আকবর আলীর ঘুম ভাঙে পাখির ডাক বা সূর্যের আলোয় নয়, বরং পিঠের নিচে জমা পানি ঠান্ডা হয়ে মাংসের ভিতরের হাড়ে অনুভূত হলে। ছেঁড়া পলিথিনের ফাঁক গলে পানি পড়ে কার্ডবোর্ড ভিজিয়ে দেয়, আর তাতেই তিনি বুঝে যান, রাত শেষ। ছয় বছর ধরে ফুটপাতই তার ঘর। নদী বাড়ি কেড়ে নিয়েছে। কুড়িগ্রামের মানুষ তিনি। দুই মেয়েকে বিয়ে দিয়েছেন। বউ বড় মেয়ের বাড়িতে থাকেন। তিনিও সেখানে থাকেন। তবে বছরের বেশ কিছু সময় তিনি ঢাকায় আসেন কর্মের খোঁজে। কাজ যেটাই জোটে, সেটাই তিনি করেন। সারা দিন কাজ শেষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি এলাকার ফুটপাতে ঘুমান তিনি। কিন্তু সাগরের লঘুচাপের কারণে বেশ কিছুদিন ধরে চলা বৃষ্টিতে তিনি ঘুমাতে পারছেন না। রাতের অর্ধেক সময় তাকে নির্ঘুম থাকতে হচ্ছে। ফলে দিনে কাজ করতেও অসুবিধে হচ্ছে তার। আকবর আলী বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘সারা দিন কাজ করি। রাতে এখানে পলিথিন ও কার্ডবোর্ড নিচে দিয়ে ঘুমাই। জায়গা পাই না ভাই, আগে আইতে হয়। দেরি করলে আর জায়গা থাকে না। এইটুকু কার্ডবোর্ডের জন্যও ঝগড়া হয়।’ তিনি বলেন, ‘বৃষ্টি হওয়ায় দুই-তিন দিন ধরে ঘুমাতে পারছি না। পানি জমে ঘুমানোর জায়গাটা নষ্ট হয়ে গেছে। বসে বসে যেটুকু ঘুমাতে পারি।’
বৃষ্টি শুধু ভিজিয়ে দেয় না, ভাঙেও : ৬০ বছর বয়সের মোবারক আলী বসে ছিলেন পুরানা পল্টনের এক মার্কেটের বারান্দায়। শরীরে জ্বর, কাপড় ভেজা। তিনি বলেন, ‘রাতটা কেমনে কাটে কইলে বোঝা যাইব না। বৃষ্টি শুরু হইলেই দৌড় দেই। প্লাস্টিক টানি, খালি পলিথিন লাগাইলে হয় না, পেটও ঢাকতে হয়।’
একটি কম্বলের নিচে মা ও মেয়ে : রাজধানীর মগবাজারের একটি মার্কেটের নিচে বসে আছেন নাজমা আক্তার ও তার ১০ বছরের মেয়ে মেহের। দিনভর তারা রাস্তার মোড়ে মোড়ে ফুল বিক্রি করেন। রাতে একটি কম্বল ভাগ করে ঘুমান। নাজমা বলেন, ‘মেয়ে ঘুমাইলে আমি জেগে থাকি। কেউ কিছু করে ফেলে এই ভয়টা সবসময় থাকে।’ মেহের বলে, ‘আম্মু কইছে কেউ ধরতে চাইলে জোরে চিৎকার করতে। কিন্তু আমি ভয় পাই।’
পরিসংখ্যানে যে বাস্তবতা ধরা পড়ে না : বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) ২০২২ সালের জনশুমারি ও গৃহগণনা অনুযায়ী, দেশে ভাসমান মানুষের সংখ্যা ২২ হাজার ১১৯ জন। এর মধ্যে ঢাকা বিভাগেই ৯ হাজার ৪৩৯ জন, যা দেশের সর্বোচ্চ। পুরুষ ১৬ হাজার ৭৮৪ জন, নারী ৫ হাজার ৩৩৫ জন। এ ছাড়া চট্টগ্রামে ৫ হাজার ২১৬, বরিশালে ২ হাজার ১৭৭, খুলনায় ১ হাজার ৩২৫, রাজশাহী ১ হাজার ৩০৩, রংপুর ১ হাজার ৭৪, সিলেট ৮৯৩ ও ময়মনসিংহে ৬৯২ জন মানুষ রাস্তায় বসবাস করেন। তবে বাস্তবে এ সংখ্যা আরও বেশি, কারণ অনেকেই এ গণনার আওতায় পড়েন না। কেউ রাতে এক জায়গায়, দিনে অন্য জায়গায় থাকেন। তাদের খুঁজে পাওয়া কঠিন। তারা ভাসেন না, ঠাঁই খোঁজেন; ‘ভাসমান’ শব্দটি তাদের পছন্দ নয়। ‘ভাসি কই, জায়গা পাই না বইলা ঘুরতেছি। আমরা জায়গা খুঁজি। আমরা ভাসি না।’ বলেন বৃদ্ধা হালিমা খাতুন। হালিমার স্বামী মারা গেছেন বছর তিনেক আগে। এক ছেলে বউ নিয়ে থাকেন কড়াইল বস্তিতে।
নগর পরিকল্পনায় তাদের জায়গা নেই : বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের (বিআইপি) সভাপতি ও নগর পরিকল্পনাবিদ অধ্যাপক ড. আদিল মুহাম্মদ খান বলেন, ‘আমাদের শহর পরিকল্পনায় ছিন্নমূল মানুষের কথা একদমই নেই। তারা যেন এ শহরেরই কেউ নন- এ চিন্তাটা ভয়ংকর। রাজধানীর কেন্দ্রস্থলে হাজার হাজার মানুষ খোলা আকাশের নিচে থাকে, অথচ সেটি আমাদের নীতিমালায় প্রতিফলিত হয় না।’
রাত এলে লুকিয়ে পড়ে শহরের মুখ : রাতে যখন সবাই নিজ ঘরে ঘুমান, তখন ঢাকা শহরের রাস্তা ও ফুটপাতে ছোট একটি জায়গায় ঘুমানোর জন্য যুদ্ধ করেন হাজার হাজার মানুষ। আবার সকাল হলে তারা মিলিয়ে যান শহরের ভিড়ে-রিকশাওয়ালা, ঠেলাওয়ালা, টিস্যু বিক্রেতা হয়ে। নগর পরিকল্পনাবিদ অধ্যাপক ড. আদিল মুহাম্মদ খান বলেন, ‘সরকার আসে আর যায়। কিন্তু ভাসমান মানুষদের কপাল খোলে না।’