নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের ১০টি সুপারিশের বিষয়ে ভিন্নমত পোষণ করেছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। জাতীয় ঐকমত্য কমিশনকে চিঠি দিয়ে ১০ বিষয়ে ৫৭টি মতামত ও চারটি পর্যবেক্ষণ তুলে ধরেছে ইসি। নির্বাচন কমিশন মনে করে, এসব সুপারিশ বাস্তবায়িত হলে ইসির স্বাধীনতা খর্ব হবে। আবার অনেক সুপারিশকে অপ্রয়োজনীয় ও অযৌক্তিক বলে মত দিয়েছে কমিশন।
গতকাল জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজকে পাঠানো চিঠি থেকে জানা গেছে, নির্বাচন কমিশন ১০টি বিষয়ে ভিন্নমত পোষণ করেছে। এর মধ্যে রয়েছে- নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব; ইসির দায়বদ্ধতা; তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা; সংসদীয় এলাকার সীমানা নির্ধারণ; আঞ্চলিক নির্বাচনি এলাকার সীমানা নির্ধারণ পদ্ধতি; জাতীয় পরিচয়পত্র ও ভোটার তালিকা; প্রার্থীদের যোগ্যতা-অযোগ্যতা; মনোনয়নপ্রত্র; জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচন; ইসির আর্থিক স্বাধীনতা ও ইসির সংঘটিত অপরাধ; আরপিও বিভিন্ন সংশোধনের বিষয় রয়েছে।
নির্বাচন কমিশনের দায়িত্বসংক্রান্ত সংস্কার কমিশনের সুপারিশ ‘জাতীয় নির্বাচন শেষ হওয়ার ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে, ফলাফল গেজেটে প্রকাশের আগে, নির্বাচন কমিশন কর্তৃক নির্বাচনের সুষ্ঠুতা, বিশ্বাসযোগ্যতা এবং গ্রহণযোগ্যতা সম্পর্কে ‘সার্টিফাই’ করে তা গণবিজ্ঞপ্তি আকারে প্রকাশের বিধান করা।’ এ বিষয়ে ভিন্নমত পোষণ করে ইসি এ বিষয়কে ‘অপ্রয়োজনীয় ঘোষণা’ বলে চিঠিতে স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছে। বলা হয়েছে, কমিশন সন্তুষ্টু হয়েই গেজেট প্রকাশ করে।
‘নির্বাচনের সুষ্ঠুতা, বিশ্বাসযোগ্যতা এবং গ্রহণযোগ্যতা সম্পর্কিত নির্বাচন কমিশনের ঘোষণায় নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী কোনো রাজনৈতিক দল সংক্ষুব্ধ হলে সেই দলের পক্ষ থেকে ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিল বা সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে অভিযোগ করার সুযোগ সৃষ্টির বিধান করা। কমিশন/আদালত কর্তৃক সর্বোচ্চ ৭ কার্যদিবসের মধ্যে ওই অভিযোগ নিষ্পত্তি করার বিধান করা।’ এই সুপারিশের বিষয়ে ইসি বলেছে, এই বিধান করা হলে নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ করার সুযোগ সৃষ্টি হবে।
‘নির্বাচন কমিশনের আইনি, আর্থিক ও প্রশাসনিক প্রস্তাব কোনো মন্ত্রণালয়ের পরিবর্তে সংসদের প্রস্তাবিত উচ্চকক্ষের (যদি না হয়, তাহলে বিদ্যমান সংসদের অনুরূপ) স্পিকারের নেতৃত্বে একটি সর্বদলীয় সংসদীয় কমিটির নিকট উপস্থাপনের বিধান করা। (সংসদীয় কমিটি নির্বাচন কশিমনের সঙ্গে আলোচনার ভিত্তিতে প্রস্তাবগুলো সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য প্রেরণ করবে।)’ এই সুপারিশের বিষয়ে ইসি বলেছে, (১) এটি সংসদীয় কমিটির কাজ নয়; এটি একটি নির্বাহী কাজ। (২) এতে করে উদ্দেশ্যমূলক প্রভাব বাড়ার সুযোগ সৃষ্টি হবে। (৩) কাজের ধাপ এবং সময় বাড়বে বৈ কমবে না। (৪) সংবিধানের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে রাষ্ট্রপতির সচিবালয়ের মাধ্যমে প্রক্রিয়া করা যেতে পারে।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার মেয়াদ চার মাস নির্ধারিত করে এ মেয়াদকালে জাতীয় ও স্থানীয় সরকারের সব নির্বাচন সম্পন্ন করা-সংক্রান্ত সুপারিশের বিষয়ে ইসি বলেছে, এত কম সময়ে সব নির্বাচন অনুষ্ঠান সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করা সম্ভবপর হবে না বলে ইসি মনে করে। অতীতের অভিজ্ঞতায় ধাপে ধাপে স্থানীয় সরকারের সব নির্বাচন সম্পন্ন করতে গড়ে প্রায় ১ (এক) বছর সময় লেগেছে।
ভবিষ্যতে সীমানা নির্ধারণের জন্য একটি আলাদা স্বাধীন সীমানা নির্ধারণ কমিশন গঠন করা-সংক্রান্ত সুপারিশের বিষয়ে ইসি বলেছে, (১) এটি নির্বাচন কমিশনের অন্যতম সাংবিধানিক দায়িত্ব; এটি সরিয়ে নিলে কমিশনের সাংবিধানিক ক্ষমতা খর্ব করা হবে। (২) নির্বাচন কমিশন নিজেই স্বাধীন সত্তা। (৩) নির্বাচন কমিশন দীর্ঘ সাড়ে পাঁচ দশকে অভিজ্ঞতা, দক্ষতা এবং প্রাতিষ্ঠানিক মেমোরি অর্জন করেছে।
(৪) সীমানা নির্ধারণে বহুবিধ বিষয় বিবেচনায় নিতে হয় এবং গণশুনানি করতে হয়। এ কাজে নির্বাচন কমিশনই যৌক্তিক এবং সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। (৫) অযথা সময়ক্ষেপণ হবে এবং জটিলতা তৈরি করবে। জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচনের আয়োজন করা-সংক্রান্ত সুপারিশের বিষয়ে ইসি বলেছে, জাতীয় নির্বাচন বিলম্বিত হবে।
এদিকে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজকে চিঠি পাঠানোর বিষয়ে ইসি সচিবালয়ের সিনিয়র সচিব আখতার আহমেদ বলেন, নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের ৯-১০টি সুপারিশের বিষয়ে ভিন্নমত জানিয়ে ঐকমত্য কমিশনের কাছে চিঠি দেওয়া হয়েছে। সংস্কার কমিশনের সুপারিশে সংসদীয় আসনের সীমানা নির্ধারণে একটি স্বতন্ত্র কমিশন করার কথা বলা হয়েছে। নির্বাচন কমিশন বলেছে, এটির প্রয়োজন নেই। সংস্কার কমিশনের সুপারিশে সংসদীয় আসনের সীমানা নির্ধারণে একটি স্বতন্ত্র কমিশন করার কথা বলা হয়েছে। নির্বাচন কমিশন বলেছে, এর প্রয়োজন নেই। সংস্কার কমিশনের সুপারিশে আসন সীমানা পুনর্নির্ধারণের যে ফর্মুলার কথা বলা হয়েছে, সেটি হলে শহর অঞ্চলে আসন বেড়ে যাবে, বলেন আখতার আহমেদ। ইসি মনে করে, ভোটার সংখ্যা এবং আঞ্চলিক অখণ্ডতা বিবেচনা করে সংসদীয় আসনের সীমানা পুনর্নির্ধারণ করা উচিত। ইসি সচিব বলেন, ভোটের পর ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে ‘সার্টিফাই’ করার বিষয়ে একটি সুপারিশ করা হয়েছে, যেখানে বলা হবে ‘সুষ্ঠুভাবে নির্বাচন হয়েছে’। নির্বাচন কমিশন মনে করে, এর প্রয়োজন নেই। কারণ ফলাফলের যে গেজেট প্রকাশিত হয়, সেটাই সার্টিফিকেশন। নির্বাচন কমিশনের দায়বদ্ধতা ও নির্বাচন কমিশনারদের শাস্তির বিষয়ে সংস্কার কমিশন যে সুপারিশ করেছে, তাতেও ভিন্ন মত রয়েছে।
ইসি সচিব বলেন, রিটার্নিং অফিসার সন্তুষ্ট হয়েই ফলাফল ঘোষণা করেন। ভোটের পর তদন্ত করে দোষী প্রমাণিত হলে কমিশনারদের শাস্তির সুপারিশ করেছে সংস্কার কমিশন। এ বিষয়ে নির্বাচন কমিশনের আপত্তি তুলে ধরে আখতার আহমেদ বলেন, এজন্য একটি ব্যবস্থা এখনই রয়েছে, সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল আছে। যদি নির্বাচন শেষ হওয়ার পাঁচ বছর ১০ বছর পর নির্বাচন কমিশনারদের আদালতে দৌড়াতে হয়, সেটি কি যৌক্তিক হবে? নির্বাচনে জয়ী হবেন একজন, বাকিরা সংক্ষুব্ধ হয়ে যে কোনো অভিযোগই করতে পারেন। এ ছাড়া জাতীয় পরিচয়পত্র সেবা নির্বাচন কমিশনের কাছে থাকা উচিত বলেও কমিশন মত দিয়েছে।