ ও অনুকরণযোগ্য। মিথ্যা কখনো তাঁকে স্পর্শ করতে পারেনি। তাঁর সত্যবাদিতার জন্য তিনি এতই প্রসিদ্ধ ও প্রশংসনীয় ছিলেন যে আরবরা তাঁকে ‘আল আমিন’ বলে ডাকত।
আর-রাহিকুল মাখতুম অবলম্বনে
বিডি-প্রতিদিন/সালাহ উদ্দীন