‘ব্যালেন্স অব পাওয়ার’ বা ‘ক্ষমতার ভারসাম্য’-এর পাশাপাশি ‘ব্যালেন্স অব টেরর’ বা ‘সন্ত্রাসের ভারসাম্য’ একটি জনপ্রিয় আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক পরিভাষা। অনেকের কাছে বিষয়টি অবিশ্বাস্য মনে হলেও এটাই সত্য যে ‘সন্ত্রাসের ভারসাম্য’ই বর্তমানে বিশ্ব শান্তি বজায় রাখার ক্ষেত্রে মুখ্য ভূমিকা পালন করছে। এ ভারসাম্য থাকা চরম শত্রুভাবাপন্ন দুটি দেশ পরস্পরের বিরুদ্ধে যখনতখন যুদ্ধ শুরুর হুমকি দেওয়া সত্ত্বেও এবং সীমিত সীমান্ত সংঘর্ষে লিপ্ত হলেও শেষ পর্যন্ত সর্বাত্মক যুদ্ধে জড়িয়ে যায় না। ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে সন্ত্রাসের এ ভারসাম্য আছে বলেই গত সপ্তাহে উভয় দেশের মধ্যে সংঘটিত যুদ্ধ মাত্র চার দিন স্থায়ী হয়েছে এবং সীমিত ক্ষয়ক্ষতি স্বীকার করে উভয় দেশ যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হয়েছে। দুই দেশের মধ্যে প্রচলিত ধাঁচের যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল ১৯৪৭-৪৮ সালে, এবং এরপর ১৯৬৫ ও ১৯৭১ সালে। প্রথম দুটি যুদ্ধের ফলাফল অমীমাংসিত, কিন্তু তৃতীয় যুদ্ধ অর্থাৎ ১৯৭১ সালের যুদ্ধে পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ড ভারতের কাছে আত্মসমর্পণ করায় পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ভারতের বিজয় ছিল চূড়ান্ত। সেই যুদ্ধে পাকিস্তান ৫৬ হাজার বর্গমাইল এলাকা হারায় এবং স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অভ্যুদয় ঘটে।
১৯৪৭ সালে ভারতীয় উপমহাদেশ বিভক্ত হয়ে মুসলমানদের পৃথক রাষ্ট্র পাকিস্তান সৃষ্টি হওয়ার পর থেকে ভারত পাকিস্তানের অস্তিত্ব মেনে নিতে পারেনি। স্বাধীনতার ৭৮ বছর পেরিয়ে যাওয়ার পরও ভারতের উগ্র ধর্মীয় জাতীয়তাবাদীরা পাকিস্তানসহ সমগ্র উপমহাদেশকে পুনরায় অখণ্ড ভারতে অন্তর্ভুক্ত করার স্বপ্ন দেখে, সেই উদ্দেশ্যে প্রচার-প্রচারণা চালায় এবং একই লক্ষ্য বাস্তবায়নের জন্য কাজ করে। তারা মুসলমানদের একাংশকে বলে বহিরাগত এবং আরেক অংশকে বলে হিন্দু থেকে ধর্মান্তরিত। উগ্র জাতীয়তাবাদীরা ভারতের মুসলমানদের পুনরায় হিন্দুধর্মে ফিরে যাওয়ার জন্য তারা ‘ঘর ওয়াপসি’ বা আপন ধর্মে ফিরিয়ে নেওয়ার মতো কর্মসূচিও চালু করেছে। তাদের উগ্রতায় ভারতে বসবাসকারী মুসলমানদের যে ভোগান্তি সহ্য করতে হচ্ছে এবং যে মর্যাদাহীন অবস্থায় তাদের কাটাতে হচ্ছে, কোনো স্বাধীন দেশের নাগরিকদের এমন পরিস্থিতির শিকার হওয়ার কথা নয়। ভারত ভাঙার সব দায়ভার ভারতীয় মুসলমানদের ওপর চাপিয়ে তাদের মানবেতর অবস্থায় কাটাতে বাধ্য করছে। অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, স্বাধীন রাষ্ট্রের অস্তিত্ব মেনে নেওয়ার আন্তর্জাতিক বাধ্যবাধকতা না থাকলে ভারতের উগ্রপন্থিরা অখণ্ড ভারত থেকে খসে পড়া ভূখণ্ডগুলোর মানচিত্র বিলীন করে ফেলত।
আয়তনের দিক থেকে ভারত পাকিস্তানের চেয়ে চার গুণ বড় এবং পৃথিবীর বড় আয়তনের দেশগুলোর মধ্যে ভারতের অবস্থান অষ্টম। ভারতের জনসংখ্যা পাকিস্তানের জনসংখ্যার চেয়ে পাঁচ গুণের চেয়েও বেশি। ভারতের সশস্ত্র বাহিনীর জনবল পাকিস্তানের সামরিক জনবলের চেয়ে তিন গুণ বেশি। দুই দেশের সব সূচকের মধ্যে এ ভারসাম্যহীনতার বিশ্লেষণে যেকোনো ‘কনভেনশনাল ওয়ার’ বা প্রচলিত ধাঁচের যুদ্ধে ভারতের পক্ষে পাকিস্তানকে গিলে ফেলা কোনো ব্যাপারই নয়। পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ভারতের অভিযোগের যে দীর্ঘ ফিরিস্তি, তাতে যুদ্ধে পাকিস্তানকে নাস্তনাবুদ করে ফেলার কথা। কিন্তু ভারত যে তা করে না বা পারে না তার একটাই কারণ, ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে বিদ্যমান ‘ব্যালেন্স অব টেরর’। এ টেরর বা সন্ত্রাসে পাকিস্তানের চেয়ে ভারতের ভীতিই অধিক। ১৯৬৫ ও ১৯৭১ সালের যুদ্ধে দুই বিবদমান দেশের মধ্যে এ ভারসাম্য ছিল না। প্রচলিত যুদ্ধকৌশল প্রয়োগের মধ্যেই উভয় দেশকে সন্তুষ্ট থাকতে হয়েছে। কিন্তু এখন ভারত ও পাকিস্তান দুটিই পারমাণবিক শক্তির অধিকারী দেশ এবং এটিই তাদের বড় ধরনের যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ার বড় বাধা।
কেবল ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যেই যে ‘সন্ত্রাসের ভারসাম্য’ বজায় রয়েছে তা নয়, ১৯৪৫ সালে জাপানের হিরোশিমা ও নাগাসাকিতে যুক্তরাষ্ট্রের আণবিক বোমা ফেলার ভয়াবহতায় জাপানের আত্মসমর্পণ এবং তার দুই মিত্র জার্মানি ও ইতালির পরাজয়ের মধ্য দিয়ে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অবসান সূচিত হওয়ার পর বিগত ৮০ বছরে তদানীন্তন সোভিয়েত ইউনিয়ন ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে অনেক সময় চরম উত্তেজনাকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হলেও তা সামরিক সংঘাতে রূপ নেওয়ার পরিবর্তে মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধের মধ্য দিয়ে শেষ হয়েছে। তারা বিশ্বজুড়ে নিজ নিজ সমর্থন বলয় গড়ে তুলে মোটামুটি নিরুপদ্রব শান্তির আবহ বজায় রেখেছে। বিশ্ব সুস্পষ্টভাবে সোভিয়েত পক্ষ ও আমেরিকান পক্ষে বিভক্ত হয়ে পড়ায় কোনো কোনো ক্ষেত্রে আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা বিঘ্নিত হলেও বিগত আট দশকে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ বেধে যাওয়ার পরিস্থিতির উদ্ভব হয়নি।
ভারত ও পাকিস্তানের চিত্র ভিন্ন। পাকিস্তানকে সৃষ্টির পর থেকেই ভারতের অব্যাহত হুমকির মধ্যে কাটাতে হয়েছে এবং এখনো এই চিত্রের পরিবর্তন ঘটেনি। ফলে বোধগম্য কারণেই পাকিস্তানকে তাদের প্রয়োজনের তুলনায় অধিক সামরিক শক্তি বৃদ্ধি করতে হয়েছে। ভারত তাদের আধিপত্য ও সম্প্রসারণবাদী নীতির কারণে প্রায় প্রতিটি প্রতিবেশী রাষ্ট্রকে তাদের শত্রুতে পরিণত করেছে। আয়তন ও শক্তির দিক থেকে চীন ভারতের বড় শত্রু, যে দেশের সঙ্গে ১৯৬২ সালে গায়ে পড়ে যুদ্ধ বাধানোর বড় খেসারত দিতে হয়েছে ভারতকে। দ্বিতীয় প্রধান শত্রু পাকিস্তান। মূলত এ দুটি দেশকে বিবেচনায় রেখে ভারত তাদের সামরিক প্রস্তুতি গ্রহণ ও আধুনিকায়ন করে। ২০২৫-২৬ অর্থবছরে ভারতে সামরিক বাজেটের পরিমাণ ৮১ বিলিয়ন ডলার। গত অর্থবছরের চেয়ে ৯ দশমিক ৫ শতাংশ বেশি এবং জিডিপির ১ দশমিক ৯ শতাংশ। অন্যদিকে ২০২৫-২৬ অর্থবছরে পাকিস্তানের সামরিক খাতে বাজেটের পরিমাণ ৮ দশমিক ১৯ বিলিয়ন ডলার, যা গত বছরের তুলনায় ৭ দশমিক ৪৯ শতাংশ বেশি এবং জিডিপির ২ দশমিক ৮ শতাংশ। সামরিক খাতে ব্যয়ের দিক থেকে যুক্তরাষ্ট্র, চীন ও রাশিয়ার পরই ভারতের অবস্থান। আন্তর্জাতিক সামরিক বিশেষজ্ঞদের ধারণা, গত সপ্তাহের চার দিনের সীমিত যুদ্ধে পাকিস্তান প্রযুক্তি ও কৌশলগত দিক থেকে ভারতের চেয়ে এগিয়ে আছে। ফলে পাকিস্তানকে এ দুটি দিকে টেক্কা দিতে হলে ভারতকে অনুরূপ সামর্থ্য অর্জনের জন্য সামরিক খাতে ব্যয় বরাদ্দ আরও বৃদ্ধির বিকল্প নেই।
পাকিস্তানের সঙ্গে স্থায়ী সংঘাতপূর্ণ অবস্থা কাটাতে ভারতকেই উদ্যোগী হতে হবে। যদিও ভারতের যেকোনো দলের সরকার ক্ষমতায় থাকুক না কেন, বাস্তবতাকে অস্বীকার করে তারা তাদের দেশের যে কোনো স্থানে সংঘটিত সন্ত্রাস ও নাশকতামূলক কাজের জন্য দায়ী করে পাকিস্তানকে এবং তাদের প্রতিটি সরকারি ভাষ্যে সন্ত্রাসী গ্রুপগুলোকে পাকিস্তানের সশস্ত্র বাহিনীর ইন্টার সার্ভিস ইন্টেলিজেন্স (আইএসআই)-এর মদতপুষ্ট বলে দায়ী করে। তারা কাশ্মীরের স্বাধীনতাসংগ্রামীদের সংগঠনগুলো যারা প্রকাশ্যে জম্মু ও কাশ্মীরের, ভারত ও পাকিস্তানের অংশে তাদের স্বাধীনতার দাবিতে আন্দোলন করে, ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকে মিলিত হয়, হোয়াইট হাউসে গিয়ে কাশ্মীরের স্বাধীনতার পক্ষে যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন কামনা করে। কিন্তু কাশ্মীরে নাশকতামূলক কোনো ঘটনা ঘটলেই ভারত আঙুল তুলে পাকিস্তানের দিকে। ভারত সরকার কাশ্মীরিদের ব্যাপারে ১৯৪৭ সাল থেকে ধূর্ততা ও প্রতারণামূলক নীতি গ্রহণ করে। তারা বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধে সক্রিয় সহযোগিতা করেছে, কিন্তু কাশ্মীরসহ স্বাধীনতার জন্য সশস্ত্র সংগ্রাম দমন করতে হাজার হাজার লোককে হত্যা করেছে। এসব বিদ্রোহ দমন করতে গিয়ে ভারতের সেনাবাহিনী, আধাসামরিক বাহিনী ও পুলিশের হাজার হাজার সদস্য নিহত হয়েছেন।
ভারতের ভূমিকায় মনে হয়, বাইরের কোনো দেশ বা শক্তির সহযোগিতা ছাড়া ভারতে কোনো সন্ত্রাসী দলের অস্তিত্ব ছিল না ও নেই। তদুপরি মুসলিম ছাড়া ভারতে কেউ সন্ত্রাসী হতে পারে না। ১৯৪৮ সালের ৩০ জানুয়ারি দিল্লিতে ভারতের জাতির পিতা মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধীর হত্যাকারী নাথুরাম গডসে মুসলিম ছিলেন না। ১৯৮৪ সালের ৩১ অক্টোবর প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে দিল্লিতে তাঁর সরকারি বাসভবনে হত্যা করেছিল তাঁর দুই শিখ দেহরক্ষী বিয়ান্ত সিং ও সতওয়ান্ত সিং। তারা মুসলিম ছিলেন না। ১৯৯১ সালের ২১ মে তামিলনাড়ুতে প্রকাশ্য জনসমাবেশে আত্মঘাতী বোমায় নিহত হয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধী এবং ঘাতকসহ ১৭ ব্যক্তি। যিনি এ আত্মঘাতী বোমার বিস্ফোরণ ঘটান তার নাম কালাবানি রাজারতনাম নামে ২২ বছর বয়সি তরুণী। তিনিও মুসলিম ছিলেন না।
ভারতের অন্যতম পুরোনো সন্ত্রাসী সংগঠন গড়ে উঠেছিল চীনাপন্থি মাওবাদী কমিউনিস্ট নেতা চারু মজুমদারের নেতৃত্বে ১৯৬৭ সালে পশ্চিমবঙ্গের দার্জিলিং জেলার নকশালবাড়ি নামে এক গ্রামে। তাঁর শুরু করা আন্দোলন এখন পর্যন্ত দমন করা সম্ভব হয়নি। এ সশস্ত্র বিদ্রোহীরা বিভিন্ন সময়ে তাত্ত্বিক জটিলতায় আন্তঃসংঘর্ষে জড়িয়ে পড়লেও এখনো পশ্চিমবঙ্গ, বিহার, ওড়িশা, ঝাড়খন্ড, উত্তরাখন্ড, ছত্তিশগড়, বিহার, অন্ধ্র প্রদেশসহ আরও কয়েকটি রাজ্যের ৮০টির বেশি জেলায় শ্রেণিসংগ্রামের নামে মাওবাদী-নকশালীরা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে লড়াই করে যাচ্ছে। সাউথ এশিয়া টেররিজম পোর্টালের এক পরিসংখ্যান অনুযায়ী ২০০০ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত নকশালীদের সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ৫ হাজার ৫২০টি সংঘর্ষ ঘটেছে। এসব ঘটনায় বেসামরিক লোক নিহত হয়েছে ৪ হাজার ৪৮ জন, বিভিন্ন বাহিনীর সদস্য নিহত হয়েছে ২ হাজার ৯১ জন এবং চিহ্নিত মাওবাদী-নকশালী নিহত হয়েছে ৪ হাজার ৬১৪ জন। শনাক্ত করা যায়নি এমন লোক নিহত হয়েছে ২৫২ জন। আলজাজিরা টেলিভিশনের এক রিপোর্টে এ সশস্ত্র বিদ্রোহে ১৯৮০ থেকে ২০১১ সালের মধ্যে আনুমানিক ১০ হাজার লোক নিহত হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের সময় মাওবাদী বিদ্রোহ দমনে ভারতের আধাসামরিক বাহিনীর ৮০ হাজার সদস্যকে নিয়োগ করা হয়েছিল ‘অপারেশন গ্রিন হান্ট’ অভিযান পরিচালনায়। তাঁর মতে, ‘এই বিদ্রোহ দেশের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার প্রতি একক বৃহত্তম চ্যালেঞ্জ।’
ভারতের সবচেয়ে শক্তিশালী বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন শিখ সম্প্রদায়ের ভারতীয় পাঞ্জাবে শিখদের স্বাধীন ‘খালিস্তান’ প্রতিষ্ঠার জন্য রাজনৈতিক আন্দোলন। এ আন্দোলনের সূচনা হয়েছিল ত্রিশের দশকে এবং সত্তর ও আশির দশকে খালিস্তান আন্দোলন প্রবল হয়ে ওঠে। বেশ কিছু সংগঠন গড়ে ওঠে এ আন্দোলনকে সশস্ত্র বিদ্রোহের রূপ দেওয়ার জন্য। আশি দশকের শুরুতে জর্নাইল সিং ভিন্দ্রানওয়ালে নামে এক তরুণ শিখ নেতার অভ্যুদয়ের পর পাঞ্জাবজুড়ে খালিস্তানবিরোধী বিবেচনায় ব্যাপক হত্যাকাণ্ড শুরু করে। শুধু ১৯৮৪ সালের ছয় মাসে পাঞ্জাবে ৭৭৫টি সহিংস ঘটনায় ৪১০ জন নিহত হয়, যাদের মধ্যে ১৬৫ জন ছিলেন হিন্দু। আহত হয় ১ হাজার ১৮০ জন। ১৯৮৪ সালের অক্টোবরে শিখ বিদ্রোহীদের নির্মূল করতে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী অমৃতসরে শিখ ধর্মাবলম্বীদের পবিত্র স্থান স্বর্ণমন্দিরে ‘অপারেশন ব্লু স্টার’ নামে সামরিক অভিযান পরিচালনার আদেশ দেন। ১ থেকে ৮ অক্টোবর পর্যন্ত অভিযানে ভারী কামান ব্যবহার করা হয়। সরকারি হিসাবে এ অভিযানে ৭০০-এর বেশি ভারতীয় সৈন্য, ৪৯৩ জন শিখ বিদ্রোহী এবং ১ হাজার ৫৯২ জন বেসামরিক লোক নিহত হয়। বেসরকারি হিসাবে বেসামরিক নিহতের সংখ্যা ছিল ৫ হাজারের অধিক এবং শিখ জঙ্গি নিহত হয়েছিল ২০০ জন। এ ঘটনার তিন সপ্তাহের মধ্যে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী নিহত হন এবং এর প্রতিশোধ গ্রহণ করতে কেবল দিল্লিতেই ৩ হাজারের বেশি শিখকে হত্যা করা হয়।
কিন্তু শিখদের বিচ্ছিন্নতাবাদী অথবা স্বাধীনতার আন্দোলন বা স্বর্ণমন্দির ধ্বংস ও দিল্লিতে শিখ হত্যাযজ্ঞের পরিণতিতে ১৯৮৫ সালে ‘বাব্বর খালসা’ নামে শিখদের এক বিচ্ছিন্নতাবাদী গ্রুপের সন্দেহভাজন সদস্যরা ১৯৮৫ সালের ২৩ জুন এয়ার ইন্ডিয়ার মন্ট্রিল-লন্ডন-দিল্লি-বোম্বে রুটের একটি বিমান উড়িয়ে দেওয়ায় ৩২৯ জন যাত্রী নিহত হয়। খালিস্তানি বিদ্রোহীদের নাশকতামূলক তৎপরতায় ১৯৮৭ সালে লালরু নামে এক স্থানে ৩২ জন হিন্দু বাসযাত্রী এবং ১৯৯১ সালে লুধিয়ানায় ৮০ জন ট্রেনযাত্রী নিহত হয়। ১৯৯১ সালে নিউইয়র্ক টাইমসের অক্টোবর মাসের এক সংখ্যায় প্রকাশিত রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছিল, শিখ জঙ্গিরা দৈনিক অন্তত ২০ জন করে লোককে হত্যা করছে এবং পুলিশ অফিসারদের পরিবারের সদস্যদের গুলি করছে। ১৯৯৫ সালের ৩১ আগস্ট বাব্বর খালসার এক সদস্য আত্মঘাতী বোমা হামলা চালিয়ে পাঞ্জাবের মুখ্যমন্ত্রী বিয়ান্ত সিংকে হত্যা করেন।
ভারতে বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড ঘটেছে আসামে, সেভেন সিস্টার্স খ্যাত উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোতে। ১৯৭৯ সালে শুরু হওয়া ইউনাইটেড লিবারেশন ফ্রন্ট অব আসাম (উলফা) বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন শুরু করার পর থেকে ২০২৩ সালে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের সঙ্গে চুক্তিতে উপনীত হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত উলফা বিদ্রোহীদের হাতে বিভিন্ন বাহিনীর ৭০০ অধিক সদস্য নিহত হয়েছে। উলফা বিদ্রোহীদের সাড়ে চার হাজার সদস্যসহ ১০ হাজারের অধিক লোক নিহত হয়েছে। অপহরণের ঘটনা ঘটেছে ২ হাজারের বেশি এবং অপহৃতদের অধিকাংশের মৃত্যু ঘটেছে গুলিতে। ২০২৩ ও ২০২৪ সালে মণিপুরে দুই বিবদমান উপজাতির সংঘর্ষ এবং সশস্ত্র বাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষে ২৫৮ জন নিহত হয়েছে। গৃহহীন হয়েছে ৬০ হাজারের অধিক মণিপুরবাসী।
যদি ধরেও নেওয়া যায় যে পাকিস্তানের মদতপুষ্ট কোনো সন্ত্রাসী গ্রুপ অথবা একাধিক সন্ত্রাসী গ্রুপ কাশ্মীরে সন্ত্রাসী ও নাশকতামূলক কর্মকাণ্ড চালাচ্ছে, ভারতের অভ্যন্তরীণ বিচ্ছিন্নতাবাদী, স্বাধীনতাকামী সশস্ত্র বিদ্রোহী ও সন্ত্রাসী গ্রুপগুলোই ভারতের জন্য বেশি ক্ষতিকর। যেসব অভ্যন্তরীণ গ্রুপ ইতোমধ্যে সক্রিয়, তাদের উপদলীয় কোন্দলে অনুরূপ আরও গ্রুপ সৃষ্টি হতে পারে। শোষিত, বঞ্চিত, দলিত ও পিছিয়ে পড়া শ্রেণিগুলোর মধ্য থেকে নতুন নতুন সশস্ত্র সন্ত্রাসী গ্রুপের আবির্ভাব ঘটতে পারে। বিশ্বে শুধু ভারতই সন্ত্রাসকবলিত একমাত্র দেশ নয়। পাকিস্তান যেসব দেশের প্রতিবেশী নয়, এমন বহু দেশে সন্ত্রাসী তৎপরতা চলে। ভারতের প্রতিবেশী ও শত্রু দেশ পাকিস্তানে সশস্ত্র সন্ত্রাসী সংগঠন সৃষ্টির পটভূমি ভারতীয় নীতিনির্ধারকদের জানা থাকার কথা। আফগানিস্তান থেকে সোভিয়েত বাহিনীকে বিতাড়নে পাকিস্তানে সশস্ত্র সন্ত্রাসী তৈরিতে উৎসাহ দান থেকে শুরু করে অস্ত্র-অর্থ সরবরাহ করেছে যুক্তরাষ্ট্রসহ পাশ্চাত্যের বেশ কটি দেশ।
২০০১ সালে নিউইয়র্কে টুইন টাওয়ার ধ্বংসের পর যুক্তরাষ্ট্র তাদের সৃষ্ট আল-কায়েদার বিরুদ্ধেই অভিযান শুরু করলে সন্ত্রাসবাদের সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত দেশে পরিণত হয় পাকিস্তান। সন্ত্রাসী সংগঠনগুলো পাকিস্তানে প্রশাসনিক ও অর্থনৈতিক মেরুদণ্ড এমনভাবে ভেঙে দিয়েছে, যা কাটিয়ে উঠতে তাদের বহু যুগ লেগে যাবে। ভঙ্গুর অর্থনীতি নিয়েও পাকিস্তানের সশস্ত্র বাহিনী ভারতের মতো শক্তিশালী বৈরী প্রতিবেশীকে মোকাবিলা করার যে সাহস প্রদর্শন করে, এর একমাত্র কারণ, তারা জানে ভারতের সঙ্গে তাদের ‘সন্ত্রাসের ভারসাম্য’ আছে বলেই ভারত শত হম্বিতম্বি করেও পাকিস্তানের সঙ্গে যুদ্ধে তেমন সুবিধা করতে পারবে না, বরং ‘সন্ত্রাসের ভারসাম্য’ দুই দেশকে সর্বাত্মক যুদ্ধে লিপ্ত হওয়া থেকে বিরত রাখবে।
লেখক : যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী সিনিয়র সাংবাদিক ও অনুবাদক