আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে সব রাজনৈতিক দলের ঐক্যে গুরুত্ব দিচ্ছে বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামী। নির্বাচনের সময় ও প্রক্রিয়া নিয়ে আর কোনো দলের কোনো ধরনের প্রশ্ন উঠুক, এটা তারা চায় না। ফ্রি-ফেয়ার ইলেকশন হলে ‘বিএনপি সরকারে এবং জামায়াত বিরোধী দলে’ যাবে বলেই দৃঢ় প্রত্যাশা উভয় দলের নেতাদের। এ অবস্থায় বিএনপিও চায় আগামী জাতীয় সংসদে শক্তিশালী বিরোধী দল আসুক। কার্যকর সংসদ গঠনের মাধ্যমে কাঙ্ক্ষিত গণতন্ত্র প্রাতিষ্ঠানিক রূপ লাভ করুক। জামায়াতকে সব ধরনের ইতিবাচক সহায়তা দিতে প্রস্তুত বিএনপি। ফ্যাসিস্ট হাসিনা সরকারের পতনের পরপরই আগামী নির্বাচনের পর ছোটবড় সব রাজনৈতিক দল যারা ফ্যাসিস্ট সরকার পতনের আন্দোলনে অংশ নিয়েছে, তাদের নিয়ে ঐকমত্যের ভিত্তিতে জাতীয় সরকার গঠনের পরিষ্কার ঘোষণা দিয়েছেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। প্রয়োজনীয় সংস্কার, দৃশ্যমান বিচার ও জুলাই গণ অভুত্থানের ঘোষণাপত্রসহ সবকিছুতেই একমত দেশের বৃহত্তম রাজনৈতিক দল বিএনপি। জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ারও নির্বাচন সামনে রেখে জাতীয় ঐক্যের ওপর গুরুত্ব দিয়েছেন। তিনি বলেন, গণ অভ্যুত্থানের পর নিরপেক্ষ জাতীয় নির্বাচনি প্রক্রিয়ার দিকে এগিয়ে যাওয়ার পথে একটি অপশক্তি বারবার বাধার সৃষ্টি করছে। নতুন বাংলাদেশ নির্মাণের পথে তারা সবচেয়ে বড় অন্তরায়। তিনি নির্বাচন, দেশ গঠন ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে সরকার ও জনগণকে সতর্ক থাকার আহ্বান জানান। জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) তিনটি দাবিও পূরণ হওয়ার পথে রয়েছে। নির্বাচনের আগে তারা চাচ্ছে মৌলিক সংস্কার, গণহত্যার বিচারকার্যের দৃশ্যমান অগ্রগতি এবং জুলাই গণ অভ্যুত্থানের ঘোষণাপত্র। এ তিনটি দাবির সঙ্গেই বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীসহ অন্য সব রাজনৈতিক দলই একমত। প্রয়োজনীয় সংস্কারে বিএনপি ও জামায়াতসহ সবাই একমত। বিএনপি ৩১ দফা সংস্কার প্রস্তাব আগে থেকেই দিয়ে রেখেছে। গণহত্যার চলমান বিচার কার্যক্রম এখন প্রায় দৃশ্যমানই হয়েছে। গত বুধবার রাতে বিএনপির পক্ষ থেকে জুলাই গণ অভ্যুত্থানের ঘোষণাপত্রের খসড়া অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে জমা দেওয়া হয়েছে। জানা যায়, ১৩ জুন অনুষ্ঠিত লন্ডন বৈঠকের পর আগামী জাতীয় নির্বাচন ঘিরে সবকিছুকেই ইতিবাচক হিসেবে নিচ্ছে দলটি। ডিসেম্বরের মধ্যে প্রস্তুতি গ্রহণের বিষয়ে নির্বাচন কমিশনকে নির্দেশনা প্রদানে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। তিনি বলেন, আমি আজ প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূসকে ধন্যবাদ দিতে চাই। তিনি নির্বাচন কমিশনকে নির্দেশ দিয়েছেন ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচনের সব কাজ গুছিয়ে রাখার জন্য। এটা অত্যন্ত ইতিবাচক ব্যাপার। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ডা. এ জেড এম জাহিদ হোসেন বলেন, জুলাই অভ্যুত্থানের পর মানুষের মধ্যে আশার সঞ্চার হয়েছে। এ বিজয় ধরে রাখতে প্রয়োজন ধৈর্য ও সহনশীলতা। জনগণ সব দেখছে। তাদের বোকা ভাবা ঠিক হবে না। অতীতে যারা এ ধরনের দম্ভোক্তি করেছেন, তারা আজ ইতিহাসে নেই। বাংলার মানুষ এসব কখনো মেনে নেয়নি, ভবিষ্যতেও নেবে না। ফেসবুকে পোস্ট দিয়ে আজ সাংবাদিকদের হুমকি দেওয়া হচ্ছে, এ ভাষা গণতান্ত্রিক সমাজের নয়।
আওয়ামী লীগ পুনর্বাসনে আন্তর্জাতিক চক্রান্ত চলছে -গোলাম পরওয়ার : বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার বলেছেন, আওয়ামী লীগকে পুনর্বাসনে আন্তর্জাতিক চক্রান্ত চলছে। নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে স্পেস দেওয়ার জন্য নতুন নতুন তত্ত্ব আসছে। আওয়ামী লীগকে পুনর্বাসিত করার জন্য নানা ফিলোসোফির মাধ্যমে বাংলাদেশে আন্তর্জাতিক দরজা ওপেন করার চক্রান্ত চলছে। এটা হচ্ছে এ দেশের মানুষকে ব্যবহার করে, কোনো রাজনৈতিক দলকে ব্যবহার করে। তিনি বলেন, সংস্কারকে কেন্দ্র করে পলিটিক্যাল পার্টিগুলোর মধ্যে নানান বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে। রাজনৈতিক দলগুলো বিভিন্ন বিষয়ে কথা বলবে, এর মানে এই না, সেই দল নির্বাচন চায় না, নির্বাচন পিছিয়ে দিতে চায়। যখন আলোচনার কোনো বিষয় আসবে তখন বিতর্ক হতে পারে, নতুন যুক্তি আসতে পারে। তিনি বলেন, ব্যক্তি হাসিনা পালিয়ে গেলেও প্রশাসনের রন্ধ্রে রন্ধ্রে, বিচার বিভাগে, পুলিশে, সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানসহ সব জায়গায় ফ্যাসিবাদের দোসররা ঘাপটি মেরে বসে আছে। ফলে একজন ফ্যাসিস্ট গেলেও দেশ থেকে ফ্যাসিবাদের বিদায় হয়নি। ফ্যাসিবাদের আদর্শ যারা লালন করে তারা কিন্তু এখনো দেশে আছে। নতুন বাংলাদেশ নির্মাণের পথে তারা সবচেয়ে বড় অন্তরায়। বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক বলেন, ‘প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস আগামী ডিসেম্বর ঘিরে নির্বাচনের প্রস্তুতি নিতে বলেছেন। এটা অত্যন্ত ইতিবাচক দিক। নির্বাচন যে প্রাধান্য পাচ্ছে তাঁর এ নির্দেশনা অনন্য নজির। আশা করি, অন্য রাজনৈতিক দলগুলোও এটাকে ইতিবাচক হিসেবে দেখবে। পাশাপাশি রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে আস্থা বাড়াবে। জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জেএসডি) সাধারণ সম্পাদক শহীদ উদ্দিন মাহমুদ স্বপন বলেন, আইনশৃঙ্খলা সংশ্লিষ্ট এক উচ্চপর্যায়ের বৈঠকে প্রধান উপদেষ্টা যে নিদের্শনা দিয়েছেন, তা রুটিং ওয়ার্ক। তার পরও বলব, নির্বাচন নিয়ে এক ধরনের ধোঁয়াশা সৃষ্টি হয়েছিল, প্রধান উপদেষ্টার নির্দেশনার পর ধোঁয়াশা কেটে গেল। এটাকে আমরা ইতিবাচক হিসেবেই দেখছি।
নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, প্রধান উপদেষ্টার অনেক ইতিবাচক দিক রয়েছে। আমরা চাই ক্ষমতার প্রভাবমুক্ত একটি সুন্দর নির্বাচন। জাতীয় নির্বাচনের সব প্রতিষ্ঠানকে দ্রুত প্রস্তুত করার অংশ হিসেবেই প্রধান উপদেষ্টা এ নির্দেশনা দিয়েছেন।
বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি) সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স বলেন, প্রধান উপদেষ্টার নির্দেশনায় খুশি হতাম যদি ডিসেম্বরের ভিতরে ভোট শেষ করার নির্দেশনা দিতেন। তার পরও আমরা মনে করি, সব ধোঁয়াশা কেটে জাতীয় নির্বাচনের এক ধাপ অগ্রগতি হয়েছে। আমরা এখন নির্বাচন কমিশনের কাছ থেকে নির্বাচনের তারিখ শুনতে চাই। কারণ নির্বাচন করার দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনের।
তিন শর্ত পূরণের আগে নির্বাচন নিয়ে ভাববে না এনসিপি : মৌলিক সংস্কার ও জুলাই গণহত্যার বিচারকার্যের দৃশ্যমান অগ্রগতি না হওয়া পর্যন্ত জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠান নিয়ে কোনো ভাবনা নেই জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি)। দলটি এখন ‘দেশ গড়তে জুলাই পদযাত্রা’ শীর্ষক কর্মসূচি বাস্তবায়ন নিয়ে ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছে। এনসিপির সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক আরিফুল ইসলাম আদীব গতকাল বাংলাদেশ প্রতিদিনকে এসব কথা বলেন। তিনি বলেন, ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর গঠিত অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে দেশের জনগণের অন্যতম দুটি চাওয়া হলো- রাষ্ট্রের মৌলিক সংস্কারের রূপরেখা বাস্তবায়ন ও জুলাই গণহত্যার বিচার। পাশাপাশি জুলাই গণ অভ্যুত্থানের ঘোষণাপত্র। গণ অভ্যুত্থান থেকে গড়ে ওঠা বিপ্লবীদের রাজনৈতিক দল হিসেবে এনসিপিরও অন্যতম চাওয়া এখন এ তিনটি। এনসিপি এখন নির্বাচন নিয়ে ভাবছে না। দলটির নেতা-কর্মীরা ‘দেশ গড়তে জুলাই পদযাত্রা’ কর্মসূচি নিয়ে ব্যস্ত রয়েছেন।
১০ দিনে আমরা দেশের ২২টি জেলায় পদযাত্রা ও পথসভায় অংশ নিয়েছি। মাসজুড়ে আমাদের এ কর্মসূচি চলবে।
তিনি আরও বলেন, আমরা এখন মানুষের দ্বারে দ্বারে যাচ্ছি সংস্কার এবং বিচারের দাবি নিয়ে। বিশেষ করে সংস্কার ও বিচারের দাবিতে তাদের ঐকবদ্ধ করছি। এ দুটি শর্ত পূরণসাপেক্ষে আমরা নির্বাচনের বিষয়ে আলোচনায় যাব। নির্বাচন যখনই হোক না কেন তাতে আমাদের আপত্তি নেই। তবে তার আগে মৌলিক সংস্কার এবং গণহত্যার বিচার নিয়ে যথেষ্ট অগ্রগতি হতে হবে।