মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর বজ্রকণ্ঠে ‘খামোশ’ হুংকার রাজনীতি অঙ্গনে অতিপরিচিত। তিনি ছিলেন গণমানুষের রাজনীতিবিদ। বাংলাদেশের মানুষের কাছে তিনি ‘মজলুম জননেতা’ হিসেবে পরিচিত। তাঁর জন্ম সিরাজগঞ্জে হলেও টাঙ্গাইলের সন্তোষ ছিল তাঁর পরবর্তী ঠিকানা। ১৯৫৭ সালের কাগমারী সম্মেলনে তিনিই প্রথম পাকিস্তানি শাসকদের ‘ওয়ালাইকুম আস্সালাম’ বলেছিলেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রথম বীজ তিনি কাগমারী সম্মেলনেই বপন করেছিলেন। রাজনীতিতে তিনি কাউকে পরোয়া করতেন না। মহাপ্রতাপশালী শেখ মুজিব সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ছিলেন টাঙ্গাইলের আবদুল মান্নান। সে সময় টাঙ্গাইলসহ সারা দেশের মানুষ মওলানা সাহেবের কাছে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ করেন। একপর্যায়ে তিনি পল্টন ময়দানের সমাবেশে গর্জে উঠলেন। শেখ মুজিবকে উদ্দেশ করে বললেন, ‘মজিবর তোমার মান্নানরে সামলাও। ও সব খাইয়া ফালাইলো।’ আজ বিপ্লব-উত্তর বাংলাদেশে মওলানা সাহেব যদি বেঁচে থাকতেন, তাহলে নাহিদ, আখতারকে উদ্দেশ করে বলতে বাধ্য হতেন, ‘নাহিদ, আখতার, তোমাদের বৈষম্যবিরোধী ও সমন্বয়কদের সামলাও। তারা তোমাদের বিপ্লবের অর্জন খাইয়া ফালাইলো।’
গত ৩ আগস্ট প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং তার মন্ত্রিসভার পদত্যাগের এক দফা দাবি ঘোষণা করে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। কোটা সংস্কার আন্দোলনে নেতৃত্বদানকারী সংগঠনটির সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম ঢাকায় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে এই ঘোষণা দেন। কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে সমবেত ছাত্র-জনতার উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং তার মন্ত্রিসভাকে পদত্যাগ করতে হবে। সরকার পদত্যাগ না করা পর্যন্ত অসহযোগ আন্দোলন চলবে।’ সেনাবাহিনীসহ নিরাপত্তা বাহিনীর উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘এই সরকারকে জনগণ প্রত্যাখ্যান করেছে। আপনারা সরকারকে সমর্থন না দিয়ে জনগণকে সমর্থন দিন।’ সেদিন ছাত্র-জনতার মাঝে নাহিদ ইসলাম পরিণত হয়েছিলেন হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালা। তাঁর সেদিনের ঘোষণাতেই সরকারের তখ্তে-তাউস কেঁপে ওঠে। যার পরিণতি ৫ আগস্টের বিজয়। এই বিশাল বিজয়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সব পর্যায়ের সমন্বয়ক, নেতা-কর্মী, ছাত্র-জনতা সবারই অবদান আছে। সে কারণে এই যুদ্ধের সব যোদ্ধার প্রতি লাল সালাম। বিপ্লবের সব সাথি নিয়ে নাহিদ, আখতার এখন সংগঠিত করছেন একটি মধ্যপন্থার রাজনৈতিক দল, জাতীয় নাগরিক পার্টি। বিশাল আয়োজনের মধ্য দিয়ে দলটির আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হয়েছে। তারুণ্যনির্ভর বিপ্লবীদের দলটির কাছে দেশবাসীর অনেক প্রত্যাশা। সর্বপ্রথম কাজ হলো, দলকে সুসংগঠিত করা। অন্য রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীরা যা করে, তা এই দলের কেউ করবে না- এমন কঠোর নির্দেশনা থাকতে হবে। সারা দেশ থেকে খবর পাওয়া যায়, আগে ছাত্রলীগ, যুবলীগ, আওয়ামী লীগ যা করত এখন বৈষম্যবিরোধী বা সমন্বয়কের নামধারী কিছু টাউট সেসবই করছে। থানার ওসি, সাব রেজিস্ট্রারের অফিস, এসি ল্যান্ড, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা, এসপি, ডিসির রুমে এই টাউটদের দেখা যাচ্ছে। এ ছাড়া সারা দেশে যেসব মব হয়েছে, যেসব বাড়ি লুট হয়েছে, সবই হয়েছে এই টাউটদের নেতৃত্বে। তাদের সঙ্গে যোগ দিচ্ছেন ছাত্রলীগ, যুবলীগের কর্মীরা। শহরের বিভিন্ন পাড়ায় মহল্লায় মহড়া দেওয়া, এমনকি গ্রামের বিচার-আচারেও এখন বৈষম্যবিরোধী বা সমন্বয়ক পরিচয়ধারী টাউটদের আধিপত্য। দেশের মানুষ তাদের ভয় পেয়ে সমীহ করে। সে কারণে এই টাউটদের ব্যাপারে দলের পক্ষ থেকে এখনই কঠোর নির্দেশনা দেওয়া দরকার। বৈষম্যবিরোধী বা সমন্বয়ক পরিচয়ে কেউ যেন কোনো অন্যায় আবদার নিয়ে কোনো সরকারি-বেসরকারি অফিস-আদালতে কোনো তদবির করতে না পারে, সেজন্য দলের পক্ষ থেকে একটি সুস্পষ্ট ঘোষণা আসা দরকার। তা না হলে এসব টাউট-বাটপার বিপ্লবীদের ইমেজ ক্ষুণ্ন করবে।
নতুন দলকে দুই লক্ষ্যে সামনে অগ্রসর হতে হবে। একটি হলো- জীবনজীবিকার সমস্যা সমাধানে সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি। নিত্যপণ্যের মূল্য নিয়ন্ত্রণ, সামাজিক সমস্যা, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের জন্য সরকার যাতে মাথা ঘামায় তা বলতে হবে। জনগণের সার্বিক সমস্যার কথা তুলে ধরতে হবে। জনগণ যখন বুঝতে পারবে, এই দল তাদের কথাই বলছে, তখনই নতুন দলের নেতৃত্বের প্রতি আস্থা আরও বাড়বে। অন্যদিকে বিপ্লবীদের মনে রাখতে হবে, এই সরকার তাদেরই আন্দোলনের ফসল। এই সরকার কোনো কারণে ব্যর্থ হলে বিপ্লব ব্যর্থ হবে। দেশবাসীর আশার আলো নিভে যাবে। সে কারণে সরকার যেন আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণ করতে পারে, সেজন্য পুলিশ বাহিনীকে ট্রমা কাটিয়ে উঠতে সহায়তা করতে হবে। সারা দেশে চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই, অপহরণ, নারীর শ্লীলতাহানির মতো ঘটনা ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছে। আট বছরের ছোট্ট আছিয়ারাও এই জঘন্য অপরাধীদের হাত থেকে নিস্তার পাচ্ছে না। এসব সামাজিক অপরাধ বন্ধ করতে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলার আহ্বানও জোরালোভাবে জানাতে পারে নতুন দল। সামাজিক বিপ্লব ছাড়া শুধু পুলিশি ব্যবস্থার ওপর নির্ভর করে আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণ করা যাবে না।
দেশের অর্থনীতির অবস্থা খুবই খারাপ। গত সাত মাসে দেশে সরকারি-বেসরকারি তেমন কোনো বিনিয়োগ হয়নি। বিশেষ করে বেসরকারি খাতে ব্যবসায়ী শিল্পপতিরা রীতিমতো হাত-পা গুটিয়ে বসে আছেন। অনেক গার্মেন্ট, টেক্সটাইল, কাগজ, ইস্পাত কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। শিল্পাঞ্চলগুলোতে প্রায় প্রতিদিনই শ্রমিক অসন্তোষ চলছে। শ্রমিকরা রাস্তা অবরোধ করছেন। এ অবস্থা দেশের গণতন্ত্রের পথ রুদ্ধ করে দেবে। কারণ গণতন্ত্রের জন্য অর্থনৈতিক স্থিরতা একটি বড় সহায়ক শক্তি। বিগত ফ্যাসিস্ট সরকারের লুটপাটের পর দেশের অর্থনীতিকে গতিশীল করতে গত সাত মাসে সরকারের পক্ষ থেকে কোনো ইতিবাচক উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। এমনকি দেশের ব্যবসায়ী শিল্পপতিদের নিয়ে একটি বৈঠকও করা হয়নি। কীভাবে দেশের অর্থনীতিতে স্বাভাবিক গতি ফিরবে, কীভাবে ব্যবসায়ীরা শঙ্কামুক্ত হবেন, কীভাবে বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ বাড়বে, কীভাবে নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে- এসব বিষয়ে এখন পর্যন্ত দৃশ্যমান কোনো উদ্যোগ দেখা যায়নি। লুটেরাদের লুটের কারণে ঝুঁকিপূর্ণ ব্যাংকগুলোর গ্রাহকরা আতঙ্কিত। এসব ব্যাংকের অনেক শাখা গ্রাহকের চাহিদামতো টাকা দিতে পারছে না। একটি ব্যাংকের ঢাকার সাতমসজিদ রোড শাখায় একজন গ্রাহক কিছু টাকা ফিক্সড ডিপোজিট করেছিলেন। ওই গ্রাহক এখন দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত। তিনি উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে যাবেন। কিন্তু ব্যাংক তাঁর টাকা ফেরত দিচ্ছে না। এমনকি টাকা ফেরত চাওয়ার আবেদনপত্রও গ্রহণ করছে না। এ অবস্থায় টাকার শোকে অসুস্থ ব্যক্তি আরও অসুস্থ হয়ে পড়ছেন। এ ধরনের সমস্যা অনেক। সমস্যা যতই পাহাড় সমান হোক না কেন, ইচ্ছা করলেই সমাধান সম্ভব। এর জন্য নতুন দলের বিপ্লবীরা যদি একদিন ব্যবসায়ীদের সঙ্গে মতবিনিময় করে প্রকৃত সমস্যাগুলো জানার চেষ্টা করেন এবং সেসব সমস্যা সমাধানে সরকারকে অনুরোধ করেন তাহলে বেসরকারি খাতে গতি ফিরবে। বেসরকারি খাতে গতি ফিরলেই জাতীয় অর্থনীতি গতি ফিরে পাবে। নতুন কর্মসংস্থান হবে। অস্থির বেকার জনগোষ্ঠীতে স্থিরতা ফিরবে।
জুলাই বিপ্লবে ছাত্র-জনতা ফ্যাসিস্টদের পতন ঘটিয়েছে। দেশের ১৭ কোটি মানুষের বিরাট একটি অংশ এই আন্দোলনে অংশ নিয়েছিল। মনে রাখতে হবে, পরাজিত শক্তির চিহ্নিতরা বিদেশে পাড়ি দিয়েছে, কিন্তু তাদের আন্ডা-বাচ্চারা দেশের ভিতরে এখনো পুরোদমে সোচ্চার। তারা দীর্ঘ ১৬ বছর টানা ক্ষমতায় ছিল। তাদের হাতে টাকা আছে। তাদের সম্পদ আছে। এখনো তারা মিলেমিশে দখল চাঁদাবাজি বহাল রেখেছে। তাদের অনেকেই মিশে গেছে বর্তমান স্রোতের সঙ্গে। প্রশাসনের বিরাট অংশ এখনো তাদের নিয়ন্ত্রণে। তা ছাড়া ছাত্র-জনতাকে নিয়ে আন্দোলন করে একটি মহাক্ষমতাবান সরকারের পতন ঘটানো যায়- এই শিক্ষাও তারা ইতোমধ্যে পেয়েছে। দেশের মানুষের মধ্যে যদি অশান্তি কাজ করে, তাহলে সুযোগ নেবে ফ্যাসিস্টদের অনুসারীরা। সেই সুযোগ তাদের কোনোভাবেই দেওয়া যাবে না। সেজন্য বিপ্লবীদের দায়িত্ব নিতে হবে। শুধু রাষ্ট্র সংস্কার, নির্বাচন নিয়ে কথা বললেই হবে না। সমাজে শান্তি প্রতিষ্ঠার দায়িত্বও নিতে হবে। দেশকে ইতিবাচক ধারায় ফিরিয়ে আনার জন্য বিপ্লবীদের যে অঙ্গীকার, তা বাস্তবায়ন করতে হলে দেশবাসীর কাছে প্রত্যেক বিপ্লবীকে ক্লিন ইমেজের হতে হবে। আমাদের প্রিয় নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর একটি নীতির কথা আমরা অনেকেই জানি। অনেকে বিভিন্ন আলোচনায় সেটার অবতারণাও করি। তা হলো, নবীজি মিষ্টি খুব পছন্দ করতেন। কিন্তু নিজে মিষ্টি খাওয়া বন্ধ করে অন্যকে মিষ্টি খাওয়া থেকে বিরত থাকার উপদেশ দিয়েছিলেন। নবীজির শিক্ষা হলো, অন্যকে কোনো উপদেশ দেওয়ার আগে সেটা নিজের ব্যক্তিগত জীবনে পালন করতে হবে। তা না হলে ওই উপদেশ কেউ মানবে না। ‘রাজনীতিতে শেষ কথা বলে কিছু নেই’- রাজনীতির এমন আত্মপ্রতারণা থেকে বের হতে হবে। সুস্থ, সুন্দর ও জনমুখী রাজনীতি প্রতিষ্ঠিত করতে হবে।
লেখক : নির্বাহী সম্পাদক, বাংলাদেশ প্রতিদিন