ঢাকার উত্তরায় বিমান বিধ্বস্ত হওয়ার ঘটনায় মৃত্যু যেমন হয়েছে, তেমনি অনেক শিক্ষার্থী অগ্নিদগ্ধ ও গুরুতর আহত হয়েছে। আহত বা আহত না হওয়া অনেকে কাছ থেকে দেখেছে মৃত্যুর মিছিল, আগুনে পুড়তে থাকা সহপাঠী, শিক্ষিকার দেহ। ইন্টারনেটে ভেসে বেড়ানো ঘটনার ভয়াবহ স্থির ও ভিডিও চিত্র দেখছে আরো অনেক শিশু। অগ্নিদগ্ধ, আহত অনেকের শরীরের ক্ষত শুকাতে সময় লাগবে অনেক দিন।
মনের ক্ষত বয়ে বেড়াবে তার চেয়ে অনেক বেশি সময় এবং আরো অনেক বেশি শিক্ষার্থী এই এই ক্ষত নিয়ে ফিরবে, চলবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে। প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে ঘটনার সংস্পর্শে আসা প্রতিটি শিশুরই মানসিক সুস্বাস্থ্য হুমকির মুখে পড়তে পারে। তাদের মানসিক স্বাস্থ্য সুরক্ষায় অভিভাবক, শিক্ষকদের এই সময় আরো বেশি সচেতন, আরো বেশি মনোযোগী হতে হবে। দুর্ঘটনার শিকার বা প্রত্যক্ষদর্শী শিক্ষার্থীদের নানা ধরনের মানসিক সমস্যা হওয়ার ঝুঁকি রয়েছে।
এই সময় ‘অ্যাকিউট স্ট্রেস ডিসঅর্ডার’ এবং পরবর্তী সময়ে ‘পোস্ট ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিসঅর্ডার’ (সংক্ষেপে যা ‘পিটিএসডি’) হতে পারে তাদের। দুর্ঘটনার ভয়ংকর স্মৃতি ফিরে ফিরে আসতে পারে।
ধ্বংসস্তূপের ভেতর থেকে উদ্ধার পাওয়া শিক্ষার্থীরা পরবর্তী সময়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে গেলে দুর্ঘটনার সময় দেখা সহপাঠীদের আর্তচিৎকার, পোড়া বিকৃত মৃতদেহের সারি চলমান ছবির মতো চোখের সামনে ভেসে উঠতে পারে। সব সময় অনিশ্চয়তা, বিপদাশঙ্কায় তটস্থ থাকতে পারে।
ঘুমের সমস্যা, দুঃস্বপ্ন দেখা, আবেগ-অনুভূতি প্রকাশে অক্ষমতা, অমনোযোগিতা, ভুলে যাওয়া—এসব সমস্যা দেখা দিতে পারে। বন্ধু-সহপাঠী-প্রিয়জন হারানোর বেদনায় অনেকে বিষণ্নতায় আক্রান্ত হতে পারে। দুর্ঘটনার শিকার সহপাঠী বা অন্য শিশুদের রক্ষা করতে না পারার হতাশা অপরাধবোধ তৈরি করতে পারে।
শিশুদের ক্ষেত্রে, বিষণ্নতার ব্যাপারটি প্রকাশ করতে না পেরে খিটখিটে মেজাজ হতে পারে। অনেকে অতিরিক্ত উদ্বেগে আক্রান্ত হতে পারে।
কেউ কেউ আবার নিজের আবেগ-অনুভূতি প্রকাশে অক্ষম হয়ে পড়ে। অনেকে ঘটনাটির গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো ভুলে যায় অজান্তেই। সব মিলিয়ে পড়াশোনায় আগের মতো আগ্রহ বা মনোযোগ পেতে কারো কারো সমস্যা হতে পারে। ভয়, আতঙ্ক, অনিশ্চয়তা ও অসহায়ত্বের বোধ থেকে আত্মহত্যা প্রবণতার ঝুঁকি রয়েছে।
শুধু দুর্ঘটনাকবলিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরাই নয়, বিভিন্ন মাধ্যমে দুর্ঘটনার ভয়াবহ চিত্র দেখেও মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়তে পারে অনেক কোমলমতি শিশু শিক্ষার্থী। এই ঝুঁকিপূর্ণ সময় মা-বাবা বা অভিভাবকের পাশাপাশি শিক্ষক ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষ শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্য সুরক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। এ সময় দুঃখ ভারাক্রান্ত অনেক শিশুই পড়ায় পূর্ণ মনোযোগ না-ও পেতে পারে। পড়ার জন্য জোর না করে ধীরে ধীরে শিক্ষার্থীদের পড়াশোনায় মনোযোগী করে তুলতে হবে।
শ্রেণিকক্ষ আনন্দময় ও শিক্ষার্থীবান্ধব করতে হবে। শিক্ষার্থীকে তার চিন্তা-ভাবনা ও যথাযথ আবেগ প্রকাশের সুযোগ দিতে হবে। পড়াশোনার পাশাপাশি ‘এক্সট্রা কারিকুলাম’ কার্যক্রম, খেলাধুলা ও সুস্থ বিনোদনের সুযোগ তৈরি করে দিতে হবে। প্রয়োজনীয় সামাজিক সহায়তার মাধ্যমে তার নিরাপত্তাবোধ নিশ্চিত করতে হবে। মানসিক চাপ মোকাবেলা ও খাপ খাইয়ে নেওয়ার প্রশিক্ষণ দিতে হবে।
বিষণ্নতা, উদ্বেগ, পিটিএসডিসহ যেকোনো মানসিক সমস্যায় আক্রান্ত হলে মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞের শরণাপন্ন হতে হবে। আত্মহত্যা প্রতিরোধে পরিবার ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে বিশেষভাবে সতর্ক হতে হবে।
এ ছাড়া শিক্ষার্থীদের ব্যক্তিগত পর্যায়ে মানসিক সুস্বাস্থ্য বজায় রাখার জন্য অভিভাবকরা নিম্নোক্ত পদ্ধতিগুলো অনুসরণ করতে পারেন :
১. পরিবার-স্বজন ও বন্ধুদের সঙ্গে যোগাযোগ এবং সুসম্পর্ক বজায় রাখা : প্রতিদিন কিছু সময় কেবল সন্তানের জন্য রাখতে পারেন। প্রতিদিন অন্তত এক বেলার খাবার পরিবারের সবাই একসঙ্গে বসে খান। আপনার স্কুলপড়ুয়া সন্তানকে টিভি, ল্যাপটপ বন্ধ রেখে পরিবার, বন্ধু বা সহপাঠীর সঙ্গে কথা বলতে বা খেলতে উৎসাহিত করুন। খেয়াল রাখুন, সম্পর্ক গড়ে তোলা বা বজায় রাখার জন্য সে যেন কেবল সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমনির্ভর হয়ে না পড়ে।
২. শারীরিকভাবে সক্রিয় থাকা : তাকে নিয়মিত ব্যায়াম, হাঁটা বা সম্ভব হলে সাঁতার কাটায় উৎসাহ দিন। শুধু শারীরিক স্বাস্থ্য ও ফিটনেসের জন্যই নয়, মানসিক সুস্বাস্থ্যের জন্যও এই সক্রিয়তা কার্যকর। তবে ব্যায়ামের জন্য ঘণ্টার পর ঘণ্টা জিমেই কাটাতে হবে—এমনটা নয়।
৩. নতুন কিছু শেখা : নতুন যেকোনো দক্ষতা আত্মবিশ্বাস বাড়ায় এবং অন্যের সঙ্গে কার্যকর যোগাযোগে ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে পারে। শিশুকে নতুন করে শিখাতে পারেন ভিন্ন ভাষা, সংগীত, চিত্রাঙ্কন, খেলা বা দৈনন্দিন জীবনযাপনে কাজে লাগতে পারে এমন কিছু।
৪. দানশীলতা এবং পরোপকার : তার ভেতর অন্যকে সাহায্য করার মনোভাব গড়ে তুলুন। আত্মীয়-বন্ধুদের বিপদে আপনি পাশে থাকুন, তাকেও সঙ্গে রাখুন। স্বেচ্ছাসেবামূলক কাজে অংশ নিতে দিন।
এ ছাড়া মানসিক সুস্বাস্থ্যের জন্য পর্যাপ্ত সময় ঘুমাতে হবে, তবে বেশি ঘুম নয়। প্রয়োজন মতো বিশ্রাম নিতে হবে। সুষম, স্বাস্থ্যসম্মত খাবার খেতে হবে। রুটিনমাফিক শৃঙ্খলাপূর্ণ জীবনযাপন করতে হবে। এ জন্য শিশুদের ক্ষেত্রে অভিভাবকের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, কমিউনিটি অ্যান্ড সোশ্যাল সাইকিয়াট্রি বিভাগ, জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট