হজরত শাহজালাল (রহ.) দক্ষিণ এশিয়া উপমহাদেশের একজন বিখ্যাত সুফি ও দরবেশ এবং মানবপ্রেমিক। এ দেশে যখন ইসলামের সুমহান বাণী তেমন পৌঁছায়নি, সে সময়ে মানুষের মাঝে ইসলামের আলো পৌঁছে দিতে হজরত শাহজালাল (রহ.)-এর আগমন ঘটে। মহান এই সুফিসম্রাট হজরত শাহজালাল (রহ.)-এর দরগাহের প্রাপ্ত ফলকলিপি সুহেলি ইয়ামেনি তথ্য মোতাবেক ৩২ বছর বয়সে ১৩০৩ খ্রিস্টাব্দে সিলেট আগমন করেন মহান এই সুফিসাধক। ১২৭১ খ্রিস্টাব্দে আরবের ইয়েমেনের কুনিয়া নামক শহরে তাঁর জন্ম। পিতা মাহমুদ বিন মোহাম্মদ ছিলেন একজন সম্মানিত ব্যক্তি। মাতাও সৈয়দ বংশীয় ছিলেন। শিশুকালেই মা এবং পাঁচ বছর বয়সে বাবাকে হারিয়ে এতিম হয়ে যান। অবশেষে মামা সৈয়দ আহমদ কবির সোহরাওয়ার্দীর বাড়িতেই শৈশব জীবন শুরু। মামা শাহজালালকে সৎ, নিষ্ঠাবান, আল্লাহর রেজামন্দি অর্জন করাসহ আধ্যাত্মিকতা লাভের শিক্ষা দেন। যার ফলে হজরত শাহজালাল (রহ.)-এর মধ্যে বিভিন্ন অলৌকিক ক্ষমতা প্রকাশ পায়। ঘুমে আচ্ছন্ন শাহজালাল (রহ.) ভারতবর্ষে ইসলাম প্রচারের স্বপ্ন দেখলে সৈয়দ আহমদ কবির স্বপ্নের ব্যাখ্যায় তাঁকে ভারতবর্ষে ইসলাম প্রচারের পরামর্শ দেন। সেই অনুযায়ী মক্কা হতে বিদায় নেন। সঙ্গে ছিলেন, হাজি ইউসুফ, হাজি খলিলসহ আরও কিছু শিষ্য। প্রথমেই নিজ বাসভূমি ইয়েমেনে আসেন। তখন অত্যাচারী রাজা বিষপানে হজরত শাহজালাল (রহ.)-কে বধ করার চেষ্টা করলে তাঁর কৌশলের কাছে রাজা পরাজিত হন। রাজার মৃত্যুর পরবর্তী সময়ে পুত্র শেখ আলি ক্ষমতায় বসেন। তবে তিনি শাহজালাল (রহ.)-এর গুণ ও কোমলমনের পরিচয় পেয়ে আসক্ত হয়ে তাঁর সফরসঙ্গী হয়ে মাটি যাচাইয়ের দায়িত্ব পেয়ে যান। এজন্যই তাঁকে চাষণী পীর বলা হয়।
হজরত শাহজালাল (রহ.) ভারতবর্ষে আসার পূর্বপর্যন্ত সমরকন্দ হতে সৈয়দ ওমর, রোমের করিমদাদ, বাগদাদ থেকে নিজাম উদ্দিন, ইরান, জাকারিয়া ও শাহ দাউদ এবং সৈয়দ মুহম্মদ প্রমুখদের সঙ্গে নেন এরপর পাঞ্জাবের মুলতান থেকে আরিফ, গুজরাটের জুনায়েদ, আজমির শরিফ এলাকার মুহম্মদ শরীফ, দাক্ষিণাত্যের সৈয়দ কাসিম, মধ্যপ্রদেশের হেলিম উদ্দীন প্রমুখও সঙ্গী হন। ধারণা করা যায়, এভাবে দিল্লি আসা পর্যন্ত শিষ্যদের সংখ্যা ছিল প্রায় ২৪০ জন। দিল্লিতে হজরত নিজামুদ্দিন আউলিয়ার সঙ্গে হজরত শাহজালাল (রহ.)-এর দেখা হয়। তিনি শাহজালালের আধ্যাত্মিক শক্তি সম্পর্কে জানতে পারেন। বিদায়মুহূর্তে নিজামুদ্দিন আউলিয়া (রহ.) এক জোড়া সুরমা রঙের কবুতর শাহজালাল (রহ.)-কে হাদিয়া দেন। বর্তমানে আমরা সুরমা রঙের যে কবুতর দেখতে পাই, তা ওই কবুতরের বংশধর। যা জালালি কবুতর নামে পরিচিত। হজরত শাহজালাল (রহ.) বিভিন্ন বিপদ ও বাধা উপক্রম করে ইসলাম প্রচারের জন্য এ দেশে আগমন করেন। নদী পারাপারে বাহন ও রাস্তায় বড় আকৃতির পাথর দিয়ে বন্ধ করা হলে জায়নামাজ বিছিয়ে নদী পার এবং মুখের কথায় পাথর সরে গিয়েছিল বলে লোকমুখে প্রচলিত। সিলেটের প্রথম মুসলমান শেখ বোরহান উদ্দিন (রহ.)-এর ওপর রাজা গৌড়গোবিন্দের অত্যাচারের পরিপ্রেক্ষিতে হজরত শাহজালাল (রহ.) ও তাঁর সফরসঙ্গী ৩৬০ আউলিয়ার সিলেট আগমন একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা। অত্যাচারী বাজার বাহিনী তিনি ধ্বংস করে দেন। ৬৯ বছর বয়সে ১৩৪০ খ্রিস্টাব্দে ইহজগৎ ত্যাগ করেন তিনি। সিলেট অঞ্চলের প্রথম ইতিহাস গ্রন্থ ‘শ্রীহট্ট দর্পণ’-এ বলা হয়েছে- হজরত শাহজালাল (রহ.) যে ছোট্ট টিলায় বাস করতেন, মৃত্যুর পর সেখানেই তাঁকে দাফন করা হয়। দাফনের পর তাঁর কবরের চারপাশে ছোট্ট দেয়াল তোলা হয়।
লেখক : ইসলামবিষয়ক গবেষক