প্রধান উপদেষ্টার পাঁচ নির্দেশনার পর যারপরনাই অপেক্ষা ছিল পুঁজিবাজারের পরিস্থিতি দেখা ও আলামত বোঝার। কিন্তু পুঁজিবাজারের উন্নয়ন ও বাজারকে শক্তিশালী করতে প্রধান উপদেষ্টার নির্দেশনার প্রভাব দৃশ্যমান নয়। বরং দেখা যাচ্ছে উল্টো চিত্র। গত আট-নয় মাসে শেয়ারবাজার থেকে ৮০ হাজার কোটি টাকা ‘নাই’ হয়ে গেছে বলে বিনিয়োগকারীদের অভিযোগ।
বিনিয়োগকারীদের অনেকের বড় ক্ষোভ বিএসইসির চেয়ারম্যান রাশেদ মাকসুদকে নিয়ে। তাঁদের ভাষ্য অনুযায়ী, তিনি অর্থ উপদেষ্টার পরম আত্মীয়। কারো আত্মীয় হওয়া অভিযোগের বিষয় নয়। কিন্তু তাঁর ক্ষেত্রে কেন এটি অভিযোগ? প্রধান উপদেষ্টা নিজের চোখে শেয়ারবাজারকে দেখছেন, না অর্থ উপদেষ্টার আত্মীয়ের চোখ দিয়ে দেখছেন—এমন ইঙ্গিতপূর্ণ তেতো প্রশ্নও উঠেছে। দরবেশ বাবার পর জামাই বাবার কাজকারবার নিয়েও নানা কথা ঘুরছে শেয়ারবাজারে।
শেয়ারবাজারের টানা টালমাটাল পরিস্থিতিতে অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার ৯ মাস পর প্রধান উপদেষ্টার নেতৃত্বে উচ্চ পর্যায়ের বৈঠকটিকে মন্দের ভালো বলছিলেন সরকারের সমালোচকরাও। তাই প্রধান উপদেষ্টার শেয়ারবাজার নিয়ে বৈঠকটি বিনিয়োগকারীদের কতটা আস্থা ফেরাতে পারবে, এ নিয়ে ব্যাপক কথা চালাচালি হচ্ছিল। শেয়ারবাজারকে দেশের অর্থনীতির আয়না বলে থাকেন অনেকে।
বিশ্বের সব দেশ যে কারণে এমন শেয়ার মার্কেট গঠনে উদ্যোগী হয়, শ্রীলঙ্কা এটা বুঝেছিল। তাই অর্থনীতির চেহারা ফেরাতে তাদের বেশি সময় লাগেনি। আর এখানে ১৮ লাখ বিনিয়োগকারীর প্রায় ৯০ শতাংশ পুঁজিই হাওয়া। ক্রমাগত লোকসানে গত ৯ মাসে ৩০ হাজার বিনিয়োগকারী সব শেয়ার বিক্রি করে কেনাবেচার বিও অ্যাকাউন্ট বন্ধ করে দিয়েছেন। ৫৭ হাজার বিনিয়োগকারী নিষ্ক্রিয় হয়ে গেছেন।
এই সময়ে স্টক এক্সচেঞ্জের প্রধান সূচক ১০০০ পয়েন্টের বেশি কমেছে, যার কারণে পুঁজিবাজারের গুরুচরণ দশা। আধুনিক বিশ্বে শেয়ারবাজার যেকোনো দেশের অর্থনীতির হৃদস্পন্দন। এর স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতে হলে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত, পেশাদার ও দূরদর্শী ব্যবস্থাপনা গড়ে তোলার বিকল্প নেই। বিগত কয়েক বছরে বিনিয়োগকারীদের পুঁজি শেষ। নতুন করে সেখানে বিনিয়োগকারী আনতে পারার ওপর নির্ভর করছে অনেক কিছুই। লুকানোর কোনো সুযোগ নেই যে দেশের শেয়ারবাজার এখন আইসিইউতে। একে উদ্ধার করতে বাইরে থেকে একজন বিশেষজ্ঞকে হায়ার করে আনা হয়েছে। বিগত দুই যুগে যাঁদের নিয়ন্ত্রণকারী প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান হিসেবে বসানো হয়েছে, তাঁরা সবাই সরকারের ইচ্ছায়ই বসেছেন। সরকারের উচ্চ মহলের ইচ্ছায় কাজ করেছেন।
দুর্বল কম্পানির শেয়ার বুক বিল্ডিং সিস্টেমে উচ্চমূল্যে বাজারে আনার বিষয়ে অভিযোগ আছে তাঁদের বিরুদ্ধে। ওই সবের ৭০ শতাংশ এখন মৃত অবস্থায়। ৫ আগস্টের পর বিএসইসি চেয়ারম্যান এবং অনেক সদস্যকে চলে যেতে হয়েছে। কিন্তু তাঁদের স্থলে যাঁদের বসানো হয়েছে, ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে তাঁরা এই গ্রহেরই। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে আগের পথের পথিকই তাঁরা। তাঁদের কৃতকর্মের জেরে ব্যাংকসহ পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত কম্পানিগুলোর বেশির ভাগের শেয়ারমূল্য ফেস ভ্যালুর অর্ধেকে, কোনোটির মূল্য চার ভাগের এক ভাগ! এটিই বাস্তবতা। কারণ একাডেমিক থিওরির সঙ্গে পুঁজিবাজারের বাস্তবতা অনেক ক্ষেত্রেই মেলে না। দরবেশ বাবা-জামাই বাবারাই এই বাজারে সেরার সেরা। তাঁদের ছিলছিলায় দেড় যুগ ধরে দেশের পুঁজিবাজার দুর্নীতি ও লুটপাট বান্ধব অবস্থায় থিতু হয়ে আছে। ৫ আগস্ট-পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহে তা আরো পোক্ত হয়েছে, যা পুঁজিবাজারকে ক্রমে মহাশ্মশানমুখীই করছে। চব্বিশের ৫ আগস্ট বিপ্লবের পর পরিবর্তনের আশায় ৬-৭-৮ আগস্ট মানুষ নতুন সরকারের প্রতি আশাবাদী হয়। তলানিতে পড়ে থাকা শেয়ারের মূল্যে ব্যাপক ঊর্ধ্বগতি দেখা যায়।
৮ আগস্ট নতুন সরকার ক্ষমতায় বসতে না বসতেই বাজারে দরপতন শুরু হয়। ৯ মাস ধরে তা চলছেই। করপোরেট কালচারে ‘হায়ার অ্যান্ড ফায়ার’ নৈমিত্তিক ঘটনা। ভালো করলে পুরস্কার, ব্যর্থ হলে অপসারণ। কিন্তু এ ক্ষেত্রে বড় ব্যত্যয়। অর্থনীতির স্বাস্থ্য ভালো না হলে যত ঝানু ও জ্ঞানী লোক বসানো হোক না কেন, কেবল শেয়ারবাজার নয়, কাঁচামালের বাজার জমানোও অসম্ভব। দেশি-বিদেশি জাত না খুঁজে বিনিয়োগ বাড়ানো, পুঁজিবাজারের শক্তি বাড়ানো, জনবান্ধব করনীতি সময়ের দাবি। রাষ্ট্রের ঋণনির্ভরতা কমাতে বিনিয়োগ, উৎপাদন বৃদ্ধি, অভ্যন্তরীণ উৎস ও পুঁজিবাজার ব্যাপক ভূমিকা রাখতে পারে। প্রয়োজনে পুঁজিবাজারসংশ্লিষ্ট ছোট-বড়দের সঙ্গে সরকার দফায় দফায় বসতে পারে। গৃহীত সিদ্ধান্ত ও নির্দেশনাগুলো বাস্তবায়নে তাদের পরামর্শ ও সহযোগিতা পাওয়া সরকারের জন্য কঠিন নয়। ব্যবসায়ী ও বিনিয়োগকারীদের নিয়ে বসলে তাঁরা আরো পথ দেখাতে পারবেন।
এ ক্ষেত্রে ব্যবসায়ী-বিনিয়োগকারীদের বিশেষ আকাঙ্ক্ষা ও চাহিদা হচ্ছে—তাঁদের রাজনীতিমুক্ত রাখা। নিশ্চিন্তে ব্যবসায় মনোযোগী থাকতে দেওয়া। সেই সঙ্গে গুরুতর অভিযোগে জড়িত থাকলে তাঁদের বিচার অবশ্যই করতে হবে। তা ব্যবসা বা ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ বা উৎপাদনের চাকা বন্ধ করে নয়। ব্যাপক বিনিয়োগ, গতিময় ব্যবসা, চাঙ্গা পুঁজিবাজার, অভ্যন্তরীণ সম্পদ বৃদ্ধিসহ সম্ভাবনার দরজা-জানালা খোলা রাখা সরকারকে মোটাদাগে বাজেট সহায়তাও দিতে পারে। তখন বাজেট সহায়তার জন্য বিশ্বব্যাংক, এডিবির কাছে এত ধরনা দিতে হবে না। সরকার সেই চেষ্টা করছে না, ঘটনা এমন নয়। সরকারের চেষ্টা-তৎপরতায় কোনো কমতি-ঘাটতি নেই। কিন্তু রাষ্ট্রের অর্থনীতির মেরুদণ্ড পুঁজিবাজারকে বেহাল রেখে ব্যবসায়ী-বিনিয়োগকারীদের অবিরাম দূরে ঠেলে, বদনামে ডুবিয়ে রেখে সেই চেষ্টায় সাফল্য আশা করা কতটা ফলদায়ক, তার উত্কৃষ্ট উদাহরণ গত আট-নয় মাসের বাংলাদেশ। চারদিকে নতুন করে সমানে বায়নানামা-দাবির মহোৎসব। এদের মধ্যে যারা বড় বড় অফিসে কলম চালায়, ক্ষমতাধর—তাদের দাবিগুলো পূরণ হয়ে যাচ্ছে তুলনামূলক সহজেই। বাকিরা রাস্তায় লাঠিপেটা খাচ্ছে।
ব্যবসায়ী-বিনিয়োগকারীরা না পারছেন রাস্তায় নামতে বা কলমবিরতি করতে, না পারছেন ব্যবসা টিকিয়ে রাখতে। এ অবস্থার মধ্যে বিদেশি বিনিয়োগের রাজকীয় আয়োজনে অনেক উৎসাহ-উদ্দীপনা জাগিয়ে এখন উল্টো খবর। একদিকে বিদেশি বিনিয়োগের বন্যা বইয়ে দেওয়ার ঢেঁকুর, অন্যদিকে দেশি-বিদেশি সব বিনিয়োগই কেবল অতলমুখী। বিনিয়োগকারীদের আগ্রহের সূচক হিসেবে বিডায় নিবন্ধিত বিনিয়োগ প্রস্তাবের সংখ্যা নিম্নমুখী। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যে প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগের নিট প্রবাহেও খরার টান। শিল্পের মূলধনী যন্ত্র আমদানিরও নিম্নমুখী অবস্থা। বাংলাদেশ ব্যাংকের ব্যালান্স অব পেমেন্টের (বিওপি) পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে, চলতি অর্থবছরের জুলাই থেকে মার্চ—এই ৯ মাসে এফডিআইয়ের নিট প্রবাহ ছিল ৮৬ কোটি ১০ লাখ ডলার। ২০২৩-২৪ অর্থবছরের একই সময়ে তা ছিল ১১৬ কোটি ৪০ লাখ ডলার। এ হিসাবে চলতি অর্থবছরের ৯ মাসে এফডিআইয়ের নিট প্রবাহ কমেছে ২৬ শতাংশ।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যই বলছে, চলতি অর্থবছরের প্রথম ৯ মাসে মূলধনী যন্ত্র আমদানির ঋণপত্র নিষ্পত্তি বা আমদানি বাবদ অর্থ পরিশোধ হয়েছে ১৫২ কোটি ১৫ লাখ ৫০ হাজার ডলারের। গত অর্থবছরের একই সময়ে তা হয়েছিল ২১৩ কোটি ৩৩ লাখ ডলারের। অর্থাৎ মূলধনী যন্ত্র আমদানি কমেছে ২৮.৬৮ শতাংশ।
বিনিয়োগ থাকলেই তো নিয়োগ, ফ্যাক্টরি স্থাপন, যন্ত্রপাতি আমদানির পর্ব চলে। স্থানীয় বিনিয়োগকারীদের কাছে এসংক্রান্ত তথ্যসাবুদ আরো বেশি আছে। নিজ গরজেই তা জোগাড় রাখেন তাঁরা। দেশি আর বিদেশি—সব বিনিয়োগকারীই উচ্চ সুদ, বিদ্যুৎ, জ্বালানি, পরিবহন ব্যয়, রাজনৈতিক পরিস্থিতিকে মাপেন একই পাল্লায়। লগ্নি করা বিনিয়োগের গ্যারান্টি উভয়েরই কাম্য। সেই ভরসার জাগতিক জায়গা ফাঁপা রেখে বিনিয়োগ দূরে থাক, যা আছে তা রক্ষা করাই কঠিন।
লেখক : সাংবাদিক-কলামিস্ট; ডেপুটি হেড অব নিউজ, বাংলাভিশন
বিডি প্রতিদিন/নাজিম