বছরের পর বছর ধরে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও নিরাপত্তাজনিত সংকটে জর্জরিত পাকিস্তানে এখন চলছে যুদ্ধজয়ের আবহ। ভারতের সঙ্গে ৫০ বছরের মধ্যে সবচেয়ে বড় সামরিক সংঘাতে ‘বিজয়ের’ ঘোষণা দিয়েছে দেশটি। এই উপলক্ষে সারা দেশে সেনাবাহিনীর পক্ষে র্যালি, মিছিল ও পতাকা মিছিলের আয়োজন করা হয়েছে।
যদিও বিশ্লেষকরা বলছেন, সংঘর্ষে কেউ জয়ী হয়নি, এবং পাকিস্তানও বেশ কিছু ক্ষতির মুখে পড়েছে। তারপরও শক্তিশালী প্রতিবেশী ভারতের বিরুদ্ধে অবস্থান ধরে রাখায় জনগণের মধ্যে এক ধরনের আত্মবিশ্বাস ফিরে এসেছে।
করাচির ব্যাংক কর্মকর্তা হাফিজ সিদ্দিকী বলেন, “অন্তত আমাদের সেনাবাহিনী তাদের কাজটা করতে এখনও সক্ষম, এটা প্রমাণ করেছে। এমন মনে হচ্ছে, আমরা যেন কিছু একটা জিতেছি। আমরা ব্যর্থ রাষ্ট্র নই”।
অল্প কিছুদিন আগেও যুদ্ধের সম্ভাবনায় আতঙ্কিত ছিল পাকিস্তানের জনগণ। ২০২২ সালে ইমরান খানের ক্ষমতাচ্যুতি ও কারাবরণকে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক বিভক্তি চরমে পৌঁছায় দেশটিতে। অনেকেই মনে করেন, তাঁর উত্থান ও পতনের পেছনে সেনাবাহিনীর হাত ছিল। গত বছরের নির্বাচনে সেনাবাহিনীর হস্তক্ষেপের অভিযোগে বর্তমান সরকারের বৈধতা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে।
“অন্তত আমাদের সেনাবাহিনী তাদের কাজটা করতে এখনও সক্ষম, এটা প্রমাণ করেছে। এমন মনে হচ্ছে, আমরা যেন কিছু একটা জিতেছি। আমরা ব্যর্থ রাষ্ট্র নই”।
দেশটির অর্থনৈতিক অবস্থাও ভয়াবহ, জ্বালানি, খাদ্য ও বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধি জনজীবনে সংকট সৃষ্টি করেছে। অন্যদিকে আফগান সীমান্তবর্তী উত্তর-পূর্বাঞ্চলে জঙ্গিগোষ্ঠীগুলোর হামলা ও দক্ষিণ-পশ্চিমে বিচ্ছিন্নতাবাদীদের তৎপরতা নিরাপত্তা পরিস্থিতিকে আরও নাজুক করে তুলেছে।
এমন পরিস্থিতিতে ভারতের সঙ্গে যুদ্ধ সম্ভাবনা পাকিস্তানের জন্য চরম চাপের কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
এর আগে, ২২ এপ্রিল ভারতীয় কাশ্মীরে একটি ভয়াবহ সন্ত্রাসী হামলায় ২৬ জন বেসামরিক নিহত হন। ভারত এর জন্য পাকিস্তানকে দায়ী করে হামলার ঘোষণা দেয়। যদিও পাকিস্তান দায় অস্বীকার করে।
এই ঘটনার দুই সপ্তাহ পর ভারত পাকিস্তানে সামরিক অভিযান শুরু করে। পরবর্তী কয়েক দিনে ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধের পরিস্থিতি তৈরি হয়। আন্তর্জাতিক কূটনীতিকরা দ্রুত পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে উদ্যোগ নেন।
সব শেষ যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় যুদ্ধবিরতি কার্যকর হয়। পাকিস্তান দাবি করে, তারা ভারতের আধুনিক যুদ্ধবিমান ভূপাতিত করেছে এবং মুখোমুখি আলোচনার মাধ্যমে ভারতকে সমঝোতায় বাধ্য করেছে।
এমন বিজয়ের দাবির প্রেক্ষিতে পাকিস্তানজুড়ে “জাতীয় ঐক্যের” আবহ তৈরি হয়। যা দেশটির সেনাবাহিনীর ভাবমূর্তি পুনরুদ্ধার করেছে বলেই মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
২০২২ সালের পর সেনাপ্রধান হিসেবে দায়িত্ব নেওয়া জেনারেল সৈয়দ আসিম মুনির সম্পর্কে এক সময় তরুণদের বিরূপ মনোভাব ছিল। ইমরান খানের সমর্থক তরুণদের অনেকেই তাঁকে নির্যাতন ও রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের প্রতীক হিসেবে দেখতেন।
তবে সাম্প্রতিক উত্তেজনার সময় জেনারেল মুনির পরিস্কার ও দৃশ্যমান নেতৃত্ব দেন। তাঁর ছবি এখন দেশজুড়ে বিলবোর্ড ও পোস্টারে জাতীয় নায়কের রূপে প্রকাশ পাচ্ছে।
জর্জটাউন ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক আকিল শাহ বলেন, “এই বিজয়ের ফলে সেনাবাহিনী আবারও নিজেদের পেশাদার বাহিনী হিসেবে তুলে ধরতে পারবে, রাজনৈতিক হস্তক্ষেপকারী নয়।”
পাকিস্তানের ইতিহাসে ভারতবিরোধী উত্তেজনা প্রায়শই সেনাবাহিনীর জনপ্রিয়তা বৃদ্ধিতে সহায়ক হয়েছে। ১৯৯৯ সালের কারগিল যুদ্ধে জেনারেল পারভেজ মোশাররফ জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন এবং পরে ক্ষমতা দখল করেন।
তবে গবেষণা প্রতিষ্ঠান গ্যালাপ পাকিস্তানের নির্বাহী পরিচালক বিলাল গিলানি সতর্ক করে বলেন, “যদি সেনাবাহিনী আবার রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ শুরু করে, তবে এই জনসমর্থন দ্রুতই হারিয়ে যেতে পারে।”
এছাড়া, অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা সংকট সেনাবাহিনীর ভাবমূর্তির জন্য এখনও একটি গুরুত্বপূর্ণ হুমকি। উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে জঙ্গি হামলা এবং নিরাপত্তা বাহিনীর লক্ষ্য করে বোমা ও গুলির ঘটনায় জনগণের মধ্যে প্রশ্ন উঠেছে—সেনাবাহিনী আদৌ নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারছে কি না।
ইসলামাবাদভিত্তিক থিংক ট্যাংক পিপস-এর পরিচালক মুহাম্মদ আমির রানা বলেন, “ভারতের সঙ্গে প্রচলিত যুদ্ধের জন্য পাকিস্তান বিপুল বিনিয়োগ করেছে। কিন্তু অভ্যন্তরীণ বিদ্রোহ দমন ও সন্ত্রাসবাদ মোকাবেলায় সম্পূর্ণ ভিন্ন কৌশল প্রয়োজন, যার জন্য রাজনৈতিক সংলাপ ও টেকসই কৌশল দরকার।”
মূল লেখক : জিয়া উর রেহমান
সোর্স: নিউ ইয়র্ক টাইমস
বিডি প্রতিদিন/আশিক