আশুরা শব্দটি এসেছে আরবি আশারা থেকে। যার অর্থ দশ। প্রচলিত অর্থে ১০ মহররমকে আশুরা বলা হয়। আশুরার রোজা রাখা সুন্নত, এ রোজা আমরা কমবেশি অনেকেই রাখি। সন্দেহাতীতভাবে এটা গুরুত্বপূর্ণ আমল। কিন্তু আশুরার চেতনা ধারণ ও চেতনাকে উপলব্ধি করেন এমন মানুষের সংখ্যা খুবই কম। আশুরা আমাদের শেখায় চূড়ান্ত বিজয় সত্যের। আর চূড়ান্ত পরাজয় অসত্যের।
১০ মহররম তথা আশুরার দিনে অত্যাচারী ফেরাউন ও তার বাহিনীর করুণ সলিল সমাধি ঘটে আর মুসা (আ.) ও তাঁর উম্মত ফেরাউনের অত্যাচার থেকে মুক্তি পান। ফেরাউনের প্রভাব-প্রতিপত্তি, ক্ষমতার দাপট, অর্থের প্রাচুর্য দেখে অনেক মানুষ তার দলে ভিড়েছিল। কিন্তু তাদের মাঝে কোনো আদর্শিক চেতনা ছিল না। স্রেফ ক্ষমতাসীনের পক্ষে থাকার লোভে, পার্থিব সুযোগসুবিধা পাওয়ার আকাক্সক্ষায় তারা অত্যাচারী ফেরাউনের পক্ষাবলম্বন করেছে। অথচ এটা মহৎ মানুষের আলমত নয়। মহৎ মানুষ তো তিনি, যিনি জালিমের পক্ষে নয়, মজলুমের পক্ষে দাঁড়ান। একজন মানুষ, তিনি দরিদ্র ও দুর্বল, তার পক্ষাবলম্বন করলে পার্থিব কোনো লাভ নেই, কিন্তু যখন আমি জানব তিনি মজলুম, তখন আমাকে তার পক্ষ নিতে হবে, তার পাশে দাঁড়াতে হবে। ক্ষমতাসীনের পক্ষে থাকার লোকের অভাব হয় না। কিন্তু দুর্বলের পক্ষে থাকার মতো মানুষের বড় অভাব। আপাত দৃষ্টিতে মুসা (আ.) ছিলেন দুর্বল। কিন্তু তাঁর আদর্শকে ভালোবেসে একদল মানুষ তাঁর সঙ্গী হয়েছিল। বিনিময়ে তারা অনেক জুলুম-নিপীড়ন-অত্যাচারের শিকার হয়েছেন। কিন্তু মুসা (আ.)-এর আদর্শকে তারা ত্যাগ করেননি। বরং জুলুম যত বেড়েছে, তাদের ইমান তত শক্তিশালী হয়েছে। শুধু মুসা (আ.) নন, যুগে যুগে যত নবী-রসুল পৃথিবীতে এসেছেন, প্রায় সবাই দুর্বল ছিলেন। দুর্বল ছিলেন তাদের অনুসারীরাও। কিন্তু শত নির্যাতনের পরও উম্মতেরা তাদের নবীর সঙ্গ ত্যাগ করেননি। এটাই আশুরার চেতনা। কেউ ভ্রান্ত পথের পথিক হলে তাকে উপেক্ষা করা আশুরার শিক্ষা। আবার সত্য পথের পথিকের পক্ষাবলম্বন ও সমীহ করা আশুরার শিক্ষা। কিন্তু আমরা খুব কম মানুষই বিষয়টি উপলব্ধি করতে পারি। আর এ গাফিলতি ও উদাসীনতার বিষয়টিই মহান আল্লাহ কোরআনের পাতায় পাতায় উল্লেখ করেছেন এভাবে : তোমরা কি উপলব্ধি করবে না! তোমরা কি শিক্ষা নেবে না!
ফেরাউন ও তার বাহিনীর সলিল সমাধি ছিল গোটা পৃথিবীবাসীর জন্য শিক্ষা। কেয়ামত পর্যন্ত অনাগত বিশ্ববাসীর শিক্ষার নিদর্শন হিসেবে আল্লাহ ফেরাউনের লাশকে সংরক্ষণ করেছেন। এ মর্মে তিনি বলেছেন, আজ আমি তোমার দেহকে রক্ষা করব, যাতে তুমি তোমার পরবর্তী লোকদের জন্য এক নিদর্শন হয়ে থাক। তবে অধিকাংশ মানুষ আমার নিদর্শনগুলোর প্রতি উদাসীন। (ইউনুস ৯২)।
আশুরার সর্বশেষ বড় ঘটনা কারবালা। এখানেও আমরা দেখি, চূড়ান্ত বিজয় হয়েছে সত্যের আর চূড়ান্ত পরাজয় ঘটেছে অসত্যের। হোসাইন (রা.)কে সপরিবারে শহীদ করে দিয়ে ইয়াজিদ হয়তো ভেবেছিল, সে বিজয়ী হয়েছে আর হোসাইন (রা.) পরাজিত হয়েছেন। কিন্তু বাস্তবতা কী? বাস্তবতা হলো, হোসাইন (রা.)-এর খুনিরা আজ সারা পৃথিবীতে ধিক্কৃত আর হোসাইন (রা.) সারা পৃথিবীতে সমাদৃত। হোসাইন (রা.) নিজের আদর্শের ওপর অধিষ্ঠিত থাকার কারণে মরেও তিনি অমর হয়েছেন। বিপরীতে সাময়িকের বিজয়ী ইয়াজিদ ও তার বাহিনী সারা পৃথিবীর কাছে ঘৃণীত হয়েছে। পৃথিবীতে এমন বহু বিজয় আছে যার পেছনে লুকিয়ে থাকে পরাজয়। আবার অনেক পরাজয় এমন আছে, যার পেছনে লুকায়িত থাকে মহাবিজয়। এ জন্য একজন ইমানদার বাহ্যিক জয়-পরাজয়ের চেয়ে তার আদর্শিক অবস্থানকে সব সময় দৃঢ় করবে। এটাই আশুরার অন্যতম শিক্ষা। রোজা রাখা আশুরার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আমল। নবীজি (সা.) বলেছেন, আমি আল্লাহর কাছে আশা করি, তিনি এর (আশুরার রোজা) দ্বারা আগের এক বছরের (সগিরা) গুনাহগুলো ক্ষমা করে দেবেন। (মুসলিম)। তবে শুধু একদিন নয়, আশুরার দিনের সঙ্গে আগে-পিছে আরেকটি রোজা রাখা নবীজির সুন্নত। একদিন অতিরিক্ত রোজা রাখার কারণ হলো ইহুদিদের আমলের বিরোধিতা করা এবং মুসলমানদের নিজস্বতা ও স্বাতন্ত্র্য বজায় রাখা। কেননা মুসা (আ.)-এর মুক্তির খুশিতে এদিন ইহুদিরাও রোজা রাখত। এ ঘটনায় আমাদের জন্য শিক্ষার অনেক বড় খোরাক রয়েছে। মুসলমানরা আপন ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির ওপর অবিচল থাকবে এবং অমুসলিমদের কর্মধারা থেকে নিজেকে আলাদা রাখবে, এটাই আশুরার দুটি রোজার সূক্ষ্ম শিক্ষা। আজ আমাদের সন্তানদের আদর্শ, জীবনযাপন, পছন্দ-অপছন্দ, চিন্তাচেতনা সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করছে অমুসলিমরা। আমাদের সন্তানদের চলাফেরা, কথাবার্তা সবকিছুর ভিতর থেকে উপচে পড়ছে পশ্চিমাদের নষ্ট সংস্কৃতি। অথচ নবীজি (সা.) মুসলিম-স্বাতন্ত্র্যবোধের ব্যাপারে এতটাই গুরুত্ব দিয়েছেন, আশুরার রোজাও যেন ইহুদিদের মতো না হয়ে যায়, তিনি সজাগ ছিলেন। ইসলাম আমাদের গর্বের ঠিকানা। জীবনভর আমার যেন ইসলামি স্বাতন্ত্র্যবোধের চেতনায় উজ্জীবিত থাকি, আশুরার চেতনা বুকে ধারণ করে পথ চলতে পারি এটাই হোক এবারের আশুরার দীপ্ত শপথ।
জুমার মিম্বর থেকে বয়ান গ্রন্থনা : সাব্বির জাদিদ