মানবজীবনে নানা সময় অপ্রত্যাশিতভাবেই বিপদ-আপদ বা দুর্ঘটনা নেমে আসে। কেউ দুর্ঘটনায় পড়লে চারপাশের মানুষের নানা রকম ভূমিকা দেখা যায়। সড়ক দুর্ঘটনা থেকে মাইলস্টোন ট্র্যাজেডি সবখানেই দেখা গেছে, অনেকে দুর্ঘটনায় কবলিত মানুষকে উদ্ধারে এগিয়ে না এসে নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করছেন, কেউ ছবি তুলছেন, কেউ ভিডিও করছেন। এ দৃশ্যও দেখতে হলো, বিপদে পড়া মানুষের জন্য এক বোতল পানির দাম কয়েক গুণ বাড়িয়ে দিয়েছেন কিছু ব্যবসায়ী। কোনো কোনো সিএনজি বা রিকশাচালক বিপদগ্রস্ত মানুষের জন্য ভাড়া বাড়িয়ে দিচ্ছেন। যেখানে প্রয়োজন ছিল পানির বোতল নিয়ে বিনামূল্যে বিতরণ করার, বিনা ভাড়ায় রোগীদের হাসপাতালে পৌঁছে দেওয়ার, সেখানে এই দুর্ঘটনাকবলিত মানুষের অসহায়ত্বকে কাজে লাগিয়ে টাকা হাতিয়ে নেওয়ার ধান্দা! মানবতার জন্য এর চেয়ে লজ্জার বিষয় আর কী হতে পারে! খানিকটা ‘ঘর পোড়ার মধ্যে আলু পুড়ে খাওয়া’র মতো। তারা ভুলে গেছেন, আজ আরেকজন দুর্ঘটনায় পড়েছে, কাল তিনিও পড়তে পারেন। আমাদের মনে রাখতে হবে, বিপদ-দুর্ঘটনা আমাদের জন্য আল্লাহর পক্ষ থেকে পরীক্ষা। যারা দুর্ঘটনা বা বিপদে পতিত হন, তাদের জন্য এক ধরনের পরীক্ষা আর পাশে থাকা সুস্থ ও স্বাভাবিক তাদের জন্য অন্য রকম পরীক্ষা। নিরাপদে থাকা মানুষটির পরীক্ষা হলো, তিনি বিপদগ্রস্ত মানুষের সাহায্যে এগিয়ে আসেন কি-না। যদি নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করে সামর্থ্য থাকার পরও দুর্ঘটনায় কবলিত মানুষের সাহায্যে এগিয়ে না আসেন, আল্লাহও তার বিপদে তাকে সাহায্য করবেন না। জারির ইবনে আবদুল্লাহ (রা.) থেকে বর্ণিত, রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘আল্লাহতায়ালা ওই ব্যক্তির ওপর দয়া করেন না, যে মানুষের প্রতি দয়া করে না।’ সহিহ বুখারি : ৭৩৭৬। নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করা বা ছবি-ভিডিওতে ব্যস্ত মানুষের সামান্য সহযোগিতা অনেক মানুষের প্রাণ বাঁচানোর কারণ হতে পারত। এ সময়টুকু হতে পারত আল্লাহতায়ালার সন্তুষ্টি অর্জনের মাধ্যম। কারও সামান্য কষ্টে অন্যের একটি প্রাণ বাঁচলে আল্লাহ তাকে পৃথিবীর সব মানুষকে বাঁচানোর সওয়াব দান করবেন। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘...আর যে ব্যক্তি কোনো ব্যক্তিকে রক্ষা করল, সে যেন সব মানুষকে রক্ষা করল;...’ সুরা মায়িদা : ৩২।
উল্টো দৃশ্যও আছে, হতাহতদের জন্য রক্ত দিতে অনেকে প্রতিযোগিতা করেছেন, নিজের অ্যাম্বুলেন্স নিয়ে অনেকে দাঁড়িয়ে ছিলেন সেবা দিতে। বিপদের সময় সামর্থ্য অনুযায়ী মানুষকে উদ্ধারে এগিয়ে আসা ইসলামের দৃষ্টিতে এক মহান ইবাদত। কোনো মানুষকে একটি কষ্ট, বিপদ বা দুর্ঘটনা থেকে উদ্ধারের সামান্য চেষ্টা করাকে রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মসজিদে নববীতে এক মাস ইতিকাফ করার চেয়েও বেশি সওয়াবের কাজ বলে অভিহিত করেছেন। আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) থেকে বর্ণিত রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘আল্লাহর কাছে সবচেয়ে প্রিয় সেই ব্যক্তি যে মানুষের জন্য সবচেয়ে বেশি উপকারী।...এই মসজিদে (মসজিদে নববীতে) এক মাস ইতিকাফ করার চেয়ে কোনো মুসলিম ভাইয়ের প্রয়োজন পূরণ করা আমার কাছে বেশি পছন্দের।...’ তাবরানি : ৬০২৬। মানুষ তো অনেক পরে, একটি কুকুরের কষ্ট দূর করাও আল্লাহর পক্ষ থেকে ক্ষমা ও পুরস্কার প্রাপ্তির কারণ হয়ে যেতে পারে। এক তৃষ্ণার্ত কুকুরকে পানি পান করিয়ে তার তৃষ্ণা নিবারণের কারণে আল্লাহ এক বেশ্যা মহিলাকে ক্ষমা করে দিয়েছিলেন বলে বুখারি শরিফের হাদিসে রয়েছে।
দুর্ঘটনাগ্রস্ত মানুষটির জন্য পরীক্ষা হলো তিনি দুর্ঘটনায় পতিত হয়েও ধৈর্য ধারণ করেন কি-না। সর্বোচ্চ ধৈর্যের মাধ্যমে আল্লাহর ফায়সালা মেনে নিলে আল্লাহ তার জন্য দয়ার বিশাল পাহাড় নিয়ে হাজির হবেন। অনেক পিতামাতার বুক খালি হয়ে গেছে। যে সন্তানটির জন্য মা খাবার রান্না করে অপেক্ষা করছিলেন, সে ফিরল লাশ হয়ে। শিশু সন্তান হারানো পিতামাতার জন্য এক বড় সান্ত্বনার বাণী দিয়েছেন রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। তিনি ওই পিতামাতা জন্য জান্নাতে ‘বাইতুল হামদ’ নামক প্রাসাদের ঘোষণা করেছেন। আবু মুসা আশআরি (রা.) থেকে বর্ণিত, রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘যখন কারও সন্তান মারা যায়, তখন আল্লাহতায়ালা ফেরেশতাদের ডেকে বলেন, ‘তোমরা আমার বান্দার সন্তানের কলিজার টুকরার জান কবজ করে ফেলেছ?’ তারা বলেন, ‘হ্যাঁ’। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘আমার বান্দা কি বলেছে?’ তারা বলেন, ‘আপনার বান্দা এই বিপদেও ধৈর্য ধারণ করে আপনার প্রশংসা করেছে এবং ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন পড়েছে।’ তখন আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘তোমরা আমার এই বান্দার জন্য জান্নাতে একটি প্রাসাদ নির্মাণ করো এবং তার নামকরণ করো ‘বাইতুল হামদ’, অর্থাৎ প্রশংসার ঘর।’ তিরমিজি : ১০২১।
লেখক : খতিব, বাইতুশ শফীক মসজিদ ও পরিচালক, বাইতুল হিকমাহ একাডেমি, গাজীপুর