আনোয়ার জাহিদ ছিলেন মূলত সাংবাদিক। তিনি বিভিন্ন জাতীয় দৈনিক ও প্রভাবশালী সাপ্তাহিক পত্রিকায় সাংবাদিকতা করেছেন। সেই সঙ্গে ছিলেন রাজনীতিবিদ। ছাত্রলীগের রাজনীতি দিয়ে শুরু, তারপর সংসদ সদস্য হয়েছেন, মন্ত্রী হয়েছেন এবং সর্বশেষ ছিলেন বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার উপদেষ্টা। ছিলেন সাংবাদিক ইউনিয়নের তুখোড় নেতা। অত্যন্ত সুদর্শন, পরিপাটি, প্রাজ্ঞ ব্যক্তিত্ব। খুব সুন্দর করে গুছিয়ে শুদ্ধ উচ্চারণে কথা বলতেন। একবার বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়ন এবং ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের এক যৌথসভা অনুষ্ঠিত হয়। ওই সভায় একজন সাংবাদিক নেতার বক্তব্যের জবাবে চৌকশ তীক্ষè কটাক্ষ করে আনোয়ার জাহিদ বলেছিলেন, ‘চুল পাকে প্রজ্ঞায়, দাড়ি পাকে কাটায় (শেভ করায়)।’ তাঁর সেই অর্থপূর্ণ বক্তব্যটি আজকের দিনে খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। আমাদের বর্তমান রাজনৈতিক অবস্থার দিকে তাকালে তাঁর সেই ধারালো বক্তব্যের মর্ম অনুধাবন করা যায়। দেশের রাজনীতি এখন দুুটি ধারায় প্রবাহিত। রাজনৈতিক প্রজ্ঞায় যাদের চুল পেকেছে তারা এক ধরনের রাজনীতি করার চেষ্টা করছেন। আর যাদের চুল-দাড়ি কিছুই পাকেনি, পদে পদে প্রজ্ঞার ঘাটতি প্রকাশ পাচ্ছে, যাদের আছে শুধু তারুণ্য, তারা ভিন্ন ধারায় রাজনীতি করছেন। দুই ধারার রাজনীতিতে আমজনতা খেই হারিয়ে ফেলছে। শান্তি খুঁজতে খুঁজতে আরও অশান্তি বাড়ছে। অটোপাসে যেমন শিক্ষার বারোটা বেজে গেছে, রাজনীতিতেও যদি অটোপাস ব্যবস্থা চালু হয়, তাহলে জাতির কপালে দুঃখ আছে। জনগণের কাছে পরীক্ষা দিয়ে রাজনীতিতে পাস করতে হয়। রাজনীতিতে অটোপাসের কোনো সুযোগ নেই।
১৯ জুলাই রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে জামায়াতে ইসলামী সমাবেশ করেছে। এটি একটি রাজনৈতিক শোডাউন। সাত দফা দাবি আদায়ের শোডাউন। বিশাল এ সমাবেশে প্রধান অতিথির বক্তব্য দিতে গিয়ে অসুস্থ হয়ে পড়েন দলের আমির ডা. শফিকুর রহমান। কিছুটা সুস্থবোধ করে তিনি তাঁর অসমাপ্ত বক্তব্য শেষ করেন এবং পরে দ্রুত তাঁকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। ৬৭ বছরের একজন বয়োজ্যেষ্ঠ মানুষ, প্রচণ্ড গরমে অসুস্থ হয়েছেন এটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। তিনি একজন প্রাজ্ঞ রাজনীতিবিদ। ছাত্রজীবন থেকেই সক্রিয় রাজনৈতিক কর্মী। ১৯৭৩ সালে জাসদ ছাত্রলীগের মাধ্যমে তার রাজনৈতিক জীবনের শুরু। পরে ১৯৭৭ সালে ইসলামী ছাত্রশিবিরে যুক্ত হন। তার পর থেকে ধীরে ধীরে ৫২ বছরের রাজনীতির পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে তিনি আজ জামায়াতে ইসলামীর আমির। দলের নেতা-কর্মীরা তার জন্য নিবেদিতপ্রাণ। তিনি শুধু দলের নেতা-কর্মীদের কাছেই শ্রদ্ধেয় নন, অন্য রাজনৈতিক দলের নেতারাও তাকে সমীহ করেন। তিনি একজন সজ্জন মানুষ। সদা হাস্যোজ্জ্বল। তার অসুস্থতার কথা শুনে উদ্বেগ প্রকাশ করেন বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। রাজনীতিতে তিনিও একজন পোড় খাওয়া নেতা। তার সাহসী এবং গ্রহণযোগ্য নেতৃত্বের সুবাদেই বিএনপি নেতা-কর্মীদের কাছে তিনি শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার মানুষ। তারেক রহমান অত্যন্ত বিনয়ী। প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস তারেক রহমানের বিনয় ও ব্যক্তিত্বের প্রশংসা করেছেন। একজন বয়োজ্যেষ্ঠ রাজনৈতিক নেতার অসুস্থতার খবরে তিনি শুধু বিচলিত, উদ্বিগ্নই হননি, দলের দুজন গুরুত্বপূর্ণ সিনিয়র নেতাকে হাসপাতালে পাঠিয়েছেন। বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এবং ড. আবদুল মঈন খান জামায়াত আমির ডা. শফিকুর রহমানকে দেখতে হাসপাতালে যান। বিএনপি নেতারা যখন জামায়াত আমিরকে দেখতে যান তখন হাসপাতালের কেবিনে দলটির সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার এবং নায়েবে আমির ডা. সৈয়দ আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের উপস্থিত ছিলেন। অসুস্থ আমিরকে দেখতে যাওয়ার মধ্য দিয়ে পারস্পরিক রাজনৈতিক শিষ্টাচার প্রকাশ পেল। এটাই আমাদের দেশের সংস্কৃতি।
আমিরের সঙ্গে সাক্ষাৎ শেষে মির্জা ফখরুল ইসলাম গণমাধ্যমকে বলেন, ‘বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের নির্দেশে জামায়াতের আমিরকে দেখতে এসেছি। রাজনৈতিক শিষ্টাচার হিসেবে দেখতে আসা আমাদের দায়িত্ব। রাজনৈতিক নেতারা অসুস্থ হয়ে পড়লে তাকে দেখতে যাওয়া পবিত্র দায়িত্ব বলে মনে করি। সে হিসেবে আমরা দুজন ওনার সঙ্গে দেখা করতে এসেছি। বাংলাদেশের রাজনীতির সংকটময় মুহূর্তে আমির সাহেবের সুস্থ হওয়া জরুরি।’
এ সময় জামায়াতের নায়েবে আমির সৈয়দ আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের বলেন, জামায়াতের আমিরকে বিএনপি নেতারা দেখতে আসায় তারা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছেন। জামায়াতের আমির বিএনপি চেয়ারপারসন ম্যাডাম খালেদা জিয়া এবং ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে সালাম জানিয়েছেন।
মানবতাবাদী নীতির ওপর ভিত্তি করে ল্যাটিন পাঠ্যপুস্তক ‘দ্য ভালগারিয়া’র লেখক উইলিয়াম হরম্যান বলেছেন, ‘শিষ্টাচার মানুষকে তৈরি করে।’ আমাদের রাজনীতিতে শিষ্টাচারে তৈরি এমন মানুষ দেশবাসীর কাম্য। আর সেদিন দুই দলের নেতাদের যে শিষ্টাচার, সৌজন্যবোধ, পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ দেশবাসী প্রত্যক্ষ করলেন; এর নেপথ্য কারণ রাজনীতিতে তারা সবাই প্রাজ্ঞ। রাজনীতির জ্ঞানে, অভিজ্ঞতায় তাদের চুল পেকেছে। রাজনীতির প্রজ্ঞায় যাদের চুলে পাক ধরেনি, নিয়মিত শেভ (কাটা) করার কারণে যাদের দাড়িও পাকেনি তাদের কাছ থেকে এমন শিষ্টাচার আশা করা দুরাশা ছাড়া কিছুই নয়। শত দুরাশার মাঝেও আমরা আশায় বুক বাঁধতে চাই এই ভেবে যে, বাংলাদেশ পথ হারাবে না। আমাদের মাঝে শিষ্টাচার, পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ ও সৌজন্যের সৌন্দর্যে প্রাজ্ঞ কিছু মানুষ এখনো আছেন। তারাই আমাদের অন্ধকারে পথচলার আলোর দিশা। একজন বেগম খালেদা জিয়া, একজন তারেক রহমান, একজন ডা. শফিকুর রহমান, একজন মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, একজন ড. মঈন খানের মতো মানুষ আমাদের মাঝে এখনো আছেন।
আমরা এখন ইনটেরিম ট্রেনের যাত্রী। এ ট্রেনের যাত্রা হয়েছে ২০২৪-এর ৮ আগস্ট। এর সর্বশেষ স্টেশন কোথায় এবং কতদিন লাগবে যাত্রা শেষ করতে তা কেউ জানে না। যারা ইনটেরিমে আছেন তারাও জানেন বলে মনে হচ্ছে না। তাদের না জানার কারণ হলো, তারা হলেন অনেক বেশি শিক্ষিত। তাদের জ্ঞানের পরিধি অনেক। তারা তাদের এনজিও কর্মকাণ্ডে দেশিবিদেশি অনেক পুরস্কারে পুরস্কৃত। তারা অনেক কিছু বুঝলেও এনজিও চালানো আর দেশ চালানো যে এক নয়, তা বুঝতে পারছেন না। তারা বুঝতে পারছেন না দিন যত যাচ্ছে সরকারের ইমেজ তত বেশি প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে। দেশের মানুষ তাদের কর্মকাণ্ড সন্দেহের চোখে দেখছে। তারা কি দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার প্রতিশ্রুতি রক্ষায় কাজ করছেন, নাকি গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা না করার কূটকৌশল নিয়ে ব্যস্ত আছেন? ইতোমধ্যে সরকারের ঐকমত্য কমিশন মঙ্গলবার রাজনৈতিক দলগুলোর ওপর একটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দিয়েছে। কমিশনের সহসভাপতি ড. আলী রীয়াজ ঘোষণা দিয়েছেন, একই সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী ও দলীয় প্রধানের দায়িত্ব পালন করা যাবে না। তিনি বলেছেন, অধিকাংশ রাজনৈতিক দল এ প্রস্তাবের পক্ষে মত দিলেও কিছু দল ভিন্নমত প্রকাশ করেছে। এসব দল চাইলে জাতীয় সনদে ‘নোট অব ডিসেন্ট’ আকারে তাদের আপত্তি অন্তর্ভুক্ত করতে পারবে। উল্লেখ্য, একই সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী ও দলীয় প্রধানের দায়িত্ব পালন করার পক্ষে ছিল বিএনপি ও সমমনা দলগুলো। এর বিপক্ষে ছিল জামায়াতে ইসলামী, জাতীয় নাগরিক পার্টিসহ (এনসিপি) সমমনা দলগুলো। ড. আলী রীয়াজের ঘোষণার পর দেশবাসী হয়তো বোঝার চেষ্টা করবে ঐকমত্য কমিশন নিরপেক্ষ, নাকি পক্ষপাতদুষ্ট।
একটি ভয়াবহ দুঃসংবাদে জাতি আজ শোকে নিমজ্জিত। একটি বিমান দুর্ঘটনা আমাদের কষ্টের সাগরে ভাসিয়ে দিয়েছে। ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট তৌকির ইসলাম তার জীবনটাকে ওড়াতে পারেননি। প্রিয় পিতা-মাতা, ভাই-বোন, নবপরিণীতা স্ত্রীসহ আত্মীয়স্বজনকে দুঃখের সাগরে ভাসিয়ে তিনি চলে গেলেন না-ফেরার দেশে। তিনি যে বিমানটি চালিয়েছেন, সেই বিমান বিধ্বংসে যে আরও অনেকে অকালে প্রাণ হারিয়েছেন তা তার অজানাই রয়ে গেল। কোমলমতি শিশুরা আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। অনেকে ঝলসে গেছে। প্রিয় সন্তানতুল্য শিক্ষার্থীদের বাঁচাতে গিয়ে নিজের জীবন বিসর্জন দিলেন শিক্ষিকা মাহেরীন চৌধুরী। আরও কয়েকজন শিক্ষক মৃত্যুবরণ করেছেন। কয়েকজন আছেন হাসপাতালে। যে পিতা-মাতা তাদের প্রিয় সন্তানকে হারিয়েছেন তারা শোকে পাগলপ্রায়। দগ্ধ আহত যে সন্তানরা হাসপাতালে চিকিৎসাধীন তাদের পিতা-মাতা আশায় বুক বেঁধে আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করছেন। যে মা সন্তানকে আনতে গিয়ে সন্তানসহ প্রাণ হারিয়েছেন তার পরিবার শোকে স্তব্ধ। যে শিক্ষার্থীরা আল্লাহর অশেষ রহমতে দুর্ঘটনা থেকে বেঁচে গেছে কিন্তু প্রত্যক্ষদর্শী, তারা এখন ট্রমায় আছে। উত্তরার ঘরে ঘরে এখন মাতম। সন্তানহারা, মা-হারা, শিক্ষকহারা শোকার্ত মানুষকে সান্ত্বনা দেওয়ার মতো ভাষা কারও নেই। এমন শোকে চোখের পানিও শুকিয়ে গেছে। কিন্তু উদার মানবতায় শত শত মানুষ সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। হাসপাতালগুলোতে দেখা গেছে রক্তদাতাদের দীর্ঘ লাইন। ভয়াবহ এ দুর্ঘটনাস্থলে গেছেন দুই উপদেষ্টাসহ সরকারের ঊর্ধ্বতন দায়িত্বশীল ব্যক্তিরা। বিক্ষুব্ধ ছাত্র-জনতা উপদেষ্টাদের স্কুল ক্যাম্পাসে ৯ ঘণ্টা অবরুদ্ধ করে রাখে। স্বজন হারানোর বেদনার শোকে বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে শিক্ষার্থী এবং অভিভাবকরা। পরীক্ষা নিয়ে মন্ত্রণালয়ের অবিবেচক সিদ্ধান্তে শিক্ষার্থীদের ক্ষোভে রণক্ষেত্রে পরিণত হয় বাংলাদেশ সচিবালয়।
২০২৪-এর জুলাই-আগস্ট থেকে এক বছরে জাতির কাঁধে লাশের সংখ্যা দিনদিন বাড়ছে। শোকে মুহ্যমান দেশবাসী। রক্তঝরা লাশ বা পোড়া লাশে ক্ষোভ বাড়ছে। যে পরিবারের সন্তান লাশ হয়, সে পরিবারই বুঝতে পারে তাদের কী হারিয়েছে। যারা ক্ষুব্ধ হচ্ছেন তাদের তো আর হারানোর কিছু নেই। প্রিয়জনকে হারানোর চেয়ে মূল্যবান আর কী হারানোর অবশিষ্ট থাকে। বিমান দুর্ঘটনায় এতগুলো মানুষের প্রাণহানিতে সরকারের কোনো হাত নেই। কেউ ইচ্ছা করে এমন দুর্ঘটনা কামনাও করে না। তার পরও সরকারের বিরুদ্ধে মানুষ ক্ষুব্ধ হচ্ছে। উপদেষ্টাদের অবরুদ্ধ করে রাখা হয়। সচিবালয় হয় রণক্ষেত্র। এসব ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়ার উৎস সরকারকে খুঁজতে হবে। ভেবে দেখতে হবে ছাত্র-জনতার এমন উত্তাল ক্ষোভ শুধু স্বজন হারানোর বেদনার বহিঃপ্রকাশ, নাকি অন্য কিছু। গত বছরের ৮ আগস্ট দেশবাসীর যে অকৃত্রিম ভালোবাসা নিয়ে এ সরকারের যাত্রা হয়েছিল, সেই ভালোবাসা এখনো অটুট আছে, নাকি সরকারের প্রতি জনগণের ভালোবাসার পারদ নামতে শুরু করেছে; সরকারকে তা গভীরভাবে বিবেচনায় নিয়ে বিশ্লেষণ করতে হবে।
লেখক : নির্বাহী সম্পাদক, বাংলাদেশ প্রতিদিন