সে বহুকাল আগের কথা। আজ থেকে প্রায় ২৬০০ বছর আগে পৃথিবীতে দুটি পরাক্রমশালী রাজ্য ছিল। রাজ্য বললে ভুল হবে-ওগুলো ছিল প্রাচীন দুনিয়ার সবচেয়ে বড় সাম্রাজ্য। একটির নাম লিডিয়া এবং অপরটির নাম ছিল মিডিয়া। সাম্রাজ্য দুটির একাংশ যদিও আজকের চীন-ভারতের মতো লাগোয়া ছিল কিন্তু অপর অংশগুলোর বিস্তৃতি এত বিশাল ও ব্যাপক ছিল, যা আজকের জমানায় অনেককেই হতবাক করে যে এত বড় সাম্রাজ্য শত শত বছর ধরে বংশ পরম্পরায় কীভাবে ন্যায়বিচার-সুশাসন-প্রজ্ঞাপালন এবং জনকল্যাণে যে শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করেছিল তা মধ্যযুগ কিংবা আধুনিককালেও কেন সম্ভব হচ্ছে না।
আজকের নিবন্ধে লিডিয়া ও মিডিয়া সাম্রাজ্যের কথা কেন মনে পড়ল তা নিয়ে সংক্ষেপে আলোচনা করে মূল প্রসঙ্গে চলে যাব। আওয়ামী সরকার তথা সদ্য সাবেক ফ্যাসিবাদী সরকারের মন্ত্রী নুরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ুনের মৃত্যু, তার দাফনকাফন এবং বাংলার কিংবদন্তি রাজনীতিবিদ তোফায়েল আহমেদের জানাজা নিয়ে যা শুনেছি তা লেখার মতো ভাষা কিংবা অভিরুচি নেই। সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে যেভাবে অশ্লীলতা-অশ্রাব্যতা এবং জন্তু-জানোয়ারের চেয়েও নিকৃষ্ট মানুষরূপীদের দাপট-প্রভাব প্রতিপত্তি যেভাবে বেড়ে চলেছে তাতে করে আমাদের সভ্যতা ও সংস্কৃতির মানদণ্ডের সঙ্গে মানুষ নামের যে প্রাণিকুলের সম্পর্ক কীভাবে শেষ হয়ে যাচ্ছে তা বোঝানোর জন্যই ২৬০০ বছর পূর্বেকার দুটি প্রবল পরাক্রান্ত এবং পরস্পরের প্রতিদ্বন্দ্বী সাম্রাজ্যের সম্রাট এবং তাদের পাইক-পেয়াদা সৈন্যসামন্ত এবং রাজদরবারের কাহিনি আপনাদের শোনাব।
লিডিয়া ও মিডিয়ার কাহিনি শুরু মহামতি সোলনকে নিয়ে। গ্রিক নগর রাষ্ট্র যখন গণতন্ত্রের চর্চা শুরু করেছে তখন সেখানকার শাসকরা জনগণের জন্য একটি সংবিধান রচনার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করলেন। গ্রিসের এথেন্স নগরীতে যেসব মহামানব বাস করতেন তাদের মধ্যে সোলন ছিলেন অন্যতম। এথেন্সের শাসকবর্গ যারা জনগণ কর্তৃক নির্বাচিত হতেন এবং যাদের সংখ্যা ছিল সাতজন, তারা প্রায়ই শাসনকার্য পরিচালনা করতে গিয়ে বিতর্কে জড়াতেন। এই সমস্যা সমাধানের জন্য তারা মানবজাতির ইতিহাসে প্রথমে বিধিবদ্ধ সংবিধান রচনার বিষয়ে একমত হলেন এবং তা রচনার জন্য মহাজ্ঞানী সোলনের কাছে ধরনা দিলেন।
শাসকবর্গের অনুরোধের পরিপ্রেক্ষিতে সোলন শর্ত দিলেন যে তার রচিত সংবিধান আগামী ১০ বছরের মধ্যে পরিবর্তন করা যাবে না। শাসকবৃন্দ রাজি হলেন এবং সোলন যথাসম্ভব দ্রুত একটি সংবিধান রচনা করে তা এথেন্সবাসীর গণভোট, এথেন্স পার্লামেন্ট এবং মন্ত্রিপরিষদের মাধ্যমে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ আইন হিসেবে স্বীকৃতি আদায় করে ১০ বছরের জন্য দেশত্যাগ করে বিশ্বভ্রমণে বের হলেন, যাতে এথেন্সের শাসকবর্গ সংবিধান পরিবর্তনের জন্য তার কাছে ধরনা দিতে না পারে।
বিশ্বভ্রমণে বের হয়ে সোলন তৎকালীন দুনিয়ার শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি ও সভ্যতার পাদপীঠ বলে পরিচিত বড় বড় নগর-বন্দর ভ্রমণ শেষে লিডিয়া রাজ্যে উপস্থিত হলেন। এখানে একটি বিষয় বলে নেওয়া ভালো যে সোলন তৎকালীন দুনিয়ার শ্রেষ্ঠতম কবি-দার্শনিক, আইনজ্ঞ, রাজনীতিবিদ এবং রাজপুরুষ হিসেবে মশহুর ছিলেন। অন্যদিকে লিডিয়া ছিল পৃথিবীর সবচেয়ে ধনী, সভ্য এবং বসবাস উপযোগী আকর্ষণীয় শহর। লিডিয়া সম্রাট ক্রেসাস ছিলেন তৎকালীন জমানার সবচেয়ে কুলীন শাসক যার বংশমর্যাদা, শিক্ষাদীক্ষা, ভালোমানুষী স্বভাব, ন্যায়বিচার, ধর্মপরায়ণতা ইত্যাদি গুণাবলির কারণে সমসাময়িক পৃথিবী তাকে সম্মান ও মর্যাদার সর্বোচ্চ আসনটি দিয়েছিল। তো সেই লিডিয়াতে যখন সোলন পৌঁছলেন তখন সারা রাজ্যে হইচই পড়ে গেল এবং সেই খবর রাজদরবার অবধি পৌঁছাল।
আমির-ওমরাহরা সম্রাট ক্রেসাসের কাছে গেলেন এবং সোলনকে রাজদরবারে আমন্ত্রণ জানিয়ে সংবর্ধনা দিতে চাইলেন, সম্রাট সোলনকে কেবল রাজদরবার নয়, তার অন্তঃপুর অর্থাৎ হারেমেও নৈশভোজের দাওয়াত দিলেন। যথারীতি রাজদরবারের আনুষ্ঠানিকতা শেষে সোলন এবং সম্রাট ক্রেসাস রাতে নৈশভোজের টেবিলে মিলিত হলেন এবং সেখানে এমন কিছু ঘটল যা এযাবৎকালে কোনো রাজ অন্তঃপুরে ঘটেনি। সে রাতে সোলন যা বললেন তা পৃথিবীর কোনো মহাজ্ঞানী এযাবৎকালে বলেননি। অন্যদিকে সম্রাট ক্রেসাস যা করলেন তা-ও কোনো সম্রাট বা রাজাধিবাজ আজ অবধি করেননি।
নৈশভোজের আনুষ্ঠানিকতা শুরুর পূর্বে সোলনকে পুরো প্রাসাদ ঘুরিয়ে দেখানো হলো-রাজার সুন্দরী স্ত্রীবৃন্দ, দাস-দাসী, হাতি-ঘোড়া, রাজকোষের মণিমানিক্যসহ রাজবংশের ৩০০ বছরের বর্ণাঢ্য ইতিহাস-কোনো কিছুই বাদ পড়ল না। খাবার টেবিলে দুনিয়ার শ্রেষ্ঠতম খাবার খেতে খেতে সম্রাট ক্রেসাস বললেন, ওহে মহাজ্ঞানী সোলন, আপনি তো দুনিয়ার বহু দেশ ভ্রমণ করেছেন, বহু মানুষ দেখেছেন এবং বহু কাহিনি শুনেছেন। এবার বলুন তো আপনার দৃষ্টিতে পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষটি কে? সোলন ঝটপট একজন অখ্যাত ব্যক্তির নাম বলে দিলেন। সম্রাট হতাশ হলেন, কারণ তিনি আশা করেছিলেন যে সুখী মানুষ হিসেবে সোলন তার নামটি বলবেন। সম্রাট দ্বিতীয় সুখী ব্যক্তির নাম জিজ্ঞাসা করলেন এবং সোলন এবারও অন্য একজনের নাম বললেন। মনের দুঃখ চেপে রেখে সম্রাট তৃতীয় সুখী মানুষের নাম জিজ্ঞাসা করে যখন নিজের নামটি শুনলেন না তখন বললেন, ‘মহাত্মন! আমার ৩০০ বছরের পুরোনো রাজবংশ-পৃথিবীর একক বৃহত্তম ভূমির ওপর কর্তৃত্ব। ১৫ বছর ধরে আমার শান্তিপূর্ণ সুশাসন, পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী সেনাবাহিনী, দক্ষ রাজকর্মচারী, ধনসম্পদে পরিপূর্ণ রাজকোষ, আমার যুদ্ধবিদ্যা এবং যুদ্ধজয়ের ব্যাপক সাফল্য, সুস্বাস্থ্য, সুসন্তান, সুন্দরী রানি ইত্যাদি-দেখার পরও কেন আমাকে আপনার কাছে সুখী মানুষ বলে মনে হচ্ছে না।’
সম্রাটের কথা শুনে মহামতি সোলন বললেন, রাজাধিরাজ। সুখী মানুষ হিসেবে আমি যাদের নাম বলেছি তারা সবাই মৃত। তারপর তিনি সেই তিনজন সুখী ব্যক্তির সুখের কারণ বর্ণনা করে বললেন, জীবিত মানুষকে কখনো সুখী বলা যায় না। কারণ জীবনের শেষ প্রান্তে কখনো কখনো এমন ঘটনা ঘটে যা একজন জনমদুখী মানুষকে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সুখী মানুষে পরিণত করে। আবার সারা জীবনে সুখসম্পদ বিত্তবৈভবের মধ্যে কাটানো মানুষটির জীবনসায়াহ্নে এমন ঘটনা ঘটে যে তার সারা জীবনের অর্জন চিতার আগুনে ছারখার হয়ে তাকে জনমদুখী কপাল পোড়া মানুষের পরিণত করে।
মহাজ্ঞানী সোলনের কথা শুনে সম্রাট ক্রেসাস মেজাজ হারালেন। তিনি উত্তেজিত হয়ে বললেন, ‘আমি আপনাকে আমার সর্বোচ্চ চেষ্টা-তদবির দ্বারা আজ সারা দিন এবং এখন পর্যন্ত সম্মানিত আহ্লাদিত এবং তৃপ্ত করার চেষ্টা করছি আর আপনি নিষ্ঠুরতম কথা বলে আমার সারা জীবনের অর্জন, বিশ্বাস ও ভালোবাসাকে চিতার আগুনে নিক্ষেপ করলেন। আমি মানুষ সম্পর্কে মন্দ চিন্তা করতে শিখিনি-কোনো মানুষকে তিরস্কার করিনি, কিন্তু আপনাকে দেখার পর মনে হচ্ছে আপনার মতো বজ্জাত, অকৃতজ্ঞ, অভদ্র এবং মন্দ চিন্তার মানুষ দ্বিতীয়টি নেই। কারণ আপনি আমার খাবার টেবিলে বসে, আমার দেওয়া খাবার খেতে খেতে ভাবছেন যে আমার জীবনের শেষ প্রান্তে এমন কিছু ঘটবে যা আমার সবকিছু চিতার আগুনে জ্বালিয়েপুড়িয়ে ছারখার করে দেবে।’ এই কথা বলে সম্রাট ক্রেসাস মহামতি সোলনকে অপমান করে, রাজপ্রাসাদ থেকে তাড়িয়ে দিলেন।
উল্লেখিত ঘটনার কয়েক মাস পরে সম্রাট ক্রেসাস জানতে পারেন যে তার সাম্রাজ্যের এক প্রান্তে সাইরাস নামের এক তরুণ রাজার আবির্ভাব ঘটেছে এবং সাইরাস দুর্দান্ত গতিতে তার রাজ্য মিডিয়াকে একটি সাম্রাজ্য বানানোর পরিকল্পনা করছেন। সম্রাট ক্রেসাসের গোয়েন্দারা যখন এমন তথ্য পেশ করল তখন মিডিয়া ও লিডিয়ার আয়তন, ক্ষমতা, শক্তিমত্তার তুলনা অনেকটা ভারত বনাম ভুটান অথবা আমেরিকা বনাম কিউবার মতো ছিল। তারপরও সম্রাট ক্রেসাসের মধ্যে হিংসা-ক্রোধ-ঈর্ষার দাবানল জ্বলে উঠল। তিনি সাইরাসকে দমন করার জন্য ৫৪৭ খ্রিস্টপূর্বাব্দে বিশাল এক সৈন্যবাহিনী নিয়ে মিডিয়ার দিকে অগ্রসর হলেন।
সম্রাট ক্রেসাস তার রাজধানী সার্ডিস থেকে মিডিয়া রাজ্যের সীমানায় হ্যালিস নদীর তীরে উপস্থিত হন এবং চূড়ান্ত আক্রমণের পূর্বে ডেলফির মন্দিরের ভবিষ্যদ্বাণীর জন্য অপেক্ষা করেন। মন্দিরের পূজারিরা সাংকেতিক ভাষায় উত্তর পাঠান যা সম্রাট ক্রেসাস ধরে নেন যে তিনিই বিজয়ী হবেন। ফলে হ্যালিস নদী পার হয়ে তিনি অতর্কিত হামলা চালাতে গিয়ে মিডিয়ার রাজা সাইরাসের হাতে বন্দি হন। এ খবর লিডিয়ার সৈন্যদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়লে শুরু হয় ভয়ানক বিশৃঙ্খলা এবং সৈন্যরা ছত্রভঙ্গ হয়ে দিগি¦দিক পালাতে আরম্ভ করেন।
পরাজিত এবং বন্দি সম্রাট ক্রেসাসের হাতে-পায়ে শিকল পরানো হয় এবং বিজয়ী সম্রাট সাইরাস জ্বলন্ত চিতায় সম্রাট ক্রেসাসকে জীবন্ত পুড়িয়ে মারার হুকুম জারি করেন। বিজয়ীর হুকুমে দাউ দাউ করে জ্বলে ওঠে চিতার আগুন। শিকলে আবদ্ধ পরাজিত সম্রাট অবনত মস্তকে ধীরলয়ে চিতার দিকে এগোতে থাকেন এবং কয়েক মাস আগে মহামতি সোলনের কথাগুলো স্মরণ করেন। তারপর আসমানের দিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করে বলতে থাকেন- ‘এ-ও কি সম্ভব’।
লেখক : সাবেক সংসদ সদস্য ও রাজনীতি বিশ্লেষক