হইহুল্লোড়ে সারাক্ষণ বাড়ি মাতিয়ে রাখত ছোট্ট মাহতাব। বাবা-মা, চাচা-চাচি, ফুপু আর বোনদের চোখের মণি ছিল সে। রাজধানীর উত্তরায় মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে বিমান দুর্ঘটনায় শরীরের ৮৫ শতাংশ পুড়ে গেছে সপ্তম শ্রেণির ছাত্র মাহতাবের। শ্বাসনালি পুড়ে যাওয়ায় মেকানিক্যাল ভেন্টিলেশনে রাখা হয়েছে তাকে। ছেলের এ অবস্থা দেখে আইসিইউ থেকে বেরিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন মাহতাবের বাবা। জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে চিকিৎসাধীন বিমান দুর্ঘটনায় আগুনে ঝলসে যাওয়া আট শিশুর অবস্থা সংকটাপন্ন বলে গতকাল জানিয়েছেন চিকিৎসকরা। আইসিইউতে জীবনমৃত্যুর সন্ধিক্ষণে শিশুরা। আর বাইরে অপেক্ষার প্রহর গুনছেন স্বজনরা। কেউ নামাজ পড়ছেন কেউবা দোয়া-দরুদ পড়ে সন্তানের প্রাণভিক্ষা চাইছেন সৃষ্টিকর্তার কাছে।
আইসিইউতে চিকিৎসাধীন রয়েছে সপ্তম শ্রেণির ছাত্র আবদুল মাকিন। ৬৮ শতাংশ পুড়ে গেছে তার শরীর। আইসিইউর সামনে করিডরে চাদর বিছিয়ে বসে আছেন মাকিনের বাবা। পাশেই জায়নামাজ বিছিয়ে নামাজ পড়ছিলেন মা। নামাজ শেষে কান্নায় ভেঙে পড়েন তিনি। তাকে সান্ত্বনা দিতে দেখা যায় অন্য স্বজনদের। উত্তরার মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের সপ্তম শ্রেণির শিক্ষার্থী সাইমুন। বিমান দুর্ঘটনার সময় মাঠেই ছিল সে। চারদিকে আগুন ছড়িয়ে পড়লে আহতদের উদ্ধারে ছুটে যায় সে। আগুন-ধোঁয়ার মধ্য থেকে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বের করে আনে বেশ কয়েকজন শিক্ষার্থীকে। কিন্তু ধোঁয়া-গরমে অসুস্থ হয়ে পড়ে সাইমুন। উত্তরার একটি বেসরকারি হাসপাতালে প্রাথমিক চিকিৎসায় সুস্থ না হলে বার্ন ইনস্টিটিউটের আইসিইউতে নেওয়া হয় তাকে। তার বাবা জানান, আগুনে শরীর না পুড়লেও প্যানিক অ্যাটাক হওয়ায় আইসিইউতে নেওয়া হয়েছে সাইমুনকে। সন্তানের দুশ্চিন্তায় চতুর্থ তলায় আইসিইউর সামনের করিডরে পায়চারি করছিলেন তিনি। হাসপাতালের পঞ্চম তলার ৫২০ নম্বর পোস্ট অপারেটিভ রুমে চলছে বিমান দুর্ঘটনায় আহতদের চিকিৎসা। দুপুরের দিকে ড্রেসিং চলছিল শিশুদের। শিশুদের কান্না আর গগনবিদারী চিৎকারে বাইরে অপেক্ষমাণ স্বজনদের চোখ দিয়ে অঝোরে পানি ঝরছিল। অষ্টম শ্রেণির শিক্ষার্থী রাইয়ানের শরীরের ১৮ শতাংশ পুড়ে গেছে। রাইয়ানের ফুপু বলেন, রাইয়ানের শরীরে আগুন এসে পড়লে সে ঘাসের মধ্যে গড়াগড়ি করছিল। উদ্ধারকারীরা তাকে উত্তরার লুবানা জেনারেল হাসপাতালে নিয়ে আসে। সে চিকিৎসকদের তার মায়ের নম্বর বলতে পেরেছিল। চিকিৎসকদের ফোন পেয়ে ওর মা লুবানা হাসপাতালে ছুটে যান। সেখান থেকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসাপাতালে নেওয়া হয়। এরপর বার্ন ইনস্টিটিউটে আনা হয় তাকে।
রাজধানীর উত্তরার মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে বিমান দুর্ঘটনায় দগ্ধ হয়ে জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে বর্তমানে ৪৪ জন ভর্তি আছে বলে জানিয়েছেন ইনস্টিটিউটের পরিচালক ডা. মো. নাসির উদ্দিন। গতকাল বিকালে এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, বার্ন ইনস্টিটিউটে ভর্তি ৪৪ জনের মধ্যে আটজনের অবস্থা সংকটাপন্ন, ১৩ জন আশঙ্কাজনক এবং ২৩ জন মাঝামাঝি অবস্থায় রয়েছে। দুর্ঘটনায় আহতদের চিকিৎসা পর্যবেক্ষণ করেছে সিঙ্গাপুরের চিকিৎসক প্রতিনিধিদল। গতকাল সকালে হাসপাতালে ভর্তি থাকা আহত সব রোগীর সার্বিক পরিস্থিতি এবং চিকিৎসা ব্যবস্থাপনা দেখেন তারা। এ সময় বার্ন ইনস্টিটিউটের চিকিৎসক, ঢাকার বিভিন্ন হাসপাতালের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের সঙ্গে দুর্ঘটনায় আহত রোগীদের চিকিৎসা বিষয়ে মতবিনিময় হয় তাদের। প্রতিনিধিদলে আছেন সিঙ্গাপুর জেনারেল হাসপাতালের সিনিয়র কনসালট্যান্ট ডা. চোং সি জ্যাক, সিনিয়র ডিরেক্টর বিজয়া রাও, পুন লাই কুয়ান এবং লিম ইউ হান জোভান। তারা গত মঙ্গলবার রাতে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে এসে পৌঁছান। বিমানবন্দরে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধিদল তাদের স্বাগত জানায়। সিঙ্গাপুর চিকিৎসক দলের পরামর্শ বিষয়ে বার্ন ইনস্টিটিউটের পরিচালক ডা. মো. নাসির উদ্দিন বলেন, ‘সিঙ্গাপুরের চিকিৎসকদের সঙ্গে আমরা বসেছিলাম। রোগীদের চিকিৎসায় যেসব সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে তা আমরা জানিয়েছি, তারাও মতামত দিয়েছেন। প্রতিটি রোগীর বিষয়ে আলাদাভাবে আলোচনা হয়েছে। কী ওষুধ দেওয়া হবে, কার অপারেশন লাগবে, কার ড্রেসিং পরিবর্তন হবে এসব বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। আমাদের মাল্টিডিসিপ্লিনারি বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে প্রতিনিধিদলের চিকিৎসকরা চিকিৎসা প্রটোকল নিয়ে আলোচনা করেছেন। আমরা তাদের দেওয়া মতামতগুলো রোগীদের চিকিৎসা ব্যবস্থাপনায় একীভূত করছি। শিশুদের চিকিৎসায় যে সিদ্ধান্ত ভালো হবে আমরা সেটাই গ্রহণ করব। এখানে কোনো মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্ব নেই। এই রোগীদের সার্বিক চিকিৎসা দেওয়ার সক্ষমতা আমাদের রয়েছে। রোগীদের বিদেশ নিয়ে যাওয়ার বিষয়ে কোনো পরিকল্পনা আমাদের জানা নেই।’ তিনি আরও বলেন, ‘আগুনে পোড়া রোগীদের ব্যবস্থাপনা একটি চলমান প্রক্রিয়া। ঘণ্টায় ঘণ্টায় সিদ্ধান্ত পরিবর্তন হয়। শিশু ও বৃদ্ধরা সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ। শিশুদের জন্য আলাদা চিকিৎসা পদ্ধতি অনুসরণ করা হচ্ছে। প্রতিটি রোগীকে ১২ ঘণ্টা পর পর পুনরায় মূল্যায়ন করা হবে এবং সেই মোতাবেক সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। ওষুধ ও যাবতীয় চিকিৎসা উপকরণ পর্যাপ্ত রয়েছে বলে জানান তিনি।’ তবু চিকিৎসকদের হাজারো চেষ্টা ব্যর্থ করে বাবা-মা, স্বজনদের চোখের পানিতে ভাসিয়ে মৃত্যুর কাছে হেরে যাচ্ছে ছোট্ট প্রাণ। গত মঙ্গলবার রাত সোয়া ১২টার দিকে নিভে যায় নাফি আশরাফের (৯) জীবনপ্রদীপ। এর আগে সোমবার রাত আড়াইটার দিকে মৃত্যু হয় তার বড় বোন তাহিয়া আশরাফ নাজিয়ার (১৩)। ভাই-বোন দুজনই উত্তরা মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের শিক্ষার্থী ছিল। নাজিয়া তৃতীয় শ্রেণিতে এবং নাফি প্রথম শ্রেণিতে পড়ত। গতকাল সন্ধ্যা ৭টা ১৫ মিনিটে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয় থেকে জানানো হয়, উত্তরার মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে বিমান দুর্ঘটনায় ২৯ জনের মৃত্যু হয়েছে। বর্তমানে ঢাকার ৯টি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছে ৫৭ জন।