সুরা বনি ইসরাইলের ৭০নং আয়াতে আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘আর আমি তো আদম সন্তানকে মর্যাদা দান করেছি, তাদের স্থলে ও সমুদ্রে চলাচলের বাহন দিয়েছি, তাদের পবিত্র বস্তু থেকে রিজিক দিয়েছি এবং আমার অনেক সৃষ্টির ওপর তাদের শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছি।’ উল্লিখিত আয়াতের মাধ্যমে জানতে পারলাম মানুষের সম্মান ও মর্যাদা স্বয়ং আল্লাহ রাব্বুল আলামিন দিয়েছেন। মানুষ সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ জাতি।
অবশ্যই আল্লাহ মানুষকে সর্বোত্তম গঠনে সৃষ্টি করেছেন। সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ এই মানুষ তার কর্ম দিয়ে অমানুষে পরিণত হয়। যেমন আপনি অসহায়কে নিজ প্রতিষ্ঠানে কাজের সুযোগ করে বেকারত্ব দূর করার মহান কাজ করলেন। সে অর্থনৈতিকভাবে সচ্ছল হলো। কিছুদিনের মধ্যে আপনি মালিক ও যাকে কাজের সুযোগ করে দিলেন সেই কর্মচারীর সঙ্গে সম্পর্কের অবনতি। এখন আপনার ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানকে ধ্বংস করে আপনাকেই ক্ষতি করতে ব্যস্ত। শুধু তা-ই নয়, রাস্তাঘাটে কম-বেশি সবাই চলাচল করে। রাস্তায় গাড়ি অ্যাক্সিডেন্ট করলে মানুষ হিসেবে উদ্ধার করাটাই স্বাভাবিক। তবে উদ্ধারে এসে আহত ও নিহত ব্যক্তিদের সহায়তার বিপরীতে গলার চেইন, কানের দুল, হাতের স্বর্ণের চুড়ি এমনকি ব্যাগে থাকা টাকা ও মোবাইল ফোন নিয়ে লুটপাট করে ছিটকে পড়ে মানুষরূপী ভয়ংকর অমানুষরা। বিপদে পড়ে টাকার জন্য হাতেপায়ে ধরা সেই ব্যক্তি টাকা পেয়ে উপকৃত হয়ে নিমেষেই ভুলে যাওয়া কি ঠিক। আপনার পাওনা টাকা আপনাকে দেবে তা-ও সময় বেঁধে দেয় তবু টালবাহানা। তাহলে আমি কেমন মানুষ হলাম। উপকারের কারণে সম্পর্ক শত্রুতে পরিণত করলাম। আমাদের চোখে এরকমও মানুষরূপী ভয়ংকার হাজারো অমানুষ রয়েছে। আমরা মানুষ হয়ে অমানুষের মতো অন্যের বিপদে পাশ কাটিয়ে চলে যাই। হাসিতামাশা বা তার বিপদে মজা নিতে থাকি। কেউ বিপদে পড়ে তার কাছে থাকা গচ্ছিত পণ্য বিক্রি করতে চাইলে আমরা পণ্যটির মূল্য নির্দিষ্ট দাম থেকে কমিয়ে দিই। কেননা সে বিপদে পড়ছে বিক্রি না করে কোথায় যাবে। অবশেষে বিপদগ্রস্ত ব্যক্তি কম দামেই তার পণ্যটি বিক্রি করে দেয়। প্রতিবেশীর ঘরে ভাত আছে কি না, খোঁজ নিই, অপেক্ষায় থাকি, কখন সে অভাবে ভিটেবাড়ি বিক্রি করবে। সেই সুযোগে কম টাকায় ক্রয় করতে পারব। এই হলো মানুষরূপী অমানুষের নিষ্ঠুরতা। অপরের সমস্যার সমাধান করে দেওয়া মুমিনের নৈতিক ও ইমানি দায়িত্ব। আল্লাহ বলেন, সৎকর্ম ও খোদাভীতিতে একে অন্যের সাহায্য কর। পাপ ও সীমা লঙ্ঘনের ব্যাপারে একে অন্যের সহায়তা কর না। আল্লাহকে ভয় কর। নিশ্চয়ই আল্লাহতায়ালা কঠোর শাস্তিদাতা (সুরা মায়েদা-২)।’
অমানুষ হওয়ার মূল কারণ আল্লাহর ভয় অন্তরে বিদ্যমান না থাকা। অতিরিক্ত লোভ ও মৃত্যুর ভয় হৃদয়ে বিদ্যমান না থাকার কারণেই আজ মানুষ অমানুষের রূপ নিচ্ছে। মানুষের প্রতি মানুষের দয়া, মায়ামমতা ও ভালোবাসা কমে গেছে। কেউ কাউকে ক্ষমা করতে রাজি নয়। গীবত, চোগলখোরি, বংশীয় গর্ব, নিজের ক্ষমতা দেখানোর জন্য ছোট বিষয়গুলোকেও বড় করে তুচ্ছতাচ্ছিল্য ঘটনাকে কেন্দ্র করে গুম এমনকি পরিবারের রোজগারের ব্যক্তিকে হত্যা করে শরীরকে টুকরো টুকরো করছে এই ভয়ংকর অমানুষরা। মানুষের মন এতটাই হিংস্র হয়েছে অন্যের স্ত্রী, সন্তান পরিবারের কথা মোটেই ভাবে না। এভাবেই মানুষ অমানুষ হয়ে মানুষকেই হত্যা করে। মানুষকে গালি দেওয়া, বদনাম করা, হিংসা করা, চোগলখোরি করা এগুলো মানুষের কাজ হতে পারে না। আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রসুল (সা.) বলেন, মানুষের মধ্যে দুই রূপধারী লোক সবচেয়ে নিকৃষ্ট। যে এ দলের কাছে আসে এক রূপ নিয়ে এবং অন্য দলের কাছে আসে আরেক রূপ নিয়ে (মুসলিম)। দুনিয়ার ওপর পরকালকে প্রাধান্য দিলেই একজন অমানুষ সত্যিকারে মানুষে পরিণত হওয়া সম্ভব। তখন সুদখোর, ঘুষখোর, ধর্ষক, সন্ত্রাসী কিছুই থাকবে না। এজন্যই আল্লাহকে ভয় ও রসুল (সা.)-কে অনুসরণ করা জরুরি। অতিরিক্ত ফরজ ও সুন্নাহ ইবাদতের পাশাপাশি জিকির, দরুদ, তওবা পাঠ করতে হবে। সদা সর্বদা আল্লাহর সৃষ্টির প্রতি দয়া ও ভালোবাসা রাখতে হবে। সত্যি বলতে হবে। কখনো মিথ্যার সঙ্গে আপস করা যাবে না। মানুষের তরে নিজের জীবনকে বিলিয়ে দিতে পারলেই একজন সত্যিকারের মানুষে পরিণত হওয়া সম্ভব। অন্যথায় পথভ্রষ্ট হয়ে অমানুষে পরিণত হতে হবে। আল্লাহ বলেন, ‘আমি অবশ্যই বহু মানুষ ও জিনকে দোজখের জন্য নির্ধারিত করেছি; কারণ তাদের অন্তর আছে, কিন্তু তারা সত্যকে উপলব্ধি করে না, তাদের চোখ থাকলেও তা দিয়ে তারা সত্যকে দেখে না, তাদের কান আছে, কিন্তু তা দিয়ে তারা সত্যবাণী শোনে না। ওরা পশুর মতো; বরং তার চেয়েও বেশি পথভ্রষ্ট; নিশ্চয়ই তারা উদাসীন’ (সুরা আরাফ-১৮৯)। আল্লাহ অনেক যত্নে আমাদের সৃষ্টি করেছেন মানুষরূপে। আমাদের নিরাপদ ও উন্নত জীবনযাপন করতে হবে। সমাজে ভয় তৈরি ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করা থেকে বিরত রাখা খুবই জরুরি। মানুষ হয়ে অমানুষের মতো কর্মকাণ্ড করলে কেউ ভালোবাসবে না।
লেখক : ইসলামি গবেষক