গত বছরের জুলাই-আগস্টে সংঘটিত ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা সরকারের পতন ঘটার ৯ মাস পেরিয়ে গেলেও মানুষের যে আশাবাদ ছিল তা পূরণ করা মোটেও সহজ হচ্ছে না। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস নিজেও স্বীকার করেছেন, ‘যা কিছু ধ্বংস হয়েছে, আমরা তা মেরামত করার চেষ্টায় আছি। জনগণ আমাদের সঙ্গে আছে। আমরা আশাবাদী। তবে এই আশাবাদ বাস্তবায়ন মোটেও সহজ হচ্ছে না।’ সূত্র : দি ইকোনমিস্ট
বাংলাদেশ পরিস্থিতি নিয়ে গত বৃহস্পতিবার প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ও শান্তিতে নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, ১৬ বছরের একটানা ‘ভূমিকম্পের’ মতো আতঙ্কের রাজনৈতিক শাসনের পর বাংলাদেশের সামনে এখন এক নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হয়েছে।
গত বছর প্রকাশিত সরকারের এক শ্বেতপত্রে অভিযোগ করা হয়, তার (শেখ হাসিনা) শাসনামলে বছরে প্রায় ১ হাজার ৬০০ কোটি ডলার পাচার করা হয়েছিল। শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে হত্যা, অপহরণ ও জেনোসাইডসহ (গণহত্যা) বিভিন্ন অভিযোগে মামলার সংখ্যা ক্রমেই বাড়ছে (তিনি সব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন)। ক্ষমতার এমন অপব্যবহারের পুনরাবৃত্তি রোধে বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিসরের সব দলই গণতান্ত্রিক পরিবর্তনের দাবি জানিয়েছে। তবে বিপ্লবের ৯ মাস পেরিয়ে গেলেও বড় ধরনের পরিবর্তন আনা সহজ হচ্ছে না। প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে ভারতে পালিয়ে যাওয়ার পরপরই এই প্রক্রিয়া শুরু হয়। গত সেপ্টেম্বরে অধ্যাপক ইউনূস বিভিন্ন ক্ষেত্রে যেমন নির্বাচন, বিচারব্যবস্থা, সংবিধান-সংস্কারের জন্য সুপারিশ দিতে কমিশন গঠন করতে শুরু করেন। এই কমিশনগুলোতে রয়েছেন নাগরিক সমাজ ও একাডেমিক অঙ্গনের বিশেষজ্ঞরা। এসব কমিশনের সুপারিশ পর্যালোচনার জন্য অন্তর্বর্তী সরকার আরেকটি কমিশন (জাতীয় ঐকমত্য কমিশন) গঠন করে। জাতীয় ঐকমত্য কমিশন এখন পর্যন্ত মোট ১৬৬টি সুপারিশ একত্র করেছে। সেগুলোকে একটি স্পেডশিটে তালিকাভুক্ত করে মতামতের জন্য বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের কাছে পাঠিয়েছে। এখন পর্যন্ত ৩৫টি রাজনৈতিক দল মতামত দিয়েছে। এই ঐকমত্য কমিশন রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করে একটি ‘জুলাই সনদ’ তৈরি করবে, যা নির্বাচন আয়োজনের পথ সুগম করবে এবং একটি ‘নতুন বাংলাদেশ’ গড়ার সূচনা করবে বলে উল্লেখ করেন অধ্যাপক ইউনূস।
কিন্তু ঐকমত্যে পৌঁছানোটা সহজ ব্যাপার নয়। প্রথমত, কোন কোন কমিশন থাকা উচিত, তা নিয়ে রাজনীতিক ও সাধারণ মানুষের মধ্যে মতপার্থক্য রয়েছে। কেউ কেউ বলছেন, বাংলাদেশের অর্থনীতির মূল খাত তৈরি পোশাকশিল্পের জন্য একটি কমিশন থাকা উচিত ছিল। আবার অনেকেই শিক্ষা খাত নিয়ে অবহেলার অভিযোগ তুলেছেন। বিলম্বে গঠিত নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশন ঘিরে সবচেয়ে বড় বিতর্ক তৈরি হয়েছে। নারীদের আরও বেশি অধিকার দিতে এই কমিশনের সুপারিশে ইসলামি উত্তরাধিকার আইনে পরিবর্তনের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে, যার বিরুদ্ধে ইসলামপন্থি দলগুলো ব্যাপক বিক্ষোভ করেছে।
তবু সংস্কার কমিশনের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিরা আশাবাদী। জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ এরই মধ্যে বাস্তবায়িত কিছু পরিবর্তনের কথা উল্লেখ করেছেন, যেমন হাই কোর্টে বিচারপতি নিয়োগের জন্য একটি স্বাধীন প্রক্রিয়া। জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সংলাপের দ্বিতীয় পর্ব ১৫ মের পরপরই শুরু হবে। তবে আগামী আগস্টের মধ্যে একটি সনদ চূড়ান্ত হওয়ার বিষয়ে আত্মবিশ্বাসী অধ্যাপক আলী রীয়াজ।
যদি এই সময়সূচি অনুযায়ী সবকিছু এগোয়, তাহলে এ বছরের ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে পারে। অধ্যাপক ইউনূস দৃঢ়ভাবে বলেছেন, ২০২৬ সালের জুনের মধ্যে নির্বাচন হবে (এবং তিনি নির্বাচনে অংশ নেবেন না)। তবে এই বিলম্বের কিছু মূল্য এরই মধ্যে গুনতে হচ্ছে। অন্তর্বর্তী সরকার মূল্যস্ফীতি ও ব্যাংকব্যবস্থাকে স্থিতিশীল করেছে। তবে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি দুর্বলই রয়ে গেছে। রাজনৈতিক পরিস্থিতিও নাজুক। এক জরিপ অনুযায়ী, জরিপে অংশগ্রহণকারীদের প্রায় ৬০ শতাংশ মনে করেন, সরকার পরিবর্তনের পর থেকে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি হয়নি। রাস্তায় বিক্ষোভ-প্রতিবাদ নিয়মিত ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিক্ষোভকারীদের সবচেয়ে সাধারণ দাবি হলো- আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া। ১২ মে নির্বাচন কমিশন (ইসি) আওয়ামী লীগের নিবন্ধন স্থগিত করে। যে কোনো নির্বাচনে দলটির অংশগ্রহণ নিষিদ্ধ করে ইসি। তবে আওয়ামী লীগের প্রতি ব্যাপক বিরূপ মনোভাব থাকা সত্ত্বেও দলটির এখনো কিছুটা সমর্থন রয়েছে। আওয়ামী লীগ নেতা মোহাম্মদ এ আরাফাত জোর দিয়ে বলেন, দলটির প্রতি ‘জনগণের ম্যান্ডেট’ ছিল। কিন্তু ‘জিহাদিরা’ সহিংসতার মাধ্যমে ক্ষমতা দখল করেছে। তারা (আওয়ামী লীগ) ‘বাংলাদেশে নিজেদের ন্যায্য স্থান পুনরুদ্ধারের জন্য লড়বে’।