আমাদের দেশের ব্যাংকিং খাত নিয়ে অনেক আলোচনা-সমালোচনা থাকলেও একটি বিষয়ে ভালো অগ্রগতি আছে, তা হচ্ছে ব্যাসেল-তিনের যথাযথ বাস্তবায়ন। বাস্তবে কতটা বাস্তবায়িত হয়েছে বা এর ফলাফলই বা কেমন, সেই বিতর্কে না গিয়েও এটি অন্তত নিশ্চিত করে বলা যায় যে কাগজে-কলমে হলেও বাংলাদেশ ব্যাংক দেশের ব্যাংকিং খাতে ব্যাসেল-তিন সফলভাবে বাস্তবায়ন করতে সক্ষম হয়েছে।
ব্যাসেল-তিন অনুযায়ী দেশের ব্যাংকগুলোকে মূলধন ও ঝুঁকিভিত্তিক সম্পদের অনুপাত কমপক্ষে ১০ থেকে ১২.৫০ শতাংশের মধ্যে সংরক্ষণ করতে বলা হয় এবং তা না পারলে ব্যাংকগুলোকে দোষারোপও করা হয়। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, ব্যাসেল-তিনের যে শর্তাবলি, তা মেনে আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশের ব্যাংকের পক্ষে মূলধন ও ঝুঁকিভিত্তিক সম্পদের অনুপাত মেনে চলাও বেশ কঠিন এবং প্রায় অসম্ভব।
এর কারণ হচ্ছে, ব্যাসেল-তিনে ব্যাংকের জন্য যে ধরনের ঝুঁকিভিত্তিক সম্পদের অনুপাতে মূলধন নির্ণয়ের কাঠামো নির্ধারণ করা হয়েছে, তা মূলত উন্নত বিশ্বের ব্যাংকিং ব্যবসার ধরনের ওপর ভিত্তি করে। উন্নত বিশ্বের ব্যাংকিং কার্যক্রম এখন আর শুধু সঞ্চয় সংগ্রহ এবং ঋণদানের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। সেখানে ব্যাংকিং কার্যক্রমের পরিধি বৃদ্ধি পেয়েছে।
ব্যাংকিং খাতের মূলধন ঘাটতি এবং ব্যাসেল-তিনসম্পদ ব্যবস্থাপনা, মার্জার ও অ্যাকুইজেশন, বন্ড ইস্যু, পোর্টফলিও ব্যবস্থাপনাসহ আরো বিভিন্ন ধরনের আর্থিক কার্যক্রম ব্যাংক পরিচালনা করে থাকে।
অথচ এর ধারেকাছেও আমাদের দেশের ব্যাংকিং কার্যক্রম যেতে পারেনি। এখনো সেই সেকেলে আমলের সঞ্চয় সংগ্রহ এবং ঋণদানের মধ্যেই আমাদের দেশের ব্যাংকিং কার্যক্রম আটকে আছে। সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য পার্থক্য লক্ষ করা যায় ঋণ ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা এবং খেলাপি ঋণ সমস্যা সমাধানের ক্ষেত্রে। উন্নত বিশ্বের ব্যাংকে যেভাবে ঋণ ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা করা হয় এবং যেভাবে খেলাপি ঋণ সমস্যার সমাধান করা হয়, তার সামান্যতম অনুসরণ করা হয় না আমাদের দেশের ব্যাংকিং খাতে।
ফলে উন্নত বিশ্বের জন্য যে নীতি প্রণয়ন করা হয়েছে, তা যদি আমাদের দেশের ব্যাংকিং খাতে প্রয়োগ করা হয়, তাহলে একদিকে যেমন সেই ব্যবস্থা মেনে চলা কষ্টকর, অন্যদিকে তেমনি সেই ব্যবস্থার মাধ্যমে আমাদের মূল সমস্যার সমাধান করা যায় না।
আমাদের মতো সাধারণ মানুষ ব্যাসেল-তিনের মতো আন্তর্জাতিক মানের বিষয় নিয়ে কথা বললে অনেকেই উপহাস করতে পারেন। কিন্তু আমি নিজে উন্নত এবং উন্নয়নশীল দেশের ব্যাংকিং খাতের ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা বিভাগে কাজ করার সুবাদে পার্থক্যগুলো একেবারে কাছে থেকে দেখার সুযোগ পেয়েছি। যাঁরা আমার কথায় আস্থা রাখতে পারবেন না, তাঁদের জন্য কিছু দৃষ্টান্তের মাধ্যমে বিষয়টি তুলে ধরার চেষ্টা করছি। ধরা যাক, উন্নত বিশ্বের একটি ব্যাংক এক হাজার কোটি টাকার ঋণ বিতরণ করেছে, যার ৭০ শতাংশ বা ৭০০ কোটি টাকার ঋণের বিপরীতে অন্য কোনো ব্যাংক, আর্থিক প্রতিষ্ঠান বা ইনস্যুরেন্স কম্পানির দ্বারা ইস্যুকৃত স্ট্যান্ডবাই এলসি অতিরিক্ত জামানত হিসেবে গ্রহণ করেছে।
উল্লেখ্য, উন্নত বিশ্বে, এমনকি লাতিন আমেরিকার দেশে স্ট্যান্ডবাই এলসি অতিরিক্ত জামানত হিসেবে রেখে ঋণ প্রদান করা জনপ্রিয় পদ্ধতি। এখন এই ব্যাংকের এক হাজার কোটি টাকা ঋণের ৭০ শতাংশ অর্থাৎ ৭০০ কোটি টাকা হবে কম ঝুঁকিপূর্ণ এবং বাকি ৩০ শতাংশ অর্থাৎ ৩০০ কোটি টাকা হবে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ। এর ফলে এই ব্যাংককে মূলত ৩০০ কোটি টাকার ঝুঁকিপূর্ণ ঋণ বিবেচনায় নিয়ে ঝুঁকিভিত্তিক মূলধন নিরূপণ করতে হবে। এখন ধরা যাক, বাংলাদেশের একটি ব্যাংক এক হাজার কোটি টাকার ঋণ দিয়েছে এবং এই ঋণের বিপরীতে কিছু ল্যান্ড-প্রপার্টি জামানত রাখলেও স্ট্যান্ডবাই এলসির মাধ্যমে বেশির ভাগ ঋণ নিরাপদ করার সুযোগ নেই। ফলে একই পরিমাণ ঋণ প্রদান করলেও উন্নত বিশ্বের ব্যাংকের তুলনায় বাংলাদেশের সেই ব্যাংককে এক হাজার কোটি টাকার ঝুঁকিপূর্ণ সম্পদের ওপর ঝুঁকিভিত্তিক মূলধন নির্ণয় করতে হবে।
একইভাবে ঋণ ঝুঁকি ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে উন্নত বিশ্বের ব্যাংকের সঙ্গে আমাদের দেশের ব্যাংকের বিস্তর পার্থক্য আছে। সবেচেয়ে বেশি তারতম্য আছে খেলাপি ঋণ সমস্যা সমাধানের ক্ষেত্রে। উন্নত বিশ্বের ব্যাংকে খেলাপি ঋণ আমাদের দেশের মতো কয়েক ভাগে; যেমন— খারাপ মানের, সন্দেহভাজন এবং সবচেয়ে বেশি খারাপ (সাবস্ট্যান্ডার্ড, ডাউটফুল এবং ব্যাড) প্রভৃতি শ্রেণিতে ভাগ করে এই সমস্যা সমাধানের কোনো ব্যবস্থা নেই। সেখানে একটি ঋণ যখন খারাপ হওয়ার লক্ষণ দেখা দেয়, ঠিক তখনই সেই ঋণ ব্যাংকের সাধারণ হিসাব থেকে সরিয়ে বিশেষ হিসাবে বা আগাম সতর্ক (আর্লি ওয়ার্নিং) হিসেবে রেখে দিয়ে ঋণের অর্থ আদায়ের জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা চালানো হয়। এই সময়ে ঋণের ওপর অর্জিত সুদ কখনোই ব্যাংকের মুনাফা হিসেবে দেখানো হয় না। যদি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে ঋণটি ভালো অবস্থায় ফিরে না আসে বা এই ঋণের অর্থ আদায় না হয়, তাহলে সম্পূর্ণ ঋণ তাৎক্ষণিক অবলোপন করে ফেলা হয়। এতে ব্যাংকের মুনাফা হ্রাস পেলেও কোনো রকম প্রভিশন ঘাটতি থাকে না। মুনাফার পরিমাণ হ্রাস পেলেও ব্যাংকের ঝুঁকিপূর্ণ ঋণের পরিমাণ কম থাকে এবং ঝুঁকিভিত্তিক মূলধন সংরক্ষণেও কোনো সমস্যা হয় না।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, ব্যাংকিং খাতের এই মূলধন ঘাটতি সমাধানের উপায় কী হতে পারে। দুই অঞ্চলের দুই ধরনের ব্যাংকিং ব্যবস্থা হলেও ব্যাসেল-তিন তো আন্তর্জাতিকভাবে সবাই গ্রহণ করেছে এবং বাস্তবায়নও করে ফেলেছে। আমাদের দেশেও ব্যাসেল-তিন বাস্তবায়িত হয়েছে। আর এই ব্যাসেল-তিনের অন্যতম শর্ত হচ্ছে মূলধন ও ঝুঁকিভিত্তিক সম্পদের অনুপাত মেনে চলা। ব্যাসেল-তিন অনুযায়ী ব্যাংকগুলোকে মূলধন ও ঝুঁকিভিত্তিক সম্পদের অনুপাত ১০ থেকে ১২.৫০ শতাংশ সংরক্ষণ করতে হবে, অথচ এই অনুপাত মাত্র ৩.০৮ শতাংশে নেমে এসেছে। এই অবস্থা থেকে দ্রুত উত্তরণ ঘটাতে হবে। আসলে আমাদের দেশের ব্যাংকিং খাতে যে অবস্থা বিরাজ করছে, তাতে এখানে মূলধন সংরক্ষণের ব্যবস্থা নিশ্চিত করা বেশ কঠিন। বলা চলে প্রায় একেবারে অসম্ভব। এই মূলধন বৃদ্ধির কথা চিন্তা করে অনেকের হয়তো দিশাহারা অবস্থা হতে পারে। কিন্তু বাস্তবে এই মূলধন যেভাবেই হোক বৃদ্ধি করতে হবে। এর কোনো বিকল্প নেই। কাজটি যে কঠিন এবং একেবারে অসাধ্য সাধন করার শামিল, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। তবে একেবারে যে করা যাবে না, তেমন নয়।
কিছু কার্যকর পদক্ষেপ, বিশেষ করে গতানুগতিক ধারার বাইরে গিয়ে বেশ কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারলে এই সমস্যা অনেকটাই কাটিয়ে ওঠা সম্ভব। কী ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণ করলে এবং কিভাবে সেগুলো বাস্তবায়ন করতে পারলে দেশের ব্যাংকিং খাতের মূলধন ও ঝুঁকিভিত্তিক সম্পদের অনুপাত উন্নত বা বৃদ্ধি করা সম্ভব, তা ব্যাখ্যা করতে গেলে বিস্তারিত আলোচনার প্রয়োজন, যার সুযোগ এখানে সীমিত। তা ছাড়া কিছু বিষয় আমার আগের লেখায় সংক্ষিপ্ত আকারে উল্লেখ করেছি, তাই এখানে আর পুনরাবৃত্তির প্রয়োজন নেই। মূলকথা হচ্ছে, ব্যাংকিং খাতের মূলধন ঘাটতি একটি মারাত্মক সমস্যা, যা দীর্ঘ করার কোনো সুযোগ নেই। এই সমস্যার কারণে সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের অস্তিত্ব হুমকির মুখে, দেশের সমগ্র ব্যাংকিং খাত হুমকির মুখে এবং সর্বোপরি দেশের অর্থনীতি ক্ষতির মুখে পড়ে যাবে। তাই বিষয়টির গুরুত্ব বিবেচনায় নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক ও অর্থ মন্ত্রণালয় এ ব্যাপারে দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণ করবে—এটিই সবার প্রত্যাশা।
লেখক : সার্টিফায়েড অ্যান্টি মানি লন্ডারিং স্পেশালিস্ট ও ব্যাংকার, টরন্টো, কানাডা