২০২৫-এর মার্চ মাস এমনভাবে অতিবাহিত হচ্ছে, যেন বাংলাদেশের ইতিহাসে মার্চ মাস বলে কিছু ছিল না এবং এখনো নেই। ১৯৭০ সালের পাকিস্তান জাতীয় পরিষদ নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠ পক্ষের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর না করার দুরভিসন্ধির পরিণতি ছিল ১৯৭১ সালের রক্তাক্ত মার্চ, যা ৩ মার্চ ঢাকায় জাতীয় পরিষদের অধিবেশন শুরুর সব প্রস্তুতি সম্পন্ন করা সত্ত্বেও ১ মার্চ প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান কর্তৃক অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত ঘোষণা। তার এ ঘোষণা তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানজুড়ে বিদ্রোহের আগুন ছড়িয়ে দেয়, যার প্রথম শিকারে পরিণত হয় বিহারিদের মালিকানাধীন দোকানপাটসহ সব ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ভেঙে পড়ে এবং প্রশাসনসহ সবকিছুর নিয়ন্ত্রণ আওয়ামী লীগের হাতে চলে যায়। ৩ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলায় ছাত্রনেতারা বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেন এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ করা হয়। ছাত্রনেতাদের এ উদ্যোগের মুখ্য কারণ ছিল, তারা ধারণা করেছিলেন, শেখ মুজিব যদি ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে আলোচনায় বসেন, তাহলে সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানে যে বিপ্লবী গণজাগরণ সৃষ্টি হয়েছে তা স্তিমিত হয়ে যেতে পারে।
শেখ মুজিবুর রহমান সরাসরি স্বাধীনতা ঘোষণার দিকে না গিয়ে অহিংস অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দেন। ৩ মার্চ যেহেতু জাতীয় পরিষদের অধিবেশন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা ছিল, সেই দিনটিকে জাতীয় শোক দিবস হিসেবে পালন করা হয়। ৭ মার্চ শেখ মুজিব রেসকোর্স ময়দানের ভাষণে সেনাবাহিনী প্রত্যাহার ও ক্ষমতা হস্তান্তরের দাবি জানান। তিনি ভাষণ শেষ করেন- ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ পরে ১৯৭২ সালে দেশে ফেরার পর ১৯৭১ সালের ৭ মার্চের সমাবেশে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা না দেওয়ার কারণ সম্পর্কে ব্রিটিশ সাংবাদিক ডেভিড ফ্রস্টকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘আমি বিশেষ করে ওই দিনে বাংলাদেশকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে ঘোষণা করতে চাইনি। আমি তখন তাদের এ কথা বলতে দেওয়ার সুযোগ দিতে চাইনি যে, মুজিবুর রহমান স্বাধীনতা ঘোষণা করেছে এবং আমাদের জন্য পাল্টা আঘাত হানা ছাড়া বিকল্প নেই। আমি চেয়েছিলাম, তারাই আমাদের ওপর প্রথম আঘাত করুক।’
মার্কিন দূতাবাসের কমিউনিকেশনেও এর সমর্থন পাওয়া যায় : ‘মুজিব বেশ কজন বিদেশি সাংবাদিকের কাছে “অব দ্য রেকর্ড” স্বীকার করেছেন যে, তিনি রবিবার (৭ মার্চ) স্বাধীনতার সমপর্যায়ের কিছু ঘোষণা করবেন। তবে তিনি এ কথা বলেন যে, পূর্ব ও পশ্চিম অংশের উচিত তাদের নিজ নিজ সংবিধান রচনা করা এবং এরপর উভয় অংশের মধ্যে যোগসূত্র রক্ষার বিষয় নিয়ে আলোচনা হতে পারে। পাকিস্তান এয়ারফোর্সের অন্তত একটি সি-১৩০ বিমানকে ঢাকায় আসতে দেখা যায় এবং নিয়মিত খবর আসছিল যে, পাকিস্তানের কমার্শিয়াল এয়ারলাইনসে সৈন্যদের ঢাকায় আনা হচ্ছে এবং পশ্চিম পাকিস্তান থেকে জাহাজযোগেও সৈন্য আনা হচ্ছে। জানা গেছে, সামরিক বাহিনীর কিছু ব্যক্তির পক্ষ থেকে চাপ ছিল পূর্ব পাকিস্তানি নেতাদের বিরুদ্ধে দ্রুত দমনমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করে প্রদেশের অবশিষ্ট অংশে ভীতিসঞ্চার করা।’
সারা দেশে যেভাবে বিক্ষোভ দানা বেঁধে উঠেছিল তা দমনের জন্য পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছিল মার্চের আগেই। পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার শক্তিপ্রয়োগের নির্দেশ দিলেও পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর রিয়ার অ্যাডমিরাল এস এম আহসান জনগণের ওপর গুলিবর্ষণ করার বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহণ করেন। তাঁকে গভর্নর পদ থেকে অপসারণ করে লে. জেনারেল সাহেবজাদা ইয়াকুব খানকে গভর্নর নিয়োগ করা হয়। তিনিও নিরস্ত্র জনগণের বিরুদ্ধে সামরিক পদক্ষেপের বিরোধী ছিলেন। তাকে গভর্নর হিসেবে নিয়োগ করার আগেও তিনি ১৯৭১ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি রাওয়ালপিন্ডিতে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান প্রদেশগুলোর গভর্নর ও সামরিক আইন প্রশাসকদের বৈঠক আহ্বান করে অনির্দিষ্টকালের জন্য জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত করা এবং পূর্ব পাকিস্তানে বিশৃঙ্খলা দমনে শক্তিপ্রয়োগের নির্দেশ দিলে গভর্নর আহসান ও সামরিক আইন প্রশাসক ইয়াকুব খান বৈঠক শেষে পৃথক আলোচনায় শক্তিপ্রয়োগের বিপর্যয়কর পরিণতির কথা বিবেচনা করে শক্তিপ্রয়োগে তাদের আপত্তির কথা প্রেসিডেন্টকে লিখিতভাবে জানানোর সিদ্ধান্ত নেন।
ইয়াকুব খান তার চিঠিতে পূর্ব পাকিস্তানে দ্রুত অবনতিশীল ভয়াবহ পরিস্থিতির কথা জানিয়ে শক্তিপ্রয়োগের পরিবর্তে রাজনৈতিক সমাধানের জরুরি আবশ্যকতার কথা জানান। তিনি যুক্তি প্রদর্শন করেন যে, জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত অথবা সামরিক পদক্ষেপ গ্রহণ করা হলে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের বিদ্যমান ক্ষোভ প্রকাশ্য বিদ্রোহে রূপ নেবে এবং শেষ পর্যায়ে পূর্ব পাকিস্তানে ভারতের সামরিক হস্তক্ষেপের সুযোগ সৃষ্টি করবে। এ চিঠি পাওয়ার পর ইয়াহিয়া খান পুনরায় গভর্নর আহসান ও ইয়াকুব খানকে তলব করেন। তিনি তাদের বলেন, ‘আমি আপনাদের দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করতে পারি, যদি আপনারা মি. ভুট্টোকে সম্মত করাতে পারেন। ভুট্টোই জাতীয় পরিষদ অধিবেশন স্থগিত করার জন্য চাপ দিচ্ছেন।’
জুলফিকার আলী ভুট্টোর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে গভর্নর আহসান এবং সাহেবজাদা ইয়াকুব খান করাচি যান। ভুট্টো তাদের পরামর্শে কোনো গুরুত্ব প্রদান না করে বলেন যে, তারা বাঙালিদের পক্ষ থেকে যে সহিংস প্রতিক্রিয়ার আশঙ্কা করছেন তার কোনো ভিত্তি নেই। তিনি বলেন, ‘আওয়ামী লীগ বুর্জোয়াদের একটি দল এবং জনগণের দল নয়। এ দল গেরিলা যুদ্ধে লড়তে পারবে না। কোনো সহিংস প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হবে না।’ তারা রাওয়ালপিন্ডিতে ফিরে ইয়াহিয়া খানকে ভুট্টোর সঙ্গে তাদের আলোচনার বিষয়বস্তু অবহিত করার পর প্রেসিডেন্ট তাদের ২৭ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় ফিরে পর দিন শেখ মুজিবকে জাতীয় পরিষদ স্থগিত রাখার কথা জানাতে বলেন। ১ মার্চ এ ঘোষণা জাতীয়ভাবে করা হবে।
প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার নির্দেশমতো ১৯৭১ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যায় গভর্নর এস এম আহসান শেখ মুজিবের সঙ্গে দেখা করতে যান এবং জাতীয় পরিষদ অধিবেশন স্থগিত করার সিদ্ধান্ত সম্পর্কে জানালে উপস্থিত আওয়ামী লীগ নেতারা তাদের ক্রুদ্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন। এ পরিস্থিতিতেও শেখ মুজিব সরকারকে সহযোগিতা করতে ইচ্ছুক ছিলেন। তিনি তার ক্রুদ্ধ সহকর্মীদের রুম থেকে বের করে দিয়ে গভর্নর আহসানের সঙ্গে একান্তে আলোচনা করেন। তিনি গভর্নরকে বলেন, ‘পূর্ব পাকিস্তানে ইতোমধ্যে বিরাজমান বিস্ফোরণোন্মুখ পরিস্থিতির মধ্যে এ সিদ্ধান্তের পরিণতি হবে ভয়াবহ। আগামীকাল প্রকাশ্য ঘোষণার আগে আপনি যদি নতুন একটি তারিখ দিতে পারেন, তাহলে আমি জনতাকে নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম হব।’
গভর্নর আহসান আপ্রাণ চেষ্টা করেও ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে আর কথা বলতে পারেননি। কোনোভাবে তিনি জেনারেল হামিদকে টেলিফোনে পেয়ে তাকে অনুরোধ জানান জাতীয় পরিষদ অধিবেশনের নতুন একটি তারিখ নির্ধারণের জন্য প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে কথা বলতে। জেনারেল হামিদও গভর্নর আহসানের সঙ্গে আর কোনো যোগাযোগ করেননি। শেষ পর্যন্ত গভর্নর আহসান প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার কাছে একটি সিগন্যাল পাঠিয়ে অনুনয় করেন ‘রাতের মধ্যে নতুন তারিখ ঘোষণা করতে, কারণ “আগামীকাল” অনেক বিলম্ব হয়ে যাবে।’ কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তান থেকে কোনো সাড়া আসেনি।
১৯৭১ সালের ১ মার্চ দুপুরে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত ঘোষণা করলে সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানে যেন আগুন লেগে যায়। এ ঘোষণার প্রতিবাদে ছাত্র-শিক্ষক, আইনজীবী-বিচারক, সরকারি কর্মচারী, শ্রমিক-দোকানিসহ সমাজের সব শ্রেণির মানুষ রাস্তায় নেমে আসে। জনতা ঢাকার মতিঝিলে হোটেল পূর্বাণীর উদ্দেশে যেতে থাকে, যেখানে শেখ মুজিব তাঁর দলের জাতীয় পরিষদ সদস্যদের সঙ্গে বৈঠক করছিলেন। মেজর জেনারেল (অব.) ফজলে মুকিম তার ‘পাকিস্তান’স ক্রাইসিস ইন লিডারশিপ’ গ্রন্থে যথার্থই বলেছেন : ‘এটা স্পষ্ট ছিল যে, জনগণ এবং আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ চরম হতাশায় এমন মেজাজে ছিলেন- জনগণ জেগে উঠেছিল, তারা বক্তৃতা শোনার অবস্থায় ছিল না, তারা উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণের পক্ষে ছিল।’
পূর্ব পাকিস্তান যখন বিক্ষোভ ও প্রতিবাদে ফুঁসছিল, গভর্নর আহসান, সামরিক আইন প্রশাসক লে. জেনারেল সাহেবজাদা ইয়াকুব খান এবং পূর্ব পাকিস্তানের প্রতিরক্ষা সচিব মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী তখনো ২৮ ফেব্রুয়ারি তাদের প্রেরিত সিগন্যালের উত্তর পাওয়ার জন্য গভর্নর হাউসে অপেক্ষা করছিলেন। রাত ১০টায় গভর্নর হাউসে টেলিফোন বেজে উঠলে গভর্নর আহসান ফোন ধরেন। ফোন করেছিলেন রাওয়ালপিন্ডি জেনারেল হেডকোয়ার্টার্স থেকে লে. জেনারেল পীরজাদা। তিনি লে. জেনারেল ইয়াকুবকে চাইলে গভর্নর আহসান তাকে ফোন দেন। কয়েক মিনিট কথা বলার পর ইয়াকুব খান ফোন রেখে বলেন, ‘এখন আমি পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর।’ এমন অপমানজনকভাবে পদচ্যুত করায় রিয়ার অ্যাডমিরাল এস এম আহসান অত্যন্ত মর্মাহত ও বিব্রত হন। ইয়াহিয়া খানের ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন আহসান, তার নিশ্চিত মনে হয়েছে যে, ইয়াহিয়া খান তার সঙ্গে প্রতারণা করেছেন। সাহেবজাদা ইয়াকুব খানও দ্বিধাগ্রস্ত, তিনি কোনো কথা বলতে পারছিলেন না। তিনি তার ক্যান্টনমেন্টের আবাসে চলে যান।
পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর হিসেবে আহসান প্রদেশের পরিস্থিতি সরেজমিনে যাচাই করার জন্য প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানকে বারবার অনুরোধ জানালেও তিনি আসেননি। গভর্নরের দায়িত্ব গ্রহণ করে সাহেবজাদা ইয়াকুব খানও প্রেসিডেন্টকে পূর্ব পাকিস্তান পরিস্থিতি দেখতে আসার আমন্ত্রণ জানানোর ভুল করেন। ১৯৭১ সালের ৪ মার্চ ইয়াকুব খান রাওয়ালপিন্ডিতে লে. জেনারেল পীরজাদাকে ফোন করে বলেন, ‘প্রেসিডেন্টের সফর কর্মসূচি যদি বাস্তবায়িত না হয়, তাহলে আমার পক্ষে পদত্যাগ করা ছাড়া কোনো উপায় থাকবে না।’ ঢাকা ও রাওয়ালপিন্ডির মধ্যে ফোনে আরও বেশ কয়েক দফা কথাবার্তা হয়। ইয়াহিয়া খান ও শেখ মুজিবের মধ্যেও ফোনে কথা বলার ব্যবস্থা করা হয়। সেদিনই গভর্নর ইয়াকুবকে জানানো হয়, প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ১৫ মার্চ ঢাকায় আসতে সম্মত হয়েছেন। সেখানে উপস্থিত সবার মধ্যে স্বস্তির ভাব পরিলক্ষিত হয়। রাত ১০টায় ইয়াকুবের কাছে স্বয়ং প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ফোন করে জানান, তিনি তার সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করেছেন এবং ঢাকায় আসছেন না। ইয়াকুব তাকে অনুরোধ করা সত্ত্বেও ইয়াহিয়া খান তার সিদ্ধান্তে অটল। প্রেসিডেন্টের সঙ্গে কথা শেষ করে তিনি লে. জেনারেল পীরজাদাকে ফোন করে প্রেসিডেন্টের সঙ্গে তার আলোচনার কথা জানিয়ে বলেন, ‘মেহেরবানি করে আমার পদত্যাগের কথা প্রেসিডেন্টকে জানাবেন। আমি কাল পদত্যাগপত্র পাঠিয়ে দেব।’ গভর্নর হিসেবে লে. জেনারেল সাহেবজাদা ইয়াকুব খান মাত্র চার দিন দায়িত্ব পালন করেন।
১৯৭১ সালের ৬ মার্চ প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ঘোষণা করেন, ২৩ মার্চ জাতীয় পরিষদের অধিবেশন শুরু হবে। তিনি লে. জেনারেল ইয়াকুব খানের পরিবর্তে পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর হিসেবে লে. জেনারেল টিক্কা খানকে নিয়োগ করেন। ৭ মার্চ টিক্কা খান ঢাকায় পৌঁছে বিমানবন্দরেই ১৪ ডিভিশনের জিওসি মেজর জেনারেল খাদিম হোসেন রাজার উদ্দেশে তির্যক মন্তব্য করেন : ‘খাদিম, তোমার ডিভিশন এখানে বসে বসে কী করছে? সবকিছু কেমন তালগোল পাকিয়ে ফেলেছো!’ খাদিম তার বই ‘অ্যা স্ট্রেঞ্জার ইন মাই ওন কান্ট্রি’তে লিখেছেন, ‘তার অজ্ঞতাপূর্ণ ও অমার্জিত মন্তব্যে আমি নিজেকে ক্রুদ্ধ অনুভব করি এবং পাল্টা বলি, “এখন আপনি এখানে, শিগগিরই আপনি স্বয়ং দেখতে পাবেন।” পরদিন পূর্ব পাকিস্তান হাই কোর্টের প্রধান বিচারপতি বি এ সিদ্দিকী টিক্কা খানকে প্রদেশের গভর্নর হিসেবে শপথ গ্রহণ করাতে অস্বীকৃতি জানান। তিনি ইতোমধ্যে জেনেছেন, গভর্নর হাউসের কর্মচারীরা তাদের কর্মস্থল ত্যাগ করেছে, অতএব তাকে ক্যান্টনমেন্টেই থাকতে হয়। পূর্ব পাকিস্তান এবং প্রদেশের পরিস্থিতি সম্পর্কে টিক্কা খানের সুস্পষ্ট কোনো ধারণা ছিল না। পশ্চিম পাকিস্তান থেকে সৈন্যদের বিমানযোগে পূর্ব পাকিস্তানে আনা অব্যাহত ছিল।
ইস্টার্ন কমান্ডের প্রধান হিসেবে টিক্কা খান শুরুতে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের নির্দেশ অনুযায়ী সৈন্যদের ক্যান্টনমেন্টগুলোতে রাখতে এবং উসকানিমূলক মনে হতে পারে এমন কোনো কিছু করা থেকে বিরত থাকতে নির্দেশ দেন। সেজন্য স্টেট ব্যাংক অব পাকিস্তান, রেডিও পাকিস্তান এবং ঢাকা টেলিভিশন স্টেশনের মতো গুরুত্বপূর্ণ কিছু স্থানে প্রহরার কাজে নিয়োজিত থাকা ছাড়া ঢাকার অন্যান্য স্থান থেকে সৈন্যদের প্রত্যাহার করে ক্যান্টনমেন্টে ফিরিয়ে আনা হয়।
পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার আশা করছিল, যুক্তরাষ্ট্র তার পক্ষে থেকে পূর্ব পাকিস্তানের বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন দমনে সর্বাত্মক সহায়তা করবে। কিন্তু ইয়াহিয়া খানের সে আশা পূর্ণ হয়নি। পরবর্তী সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের ডিপার্টমেন্ট অব স্টেটের সিনিয়র রিভিউ গ্রুপের বৈঠকে সেক্রেটারি অব স্টেট হেনরি কিসিঞ্জার বলেন, ‘আমরা যে এগিয়ে যাইনি, তার আরেকটি কারণ ছিল যে, পশ্চিম পাকিস্তান অত্যন্ত সন্দিগ্ধ ছিল যে, আমরা একটি পৃথক পূর্ব পাকিস্তান রাষ্ট্রকে সমর্থন করছি। আমরা যদি ইয়াহিয়াকে বল প্রয়োগ করতে নিষেধ করি, তাহলে সেই সন্দেহে আরও ইন্ধন দেওয়া হবে।’
ভুট্টোর চাপে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান জাতীয় পরিষদ অধিবেশন স্থগিত ঘোষণা করায় পূর্ব পাকিস্তানে যে সংকট সৃষ্টি হয়েছিল, তার শান্তিপূর্ণ রাজনৈতিক সমাধান খুঁজে পাওয়ার আশার অবসান এভাবেই ঘটে। পূর্ব পাকিস্তান আর আওয়ামী লীগের ছয় দফা দাবির মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না। সারা দেশ পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে চলে গিয়েছিল। সেনাবাহিনীর বাঙালি অফিসার ও সৈনিকদের যারা পূর্ব পাকিস্তানের বিভিন্ন সেনানিবাসে ছিলেন, তাদের মধ্যেও বিদ্রোহের চেতনা স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল। পূর্ব পাকিস্তানের পূর্ণ স্বাধীনতা ঘোষণা ছিল সময়ের ব্যাপার। সে সময়ও আর দূরে ছিল না।
লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক, অনুবাদক, নিউইয়র্ক