নামাজের আগে জনৈক ব্যক্তি বললেন, হুজুর খুব পেরেশানিতে আছি, দোয়া করবেন। আমি তাকে বললাম, আপনি তো আমার কাছে আরও অনেকবার দোয়া চেয়েছেন। তিনি বললেন, জি হ্যাঁ চেয়েছি। আমি তাকে বললাম, আমি আপনার জন্য দোয়া করেছি, বিপদ দূর হয়নি? তিনি উত্তরে বললেন, জি না।
আমার কাছে দোয়াপ্রার্থী লোকটিকে বললাম, আমার দোয়ার দ্বারা না আমি নিজে ঠিক হতে পারছি, না মাদরাসার ছাত্রদের ঠিক করতে পারছি। আপনার জন্য দোয়া করেও কোনো লাভ হচ্ছে না।
আমার কথা শুনে লোকটি খুব চিন্তিত হলেন। তখন আমি তাকে চিন্তামুক্ত করার জন্য বললাম, নবীজি (সা.) বলেছেন, যদি কোনো মুসলমান অন্য মুসলমানের জন্য গায়েবানা দোয়া করে তাহলে সে দোয়া কবুল হয়। বুখারি শরিফের হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, তোমরা একে অন্যের জন্য দোয়া করবে, যারা তোমাদের সামনে নেই, তাদের জন্য এবং দায়িত্বশীলদের জন্য বেশি বেশি দোয়া করবে। তাহলে এ দোয়া কবুল হবে। আর সামনে দোয়া করার মধ্যে দোয়াকারীর অনেক সময় হাদিয়া পাওয়া এবং দোয়ার মাধ্যমে দোয়াপ্রার্থীকে খুশি করা উদ্দেশ্য হয়। আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভ করার উদ্দেশ্য থাকে না। যার ফলে দোয়া কবুল হয় না। কিন্তু আমি আপনার জন্য আপনার উপস্থিতি-অনুপস্থিতিতে দোয়া করেছি। হাদিসের অর্থ-মর্ম অনুযায়ী আমার দোয়া কবুল হওয়ার কথা। কিন্তু কবুল হলো না কেন, তা তো আমি বুঝতে পারছি না। এরপর আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম, আচ্ছা! আপনার বা আপনার ছেলেদের কেউ সন্ত্রাসী কি না, তাদের কারও কি মদ্যপান কিংবা সুদ-ঘুষ খাওয়ার অভ্যাস আছে? তিনি উত্তরে বললেন, জি না, এ ধরনের কোনো বদ অভ্যাস আমাদের পরিবারের কারও নেই। এ কথা শুনে আমি আরও চিন্তিত হলাম। কোনো গুনাহ নেই, তবু দোয়া কবুল হচ্ছে না। তবে কি হাদিস মিথ্যা প্রমাণিত হবে? তা তো হতে পারে না। এরপর শেষবারের মতো তাকে জিজ্ঞেস করলাম, আচ্ছা আপনি এবং আপনার বাসার সবাই পর্দা মেনে চলেন তো? এ প্রশ্নের উত্তরে তিনি নীরবতা অবলম্বন করলেন। তখন আমি মনে মনে আশ্বস্ত হলাম, এজন্যই তো দোয়া কবুল হচ্ছে না।
এরূপ অন্য এক ব্যক্তি আমাকে বললেন হুজুর! আপনি নামাজের কথা বলার পর পাঁচ বছর চলছে ফরজ তরক তো দূরের কথা তাহাজ্জুদও তরক করিনি। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো, যেদিন থেকে নামাজ শুরু করেছি, সেদিন থেকে আমার ব্যবসাবাণিজ্যে লোকসান শুরু হয়েছে। এ ছাড়া বালামুসিবতের তো কোনো শেষ নেই। আমি তার এ বক্তব্য শুনে একেবারে অস্থির হয়ে গেলাম, একি বলে! একদিন এশার নামাজের পর আমি দুই রাকাত সুন্নত পড়তে না পড়তেই তিনি দুই রাকাত সুন্নত, দুই রাকাত নফল ও তিন রাকাত বেতের পড়ে আমার কামরার দিকে চলে গেলেন। আমি নামাজ শেষে কামরায় গিয়ে তাকে জিজ্ঞেস করলাম, আপনি ফরজ পড়ার পর কয় রাকাত নামাজ পড়েছেন? তিনি উত্তরে বললেন, কেন? আমি তো সাত রাকাত পুরোপুরিই পড়েছি। আমি জিজ্ঞেস করলাম, কোন্ কোন্ সুরা দিয়ে পড়েছেন? তিনি উত্তরে বললেন, হুজুর! আমি সুরা মুখস্থ পড়তে জানি না তো তাই সুরার পরিবর্তে ইয়া রাব্বি! ইয়া রাব্বি পড়েছি। আমি জিজ্ঞেস করলাম, আত্তাহিয়াতু পড়েছেন? তিনি বললেন, তা-ও জানি না। আমি জিজ্ঞেস করলাম, রুকু-সেজদার তাসবিহ পড়েননি? তিনি উত্তরে বললেন, তাসবিহর স্থানেও ইয়া রাব্বি! ইয়া রাব্বি! পড়েছি। এ প্রসঙ্গে একটি ঘটনা স্মরণ হলো। হজরত আশরাফ আলী থানভি (রহ.) তাঁর এক কিতাবে লিখেছেন, বাঘের হুংকার ও দাপট দেখে জনৈক ব্যক্তির মনে বাঘ হওয়ার আগ্রহ জাগে। তখন সে বাঘের চিত্র অঙ্কনকারীর কাছে গিয়ে বলল, হে ভাই! আমাকে বাঘ বানিয়ে দাও। চিত্রকর বলল, ঠিক আছে বসুন, আপনাকে বাঘ বানিয়ে দিচ্ছি। সে হাতে সুঁই নিয়ে ওই লোকের নিতম্বে খোঁচা দিতে লাগল, তখন সে বলে উঠল, উহ্! তুমি কী করছ? চিত্রকর বলল, বাঘের লেজ বানাচ্ছি। সে বলল খুব ব্যথা লাগছে। লেজ ছাড়া কি বাঘ হয় না? উত্তরে বলা হলো : হ্যাঁ হয়। লোকটি বলল, তাহলে আমাকে লেজ ছাড়া বাঘ বানিয়ে দাও। তারপর চিত্রকর লোকটির শরীরের অন্য স্থানে খোঁচা দিল। সে বলল : এখন আবার কী করছ? চিত্রকর বলল, বাঘের হাত বানাচ্ছি। লোকটি বলল, হাত ছাড়া কি বাঘ হয় না? চিত্রকর বলল, হ্যাঁ হয়। লোকটি বলল, তাহলে আমাকে হাত ছাড়া বাঘ বানিয়ে দাও! এভাবে চিত্রকর বাঘের যে অঙ্গই বানাতে চায়, লোকটি বাধা দিয়ে বলে, এটা ছাড়া কি বাঘ হয় না? অথচ হাত-পা ও লেজ ছাড়া যে বাঘ হবে, সে বাঘের ওপর তো বিড়ালও আক্রমণ করবে। সুতরাং আমি ওই নামাজি লোকটিকে লক্ষ্য করে বললাম, আপনার কেরাত, তাশাহুদ এবং তাসবিহ ছাড়া নামাজের অবস্থা হচ্ছে ঠিক সেই হাত-পা ও লেজ ছাড়া বাঘের মতো। আপনার এ নামাজের জন্য আল্লাহর পক্ষ থেকে আপনাকে এ মর্মে শাস্তি দেওয়া উচিত ছিল, তুমি ব্যবসাবাণিজ্যের কোটি কোটি টাকার হিসাব স্মরণ রাখতে পার, কিন্তু নামাজের জন্য ছোট ছোট সুরা এবং রুকু-সেজদার তাসবিহ মনে রাখতে পার না কেন? এ নামাজের কারণে ব্যবসায় লোকসান হলে তো কমই হয়েছে, আপনার ওপর যে আল্লাহ গজব নাজিল হয়নি, এটাই তো বড় ভাগ্যের কথা।
লেখক : আমির, আল হাইআতুল উলয়া ও বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়া বাংলাদেশ