চলতি বছরের এসএসসি ও সমমানের ফলাফলে অনেকটাই ধস নেমেছে। গত বছরের থেকে পাসের হার কমেছে ১৪ দশমিক ৫ শতাংশ। জিপিএ-৫ কমেছে ৪৩ হাজার ৯৭ জনের। গত এক যুগে পাবলিক পরীক্ষার ফলাফলে এমন ধস দেখা যায়নি।
ফল বিশ্লেষণে দেখা গেছে, গণিত বিষয়ে বড় ধরনের ফল বিপর্যয় ঘটেছে। পাসের হার কম ছিল ইংরেজিতেও। আর মানবিক বিভাগের শিক্ষার্থীরা অন্য বিভাগের থেকে অনেক পিছিয়ে আছে ফলাফলের দিক দিয়ে। বরিশাল শিক্ষা বোর্ডে বিপর্যয় ঘটেছে সামগ্রিক ফলাফলে। সব মিলে ধস নেমেছে এসএসসি ও সমমানের ফলাফলে।
শিক্ষাসংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, আওয়ামী শাসনামলের পতনের পর অন্তর্বর্তী সরকারের এ আমলে এসএসসির খাতা মূল্যায়নে পরীক্ষকদের ছিল না ওভার মার্কিং বা গ্রেস নম্বর দেওয়ার সুযোগ। শিক্ষার্থীদের পরীক্ষার খাতার মূল্যায়ন হয়েছে যথাযথ। এর ফলে পাসের হার কমেছে অনেক।
বোর্ডভিত্তিক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, এবার এসএসসিতে রাজশাহী বোর্ডে সর্বোচ্চ ৭৭ দশমিক ৬৩ শতাংশ শিক্ষার্থী পাস করেছে আর বরিশাল বোর্ডে পাস করেছে মাত্র ৫৬ দশমিক ৩৮ শতাংশ। অথচ গত বছরেও বরিশাল বোর্ডে পাস করেছিল ৮৯ দশমিক ১৩ শতাংশ শিক্ষার্থী। এ বোর্ডে গতবারের তুলনায় পাসের হার কমেছে ৩২ দশমিক ৭৫ শতাংশ। ফলাফলে বিজ্ঞান ও মানবিকে দেখা গেছে বড় ধরনের ফারাক, যা প্রভাব ফেলেছে ফলাফলে। চলতি বছর বিজ্ঞান বিভাগে পাস করেছে ৮৫ দশমিক ৬৮ শতাংশ। আর মানবিকে পাস করেছে ৫৩ দশমিক ৮৭ শতাংশ শিক্ষার্থী। ব্যবসায় শাখায় পাস করেছে ৬৬ দশমিক ৩২ শতাংশ। জিপিএ-৫ প্রাপ্তিতেও রয়েছে বিজ্ঞান আর মানবিক বিভাগে বড় পার্থক্য। যেখানে বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থীদের মধ্যে জিপিএ-৫ পেয়েছে ১ লাখ ১৭ হাজার ৬২০ জন; সেখানে মানবিকে সর্বোচ্চ জিপিএ-৫ পেয়েছে মাত্র ৩ হাজার ৪৪৮ জন, যা মোট পরীক্ষার্থীর মাত্র শূন্য দশমিক ৫২ শতাংশ। বিষয়ভিত্তিক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, প্রায় সব শিক্ষা বোর্ডেই গণিতে তুলনামূলক কম ফল পেয়েছে ছাত্রছাত্রীরা। যে শিক্ষা বোর্ডের শিক্ষার্থীরা গণিত বিষয়ে ভালো করেছে, সেখানে গড় পাসের হারও বেড়েছে, যা প্রভাব ফেলেছে পুরো ফলাফলে। বরিশাল বোর্ডে এবার ফল বিপর্যয়ের নেপথ্যে গণিতের ভরাডুবি বড় কারণ। এবার বোর্ডটিতে গণিতে পাসের হার ৬৪ দশমিক ৬২ শতাংশ। অর্থাৎ বরিশাল বোর্ডে প্রতি ১০০ জনে ৩৫ জনই গণিতে ফেল করেছে। একই অবস্থা ময়মনসিংহ বোর্ডেরও। এ বোর্ডে গড় পাসের হার মাত্র ৫৮ দশমিক ২২ শতাংশ। ময়মনসিংহ বোর্ডে গণিতে পাসের হার ৬৪ দশমিক ২৭ শতাংশ। যার ধাক্কা লেগেছে গড় পাসের হারেও। এ ছাড়া ঢাকা, কুমিল্লা, দিনাজপুর ও মাদরাসা শিক্ষা বোর্ডেও গণিতে পাসের হার ৭০ শতাংশের ঘরে। ঢাকা বোর্ডে গণিতে পাস করেছে ৭৫ দশমিক ১৪ শতাংশ শিক্ষার্থী। কুমিল্লায় ৭২ দশমিক শূন্য ১, দিনাজপুরে ৭১ দশমিক ৩৫ এবং মাদরাসা বোর্ডে ৭৯ দশমিক ৭৩ শতাংশ। ফলে এ বোর্ডগুলোয় গণিতের ফল কমার সঙ্গে সঙ্গে গড় পাসের হারও কমেছে।
এসএসসি ও সমমানের ফলাফলে অন্য বিষয়ের তুলনায় ছাত্রছাত্রীরা খারাপ করেছে ইংরেজি বিষয়েও। বরিশাল বোর্ডে ইংরেজিতে প্রতি ১০০ জনে ৩০ জনই ফেল করেছে।
চলতি বছরে এসএসসি ও সমমানে ফল কমে যাওয়ার কারণে ‘ওভার মার্কিং’ বন্ধ হওয়ার কথাও বলেছেন সংশ্লিষ্টরা। মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ড, ঢাকার চেয়ারম্যান প্রফেসর ড. খন্দোকার এহসানুল কবির বলেন, ‘এবারের ফলাফলে কাউকে ওভার মার্কিং করা হয়নি।’ অতীতে ওভার মার্কিং করা হয়েছে কি না এমন প্রশ্নের জবাবে চেয়ারম্যান বলেন, ‘বিষয়টি আপনারা জানেন।’ এ নিয়ে আর কোনো মন্তব্য করতে চাননি তিনি। তিনি বলেন, ‘এবার কোনো ধরনের বাড়তি নম্বর বা গ্রেস মার্কস কাউকে দেওয়া হয়নি। মেধার প্রকৃত মূল্যায়নের শতভাগ প্রচেষ্টা করা হয়েছে। পরীক্ষকদেরও সেভাবে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছিল।’
এসএসসির ফলাফলে পাস ও জিপিএ-৫ কমে যাওয়া প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ছিদ্দিকুর রহমান প্রতিবেদককে বলেন, ‘অতীতে পরীক্ষায় ‘লিবারেল মার্কিং’ করা হয়েছে এ নিয়ে সন্দেহ নেই। আগের বছরগুলোয় প্রকৃত ফল দেখানোর চেয়ে ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে দেখানো হয়েছে। আগের বছরগুলোয় কেউ ৩০ পেলেও বাড়তি নম্বর দিয়ে পাস করানো হয়েছে। গ্রেস নম্বর দিয়ে জিপিএও বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। এবারের ফলে যদি বাড়তি নম্বর দেওয়া না হয়ে থাকে তবে তা যথার্থ মূল্যায়ন হয়েছে বলে মনে করি।’ এই শিক্ষাবিদ আরও বলেন, ‘গণিত আর ইংরেজিতে শিক্ষার্থীরা তুলনামূলক খারাপ ফল করায় সার্বিকভাবে ফলাফলে প্রভাব পড়েছে।’