মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের যে ভবনটির সামনে যুদ্ধবিমান বিধ্বস্ত হয়েছে- সেটি উত্তর-দক্ষিণে লম্বালম্বি ভবন। স্কুল শাখার প্রজেক্ট-২ নামে ওই ভবনটি দোতলা। ভবনটিতে দুটি তলা মিলিয়ে মোট ২০ রুম রয়েছে। এর মধ্যে ১৬টি ক্লাসরুম ও ৪টি শিক্ষকদের রুম। দোতলা এ ভবন থেকে বেরোনোর জন্য মাঝ বরাবর ছিল একটি মাত্র এক্সিট পয়েন্ট। এ পয়েন্টেই দোতলা সিঁড়িটি সংযুক্ত। যুদ্ধবিমানটি বিধ্বস্ত হয়ে এ সিঁড়িপথে আগুন লেগে যায়। মঙ্গলবার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটি সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, লম্বালম্বি দোতলা এ ভবনটি বদ্ধ খাঁচার মতো। নিচতলা ও ওপরের তলার বারান্দা পুরোপুরি গ্রিল দিয়ে আটকানো। প্রতিটি রুমের পেছন দিয়ে একটি করে জানালা। সেটিও গ্রিল দিয়ে আটকানো। ফলে যুদ্ধবিমান বিধ্বস্ত হয়ে যখন আগুনের সূত্রপাত হয়, তখন শিক্ষার্থীদের অনেকেই বেরোতে না পেরে অগ্নিদগ্ধ হয়। ক্ষতিগ্রস্ত ভবনটির পেছনের রাস্তায় সামনে এগোলেই মহর আলী মাদবর রোড। সেখানকার এক দোকানি জানান, তিনি শব্দ শোনার পরই দৌড়ে গিয়ে দেখেন ভবনটির সামনের দিকে আগুন। এ সময় শিক্ষার্থীরা পেছনের জানালা দিয়ে বাঁচার সহায়তা চাইলেও গ্রিল থাকায় তাৎক্ষণিক সহায়তা করতে পারেননি তিনি। পরে সেনাবাহিনী ও ফায়ার সার্ভিসের উদ্ধারকর্মীরা এসে জানালা ভেঙে শিশুদের উদ্ধার করে। ততক্ষণে অনেকে পুড়ে গেছে। ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোহাম্মদ জাহেদ কামাল বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, আমরা যখন উদ্ধার কার্যক্রম পরিচালনা করছিলাম তখন ভবনের বিকল্প কোনো এক্সিট পয়েন্ট না থাকার বিষয়টি প্রথমেই দৃষ্টিগোচর হয়েছে। আমরা বিকল্প এক্সিট পয়েন্টের খোঁজ করছিলাম। পরে উপায় না পেয়ে পেছনের জানালা ভেঙে অগ্নিদগ্ধ শিশুদের উদ্ধার করা হয়।
শিক্ষার্থীদের তথ্যমতে প্রতিটি কক্ষে ৩০ জন শিক্ষার্থী ক্লাস করত। সে হিসেবে প্রথম ও দোতলা মিলিয়ে ১৬টি শ্রেণিকক্ষে মোট শিক্ষার্থী থাকার কথা ৪৮০ জন। তবে যুদ্ধবিমানটি যখন বিধ্বস্ত হয়, তার কিছুক্ষণ আগেই স্কুলটি ছুটি হয়। ফলে কিছু শিক্ষার্থী বেরিয়ে গিয়েছিল। আবার কোচিং করার জন্য কিছু শিক্ষার্থী ভবনটিতে প্রবেশ করে থাকতে পারে। মঙ্গলবার আন্তবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর (আইএসপিআর) যে তথ্য দিয়েছে, সে অনুযায়ী বিমান বিধ্বস্তের ঘটনায় ১৬৫ জন আহতকে বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। ওইদিন পর্যন্ত মৃতের সংখ্যা ছিল ৩১ জন।
স্কুলের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, যে ভবনটির সামনে বিমানটি বিধ্বস্ত হয়- সেখানে প্রাথমিক পর্যায়ের প্রথম থেকে পঞ্চম শ্রেণির ক্লাস হতো। তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির শ্রেণিকক্ষের সামনে বিমানটি আছড়ে পড়ে। বিমানটি বিধ্বস্ত হওয়ার কিছুক্ষণ আগেই প্রাথমিক স্কুলের শিক্ষার্থীদের ছুটি হয়ে যায়। তবে তখনো ভবনে কিছু শিক্ষার্থী ছিল। এ ছাড়া প্রাথমিক স্কুল ছুটির পর ষষ্ঠ থেকে অষ্টম শ্রেণির শিক্ষার্থীরা ওই ভবনে কোচিং করত। তাদের কেউ কেউ ভবনটিতে প্রবেশ করে থাকতে পারে।
হতাহত বেশি হওয়ার ক্ষেত্রে যে বিষয়গুলো লক্ষণীয় : কাকতালীয়ভাবে যুদ্ধবিমানটি বিধ্বস্ত হয় ভবনটির মাঝামাঝি ঠিক এক্সিট পয়েন্টের মুখে। বিধ্বস্ত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আগুন ছড়িয়ে যায় সিঁড়ি, বারান্দা ও শ্রেণিকক্ষে। নিচতলা ও ওপর তলার বারান্দা গ্রিল দিয়ে আটকানো থাকায় শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের বেরিয়ে যাওয়ার কোনো সুযোগ ছিল না। বেরিয়ে যাওয়ার সিঁড়িটি ছিল যুদ্ধবিমানের ডানপাশের পাখার সামনে। ফলে আগুন ছড়িয়েছে মূলত বের হওয়ার পথে। পুরো ভবনের একটিমাত্র এক্সিট পয়েন্ট থাকায় এবং জরুরি কোনো এক্সিট পয়েন্ট না থাকায় শিক্ষার্থীরা আটকে গিয়েছিল।
আরও ক্ষতি হতে পারত : একটি যুদ্ধবিমানের যে গতি থাকে- সে হিসাবে বিধ্বস্তের পর গতির অভিমুখে যতটা ছেঁচড়ে যাওয়ার কথা, ততটা যায়নি পতিত যুদ্ধবিমানটি। এটি যেখানে বিধ্বস্ত হয়, তার পেছনে স্কুলের সংযোগ সড়ক। এ সড়ক থেকে ক্ষতিগ্রস্ত ভবনটির দূরত্ব ৩০ মিটারের মতো। এটুকু জায়গার মধ্যে বিমানটি পতিত হয়। পতিত হওয়ার পর এটি খুব বেশি সামনের দিকে না গিয়ে ভবনের এক্সিট পয়েন্টে গিয়ে আটকে যায়। শিক্ষার্থীরা জানান, ভবনের সামনে সারিবদ্ধ নারিকেল গাছ। ওই গাছে বিমানটির ডানা আটকে যাওয়ার কারণে ভবনটি বেঁচে গেছে। নয়তো ভবনের ভিতর যুদ্ধবিমানটি ঢুকে যেত। তবে নারকেল গাছের শরীরে খুব বড় আঘাতের কোনো চিহ্ন চোখে পড়েনি। এ ছাড়া ভবনের সামনে একটি লোহার দোলনা দেখা গেছে, সেটিও ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি। এ থেকে ধারণা করা যায়, যুদ্ধবিমানটি বিধ্বস্ত হওয়ার আগে গতি হারিয়ে ওপর থেকে নিচে পতিত হয়ে থাকতে পারে। আরেকটি বিষয় লক্ষণীয়, ভবনের মাঝামাঝি বিমানটি বিধ্বস্ত হলেও দেখা গেছে, দক্ষিণের চেয়ে উত্তর পাশের কক্ষগুলো বেশি পুড়েছে। সিঁড়িকোটা থেকে উত্তর দিকে অন্তত ৫টি কক্ষে আগুনের কালো ধোঁয়ার চিহ্ন দেখা গেছে। একজন প্রত্যক্ষদর্শী জানান, বর্ষা মৌসুমে বাতাস দক্ষিণ দিক থেকে উত্তর দিকে প্রবাহিত হওয়ায় আগুন ও আগুনের ধোঁয়া উত্তর দিকে বেশি ছড়াতে পারে।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটির শিক্ষার্থীরা জানায়, উত্তর দিকের কক্ষ থেকেই মাহেরীন মিস (মাহেরীন চৌধুরী) শিক্ষার্থীদের বেরিয়ে যেতে সহায়তা করেন। শিক্ষার্থীদের বাঁচাতে গিয়ে তার শরীরের প্রায় পুরোটাই আগুনে পুড়ে যায়। পরে হাসপাতালে নেওয়ার পর তাঁর মৃত্যু হয়। ক্ষতিগ্রস্ত ভবনের সামনে নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা শিক্ষার্থী দ্বীপ জানায়, এই বিল্ডিংটা অনেক আগের। স্কুল কর্তৃপক্ষের পরিকল্পনা ছিল রাস্তাটি হয়ে যাওয়ার পর এটি ভেঙে ফেলা হবে। আর ভবনটি ছিল শুধু শিশুদের জন্য, তারা যাতে বারান্দা থেকে নিচে না পড়ে যায়- নিরাপত্তার কথা ভেবেই বারান্দা গ্রিল দিয়ে আটকে দেওয়া হয়।
মঙ্গলবার সরেজমিন পরিদর্শনে গিয়ে স্কুল প্রাঙ্গণে কোনো শিক্ষক ও কর্মচারী কাউকে পাওয়া যায়নি। শিক্ষার্থীরা জানায়, দুজন উপদেষ্টা স্কুলে আসায় শিক্ষকগণ তাদের নিয়ে প্রশাসনিক কক্ষে আছেন। গতকাল মাইলস্টোন প্রাথমিক শাখার প্রধান শিক্ষক খাদিজা আক্তারের সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ করার চেষ্টা করা হলেও তিনি ফোন ধরেননি। বাংলাদেশ ইনস্টিটিউড অব প্ল্যানার্সের সভাপতি অধ্যাপক ড. আদিল মোহাম্মদ খান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, মাইলস্টোন এত বড় নামকরা একটা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, সেখানে একটি ভবনে বের হওয়ার পথ মাত্র একটা! কীভাবে সম্ভব? যেখানে শত শত শিক্ষার্থী ও শিক্ষক রয়েছে। যদি সেনাবাহিনী, ফায়ার সার্ভিসসহ সংশ্লিষ্ট সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানগুলো দ্রুত না আসত তাহলে আরও বেশি ক্ষয়ক্ষতি হতে পারত। তিনি আরও বলেন, যেহেতু এটা রাজউকের আওতাধীন এলাকায় গড়ে উঠেছে, সে কারণে খতিয়ে দেখা উচিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ভবন নির্মাণে ঠিকঠাক নেওয়া হয়েছে কি না।