গণহত্যার বিচার না হওয়া পর্যন্ত বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ ও এর সব অঙ্গসংগঠনের কার্যক্রম নিষিদ্ধ করা হয়েছে। নির্বাচন কমিশন দলটির নিবন্ধনও স্থগিত করেছে। কোনো সন্দেহ নেই, আওয়ামী লীগ নিজেই নিজের এই পরিণতি ডেকে এনেছে। জুলাই গণ অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে ক্ষমতা থেকে ছিটকে পড়ে পালিয়ে আত্মরক্ষা করেন শেখ হাসিনা। দলটি ভয়ানক বিপর্যয়ের শিকার হয়। জনরোষ থেকে বাঁচতে দলের ছোটবড় প্রায় সব নেতাই জান বাঁচাতে দিগি¦দিক পালিয়ে যান। তারপরও শেখ হাসিনা ও তার অনুসারীরা আত্মসমালোচনা করেননি। অনুতাপ অনুশোচনার ধার ধারেননি। পশ্চাতে তার স্বীকৃত অন্যায়-অপরাধের পাহাড়, তাদের হাতে খুন হওয়া গণতন্ত্রের লাশ, হাজার শহীদের রক্তের দাগ ও গন্ধ। কিন্তু তা শেখ হাসিনা কিংবা পলাতক সহযোগীদের মুহূর্তের জন্যও বিচলিত করেনি। কোনো অনুতাপ নেই, অনুশোচনা নেই। জাতির কাছে ক্ষমা চাওয়া তো পরের কথা। উপরন্তু আস্ফালনের শেষ নেই। কাজেই আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ হওয়ার ঘটনাটি বিনা মেঘে বজ্রপাত নয়। এ নিয়ে বেশি কথা না বলাই ভালো। প্রমাণিত হয়েছে, আওয়ামী লীগ নিজেই নিজের সবচেয়ে বড় শত্রু।
কিন্তু কথা হলো, আওয়ামী লীগ ব্যান হয়েছে বলে কি বাঙালির মুক্তিযুদ্ধের অর্জনগুলো সব মুছে যাবে! মিথ্যা হয়ে যাবে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস? ইতিহাসকে আমরা কি উল্টে দেব? একাত্তরের খলনায়ককে ইতিহাসের নায়ক বানাব? আর নায়ক বা নায়কদের বানাব খলনায়ক? যেদিন আওয়ামী লীগ ব্যান হলো সেদিন শাহবাগের মঞ্চে জাতীয় সংগীত গাওয়া হচ্ছিল। তখন জাতীয় সংগীত গাইতে বাধা দেওয়া হয়েছে। যারা জাতীয় সংগীতে বাধা দিয়েছিলেন তারাই সেøাগান দিয়েছেন, গোলাম আযমের বাংলায় আওয়ামী লীগের ঠাঁই নাই। আওয়ামী লীগ এখন নিষিদ্ধ সংগঠন। কাজেই দলটির ঠাঁই আছে কী নেই, সেটা অপ্রাসঙ্গিক।
গোলাম আযম বাংলাদেশে একজন আলোচিত ব্যক্তিত্ব। বহির্বিশ্বে বিশেষ করে মুসলিম দেশগুলোতে তার ব্যাপক পরিচিতি রয়েছে। ইসলামি রাজনৈতিক তাত্ত্বিক হিসেবে তিনি যথেষ্ট প্রভাবশালী নেতা ছিলেন। শারীরিকভাবে এখন তিনি উপস্থিত না থাকলেও তার উত্তরাধিকার জামায়াতে ইসলামী ও সমমনা ধারার রাজনীতির প্রেরণা। তমদ্দুন মজলিসের একজন হিসেবে মহান ভাষা আন্দোলনে তার ভূমিকা অনস্বীকার্য। তাই বলে গোলাম আযমের বাংলায়, এমন দাবি করার কোনো সুযোগ নেই। অধ্যাপক গোলাম আযম কখনো এ দেশের অবিসংবাদিত নেতা ছিলেন না। ১৯৭০ সালের প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচনে দলটি পেয়েছিল একটি আসন। সারা দেশের নগণ্যসংখ্যক মানুষ জামায়াতে ইসলামীর প্রতি সমর্থন জানিয়েছিল। আর একাত্তরে গণহত্যা চলাকালে তিনি ও তার দল যে ভূমিকা নিয়েছিল, তা ছিল নিন্দিত ও বিতর্কিত। এই বাস্তবতায় গোলাম আযমের বাংলা কিংবা গোলাম আযমের বাংলাদেশ- এরকম চিহ্নিতকরণের সুযোগ কোথায়? স্পষ্টতই এটা ইতিহাস রিভার্স করে দেওয়ার শামিল।
অন্যদিকে জাতীয় সংগীত গাইতে বাধা দেওয়া অথবা প্রশ্ন তোলার বিষয়টি খুবই উদ্বেগজনক। গত মঙ্গলবারও বগুড়ায় উদীচীর অনুষ্ঠানে জাতীয় সংগীত গাওয়ার সময় বাধা দেওয়া হয়েছে। উদীচীর অফিসেও নাকি ভাঙচুর করা হয়েছে। বাংলাদেশের একশ্রেণির লোকের মধ্যে রবীন্দ্রনাথ, রবীন্দ্রনাথের গান ও কবিতা নিয়ে স্পর্শকাতরতা আইউব খানের জমানা থেকেই আছে। সে সময় রবীন্দ্রনাথ নিষিদ্ধ করার চেষ্টা করা হয়েছিল। বুদ্ধিজীবীদের একটা অংশকে দলে টানতেও সক্ষম হয়েছিল তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের প্রাদেশিক সরকার। কিন্তু সেই চেষ্টা তখন ফলবতী হয়নি। ৫ আগস্ট জুলাই গণ অভ্যুথানের বিজয়ের পর দীর্ঘ আট বছর আয়নাঘরে বন্দিদশা থেকে মুক্তি পাওয়ার পর গোলাম আযমের পুত্র আবদুল্লাহিল আযমী এক প্রেস ব্রিফিংয়ে জাতীয় সংগীত ও সংবিধান পরিবর্তনের দাবি জানান। জাতীয় সংগীত পরিবর্তনের পক্ষে তিনি যুক্তি দেখান, এই গানটি ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ রদ আন্দোলনের সময় লেখা ও গাওয়া হয়েছিল। এই গান দুই বাংলাকে একত্র করার গান। তদুপরি বাংলাদেশের স্বাধীনতার বহু বছর আগে লেখা একটি গান কী বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত হতে পারে? তার এই বক্তব্যের পর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কেউ কেউ আযমীর দাবির সমর্থনে পোস্ট দেন। কেউ কেউ যুক্তি দেখান, রবীন্দ্রনাথের এই গানের সুর নকল করা। গগন হরকরার একটি বাউল গানের সুর নকল করে এই গানের সুরারোপ করা হয়েছে। কাজেই নকল সুরের কোনো গান বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত হতে পারে না। এরকম যুক্তি দেখালেও জামায়াতে ইসলামী তখন এসব বক্তব্য সমর্থন করেনি। তারা এর পক্ষে বা বিপক্ষেও কোনো কথা বলেনি। এখনো যে জাতীয় সংগীত গাইতে বাধা দেওয়া হচ্ছে, সে ব্যাপারেও নিশ্চুপ। ছাত্রশিবিরের দিকে অভিযোগের আঙুল তোলা হলেও শিবির সে অভিযোগের কড়া জবাব দিয়েছে। দৃশ্যত সাংগঠনিকভাবে জামায়াতে ইসলামী ও ছাত্রশিবির জাতীয় সংগীত প্রশ্নে কৌশলী অবস্থান গ্রহণ করে চলেছে।
বাংলাদেশের সংবিধান অপরিবর্তনীয় কোনো দলিল নয়। জাতীয় সংগীতও অপরিবর্তনীয় কোনো সিদ্ধান্ত নয়। সময়ের প্রয়োজনে পরিবর্তন তো হতেই পারে। কিন্তু তার পেছনে যুক্তি তো থাকতে হবে। তদুপরি সেই পরিবর্তনটা হতে হবে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি দ্বারা। অর্থাৎ কেবল পার্লামেন্টই পারে এসব মৌলিক প্রশ্নের সমাধান করতে। সেই পরিবর্তনটা না আসা পর্যন্ত আমার সোনার বাংলা আমাদের জাতীয় সংগীত। এই গান গাইতে বাধা দেওয়া, জোরজুলুম করা গণতান্ত্রিক কোনো রীতির মধ্যেই পড়ে না।
প্রসঙ্গত বলা বাঞ্ছনীয়, জাতীয় সংগীত পরিবর্তনের পক্ষে যেসব যুক্তি দেখানো হচ্ছে, সেগুলোও কোনো অকাট্য যুক্তি নয়। দুনিয়ার বহু দেশের জাতীয় সংগীত স্বাধীনতার বহু বহু বছর আগে লেখা হয়েছে। ভারতের জাতীয় সংগীতের রচয়িতা বঙ্কিমচন্দ্র। তিনি গানটি রচনা করেন ভারতের স্বাধীনতার শতবর্ষ আগে। আমার সোনার বাংলা গানটি বাংলাদেশে বহু আগেই থেকেই গীত হয়ে আসছে। মহান ভাষা আন্দোলনের পরের বছর ঢাকা কলেজের এক অনুষ্ঠানে আবদুল লতিফ এই গান পরিবেশন করেছিলেন। তারপরও বহুবার বহু অনুষ্ঠান-আয়োজনে এটি গাওয়া হয়েছে দেশাত্মবোধক গান হিসেবে। গাইতে গাইতেই গানটি বাংলাদেশের জাতীয় সংগীতের স্বীকৃতি পায়। অন্য কোনো দেশ বা কোনো আধিপত্যবাদী শক্তির ইচ্ছায় এই গানটি জাতীয় সংগীতের মর্যাদা পায়নি। বাংলাদেশের ধান, নদী ও প্রকৃতি খুবই মনোমুগ্ধকরভাবে ও প্রাণবন্ত বর্ণনায় এই গানে প্রতিফলিত হয়েছে। মানুষ গানটি পছন্দ করেছে। জাতীয় সংগীত হয়েছে। এই গানের সঙ্গে বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধ, দেশপ্রেম ও বাঙালির স্বাধিকার ও স্বাধীনতাসংগ্রামের ইতিহাসের নিবিড় যোগ রয়েছে। তারপরও বদলাতে চাইলে এটি নির্বাচিত পার্লামেন্ট না হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করা উচিত। এটাই গণতন্ত্রের দাবি।
একশ্রেণির মানুষের উগ্রতা, কোনো কোনো রাজনৈতিক শক্তি সংঘের সাধারণ নির্বাচন বিলম্বিত করার প্রচেষ্টা দেখে মনে হয় গণতন্ত্রের দাবিটি আজ উপেক্ষিত হচ্ছে নিদারুণভাবে। বিএনপি বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ দল। দলটি জাতীয় নির্বাচনের দাবি করে চলেছে। তারা ডিসেম্বরে নির্বাচন চায়। জামায়াতে ইসলামী নির্বাচন চায় মার্চ এপ্রিলের মধ্যে। এনসিপিও নির্বাচন চায়।
পাশাপাশি ছাত্রদের এই দলটি নতুন নতুন ইস্যু সামনে নিয়ে আসছে। তারা ঠিক কত দিন পর ইলেকশন চাইছে তা ধোঁয়াচ্ছন্ন। পার্টির কোনো কোনো নেতা বলছেন, গণহত্যার বিচার না হওয়া পর্যন্ত কোনো ইলেকশন হতে পারবে না। আবার গণপরিষদ নির্বাচনের কথাও বলা হচ্ছে। এনসিপির শাহবাগ কর্মসূচির সমর্থকদের মধ্য থেকে জাতীয় সংগীত গাইতে বাধা দেওয়া হয়েছে। এই পরিপ্রেক্ষিতে সরকারের একজন উপদেষ্টা কড়া পোস্ট দিয়েছেন ফেসবুকে। আর খোদ দলটি ধরি মাছ না ছুঁই পানি ধরনের একটা বিবৃতি দিয়েছে। যারা একাত্তরে বাংলাদেশের জনযুদ্ধের বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছিল, তাদের এখনকার অবস্থান পরিষ্কার করার আহ্বান জানিয়েছে তারা। কিন্তু কোনো দলের নাম করেনি। জাতীয় সংগীত গাইতে বাধা দেওয়া বা ‘গোলাম আযমের বাংলাদেশ’ স্লোগানের বিষয়েও কিছু বলেনি। দলটি একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধের পরিবর্তে এই জনপদের মানুষের ১৯৪৭ ও ১৯৭১-এর জনযুদ্ধ টার্মটি ব্যবহার করেছে। এ-ও খুব তাৎপর্যপূর্ণ। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ যে জনগণের তথা জনযুদ্ধ ছিল, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। সেই জনযুদ্ধের নামই তো মুক্তিযুদ্ধ। সেই মুক্তিযুদ্ধ নামটি কেন অ্যাভয়েড করা হলো, সেই প্রশ্নটিও থাকল। যারা মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছে, যারা সেই সময়ে সংঘটিত গণহত্যার সহায়ক শক্তি হিসেবে কাজ করেছে, তারা আসলে গণতন্ত্রের বিপক্ষে কাজ করেছে। যারা আজকে জোর করে জাতীয় সংগীত গাইতে বাধা দিচ্ছে, একাত্তরের সহায়তাকারীদের গ্লোরিফাই করার চেষ্টা করছে, তারাও প্রকারান্তরে গণতন্ত্রের বিপক্ষে কাজ করছে। এমতাবস্থায় বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক শক্তির ঐক্য জরুরি হয়ে পড়েছে। গণতন্ত্র হেরে গেলে হেরে যাবে বাংলাদেশ।
লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক ও কথাসাহিত্যিক