কাগজে আঁকা বাঘ, সে বাঘ নয়। কাগজের গোলাপ গোলাপ নয়। বইয়ে লেখা বা মুখে বলা গণতন্ত্রও কোনো গণতন্ত্র নয়। আমরা, বাংলাদেশের মানুষ সেই কবে থেকে মুখে বলা এবং কাগজে লেখা সেই গণতন্ত্রই কেবল পেয়ে চলেছি। কাগজের আর বক্তৃতার সেই গণতন্ত্রের জাত, উপজাত; তাও সংখ্যায় কম নয়। পাকিস্তান জমানায় ফিল্ড মার্শাল মুহাম্মদ আইয়ুব খান দিয়েছিলেন মৌলিক গণতন্ত্র, বেসিক ডেমোক্র্যাসি। ভোটের মাঠে সেই তন্ত্রের চর্চাও হয়েছিল। সেই গণতন্ত্রের গুণের শেষ নেই। সেই গুণাবলি লেখা আছে অসংখ্য বইয়ে ও প্রবন্ধ-নিবন্ধে। আইয়ুব খান নিজেও একখানা বই লেখেন-ফ্রেন্ডস নট মাস্টার্স। সেখানেও মৌলিক গণতন্ত্রের মাহাত্ম্য বর্ণনা করা হয়েছে। সেই বইয়ের অনূদিত সংস্করণ এখন ঢাকায় পাওয়া যায়। এ ছাড়াও রাইটার্স গিল্ড ও ব্যুরো অব ন্যাশনাল রিকনস্ট্রাকশন-বিএনআরের তালিকাভুক্ত লেখক-অধ্যাপকরা আইয়ুব খানের উন্নয়ন ও মৌলিক গণতন্ত্রের মাহাত্ম্য বর্ণনা করে অনেক লিখেছেন। শেষ পর্যন্ত মৌলিক গণতন্ত্রের কাগুজে মন্ত্র মারণযন্ত্র হলো পূর্ব পাকিস্তানের।
পাকিস্তান জমানা গেল, একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে পেলাম স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ। যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশে অনেক সমস্যা। তার সঙ্গে পেলাম শোষিতের গণতন্ত্র যার ডাকনাম মুজিববাদ। যে কমিউনিস্টরা সর্বহারার গণতন্ত্র চাইছিলেন তারা শোষিতের গণতন্ত্রের সেøাগান শুনে ভাবলেন, আমরা তো এটাই চাইছিলাম। এই শোষিতের গণতন্ত্র ও মুজিববাদ নিয়ে লেখক, সাংবাদিক ও অধ্যাপকরা যে কত কলমের কালি ফুরিয়েছেন, তার কোনো মাপঝোঁক নেই। ঢাউস ঢাউস বই লেখা হয়েছে। পঁচাত্তরে এসে পেলাম একদলীয় গণতন্ত্র। এর আরেকটা নামও দেওয়া হয়েছিল দ্বিতীয় বিপ্লব। পোশাকি নাম বাকশাল। দ্বিতীয় বিপ্লবটা নাকি ছিল শোষিতের গণতন্ত্রের চূড়ান্তরূপ। পঁচাত্তরের পরে পেলাম প্রেসিডেন্টশাসিত গণতন্ত্র। শেখ হাসিনার জমানায় এসে দেখা মিলল কম গণতন্ত্র বেশি উন্নয়ন তথা উন্নয়নের গণতন্ত্র। উন্নয়নের গণতন্ত্রের চোখা দাঁতগুলো যে কতটা ধারালো ছিল, সে কাহিনি তো এখন লোকের মুখে মুখে। এখন আর কেউ উন্নয়নের গণতন্ত্র বলে না, বলে ফ্যাসিবাদ। এখন নয়া বিপ্লবীরা এমন এক গণতন্ত্র চাইছেন, যে গণতন্ত্র এলে ফ্যাসিবাদ আর মাথা চাড়া দিয়ে উঠতে পারবে না।
কিন্তু সেই গণতন্ত্র কোথায় পাওয়া যাবে, কীভাবে পাওয়া যাবে? কে এনে দেবে সেই গণতন্ত্র। যারা স্কুল ও কলেজের ছেলেমেয়েদের হাতে জুতা তুলে দিয়েছিল স্যার ও মেমদের গলায় পরানোর জন্য, তারাই কি এনে দেবে ফ্যাসিবাদমুক্ত গণতন্ত্র? নাকি তারা, যারা সময়ে সময়ে মব আহ্বান করছেন? চোখ না পাকিয়ে কথা বলতে পারেন না যারা, নাকি তারা? সংস্কার প্রস্তাবের পাণ্ডুলিপি তৈরি করতে যারা মাসের পর মাস পার করেছেন, সংস্কার পাণ্ডুলিপির সারসংক্ষেপ বানিয়ে বৈঠকের পর বৈঠক করে যাচ্ছেন; তারা? ইলেকশন ছাড়া কিংবা বহু বিলম্বিত নির্বাচনের মাধ্যমে আসবে কি সেই গণতন্ত্র? প্রেশার গ্রুপ বলে যারা মবের সুনাম করে, তাদের হাত ধরেই কি এসে যাবে সেই সাধের গণতন্ত্র; যা ফ্যাসিজমের সামনে প্রাচীর হয়ে দাঁড়াবে?
যাদের কথা বললাম, জাতির সবাই যদি তাদের ‘গুণাবলি’ রপ্ত করে নেয়, তাহলে দেশটি সর্বনাশের অতল গহ্বরের দিকেই ধাবিত হবে। বস্তুত তাদের পথে কোনো ভালো কাজই করা সম্ভব নয়, গণতন্ত্র তো অনেক পরের কথা! ওদের মুখের কথা বাতাসে মিলিয়ে যাবে, কাগজে লেখা গণতন্ত্র কাগজেই রয়ে যাবে।
আমরা সাধারণ মানুষ তো শুধুই গণতন্ত্র চাই, সাদামাটা নিরালংকার গণতন্ত্র। আভরণ চাই না, জরির পোশাক পরা বিশেষণযুক্ত গণতন্ত্র চাই না। আব্রাহাম লিংকন গেটিসবার্গের বক্তৃতায় যে সহজ গণতন্ত্রের কথা বলেছেন সেটা চাই। বাই দ্য পিপল, অফ দ্য পিপল ফর দ্য পিপল। একটি বাংলা গানে এই সহজ গণতন্ত্রের সহজ অনুবাদ রয়েছে। ‘আমার এ দেশ সব মানুষের, ছোটদের বড়দের সব মানুষের।’ এই বাণীর তাৎপর্য বহু ব্যাপক। এই দেশে সবাই সমানভাবে নাগরিক অধিকার ভোগ করবে। কেউ কারও ওপর জুলুম করবে না। প্রতিটি নাগরিক সমানভাবে আইনের সুরক্ষা লাভ করবে। প্রত্যেকের নিজ নিজ দায়িত্ব পালনের মাধ্যমে দেশের জন্য কাজ করবে।
অন্ন বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিৎসা এসব অধিকার থাকবে সবার। ভোটের অধিকার। মতপ্রকাশের স্বাধীনতা। এসব অধিকারের কথা গণতান্ত্রিক সমাজে আলাদা করে বলারই কোনো প্রয়োজন নেই। এটাই আব্রাহাম লিংকনের গণতন্ত্র। এর মানেই হচ্ছে দেশ সবার।
গণতন্ত্র এমন একটি ব্যবস্থা যেটা নিরাভরণ কিন্তু স্বয়ংসিদ্ধ। ভুল ও সীমাবদ্ধতাগুলো নিজে নিজেই সে কারেকশন করে। নেতা নির্বাচনে ভুল হয়ে গেলে কিংবা নির্বাচিত হওয়ার পর নেতা যদি গণতন্ত্রের দাবি ভুলে যান, তাহলে গণতন্ত্র সেই নেতার হাতে হারিকেন ধরিয়ে দিতে ভুল করে না। বিলম্বও করে না। পার্লামেন্ট তথা জনপ্রতিনিধিরা কাউকে ছেড়ে কথা বলে না। ইউরোপ-আমেরিকার গণতান্ত্রিক দেশসমূহের ইতিহাসে তার অজস্র দৃষ্টান্ত রয়েছে। এর নজির আছে সাম্প্রতিক ইতিহাসেও। বাংলাদেশে ১৯৭২ সালে গৃহীত সংবিধানে ৭০ অনুচ্ছেদ যুক্ত করে গণতান্ত্রিক বিকাশের পথ প্রথমেই রুদ্ধ করা হয়েছিল। পরে সংশোধনের নামে অসংখ্য ফরেইন পার্টিকেলস ঢুকিয়ে গণতান্ত্রিক সংবিধানকে আরও বেশি দূষিত করা হয়েছে। ১৯৭২ সালের সংবিধান পর্যায়ক্রমে কোটারি স্বার্থে দোষযুক্ত করা না হলে সেটাই হতে পারত গণতন্ত্রের শক্তিশালী রক্ষাকবচ।
এখনো আমরা গণতন্ত্র চাই। গণতন্ত্রের জন্যই ২০২৪ সালের কোটাবিরোধী আন্দোলন স্বৈরাচার পতনের সর্বব্যাপী জনসংগ্রামে রূপান্তরিত হয়েছিল। বাঙালির মিলিত সংগ্রামের বিজয় এলো কিন্তু গণতন্ত্র এলো না। সামনে এলো নৈরাজ্য। শুরু হলো ক্ষমতা লাভের কোল্ড ওয়ার। গোলমেলে পরিস্থিতির মধ্যেই বেঁচে রইল গণতন্ত্রের ধূলিধূসরিত আকাক্সক্ষা।
প্রশ্ন হলো আমাদের প্রত্যাশিত সেই গণতন্ত্র কে এনে দেবে? সেই গণতন্ত্র কি আকাশ থেকে পড়বে? নাকি জমিন ফুঁড়ে বেরিয়ে আসবে? সত্যি কথা বলতে কি, কোনো একটি বা অনেকগুলো দল মিলেও গণতন্ত্র এনে দিতে পারবে না, যদি না দেশের মানুষ গণতন্ত্রের জন্য প্রস্তুত হয়। মানুষ সেটাই পায়, যেটা সে পাওয়ার যোগ্য। এই বাণী চিরকালের এক অমোঘ সত্য। আল্লাহতায়ালা পবিত্র কোরআনে সুস্পষ্টভাবে ঘোষণা করেন, মানুষের সাধ্যাতীত কোনো কিছু তিনি চাপিয়ে দেন না। মানুষ যা অর্জন করে, তাই সে পায় (সুরা বাকারা-২৮৬)।
আমাদের যদি গণতন্ত্রের ভার বহন করার যোগ্যতা না থাকে, তাহলে গণতন্ত্র কেন পাব? কী করে পাব? ৫ আগস্টের পর থেকে আমরা যা করছি এবং যা বলছি তার কতখানি গণতান্ত্রিক? গণতন্ত্রের কোন কিতাবে লেখা আছে যে জুতা মেরে গণতন্ত্র আসবে? গণতান্ত্রিক দেশের আইনের কোন বইয়ে লেখা আছে, যার তার নামে খুনের মিথ্যা মামলা দিয়ে, নাম না-জানা অসংখ্য আসামি দিয়ে পরে যাকে তাকে সেই মামলায় অ্যারেস্ট করে আইনের শাসন জারি রাখা যায়? এই পিশাচ তত্ত্ব কে দিয়েছে? সাংবাদিকদের ওপর চড়াও হওয়া, তাদের ভয় দেখানো এটা কোন গণতন্ত্র? নির্বাচন বিলম্বিত করে অনির্বাচিত সরকার গণতন্ত্র দেবে-এই বা কেমন কথা? যে সমাজ বিনা বাক্যব্যয়ে এসব মেনে নেয়, সেই সমাজ গণতন্ত্রের জন্য প্রস্তুত কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠতেই পারে।
আসল কথা হলো, গণতন্ত্রের জন্য তৈরি হতে হবে নাগরিক সমাজকেই। সত্যিকার অর্থেই দেশ ও জনগণের প্রতি দায়বদ্ধ রাজনৈতিক দল ও দলের মহান নেতাদের উচিত যাবতীয় ফন্দিফিকির বাদ দিয়ে গণতন্ত্রের পথে আসা। চালাকি করে হালুয়ারুটির ভাগ নেওয়ার বদলে গণতান্ত্রিক পন্থায় যতটুকু পাওয়া যায়, তার সদ্ব্যবহার করতে শিখতে হবে। গণতন্ত্রে উত্তরণের প্রথম ধাপ ফ্রি ফেয়ার ইলেকশন। এর কোনো বিকল্প নেই।
ইলেকশনে প্রতিটি দলের মহৎ শক্তির সবটুকু নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়া কর্তব্য। জনগণকে ভয় কিংবা লোভ দেখিয়ে, অন্যের বদনাম করে পক্ষে না টেনে ভালোবেসে কাছে টানতে হবে। সংবাদপত্রের কণ্ঠ রোধ করে, ভয় দেখিয়ে, প্রতিপক্ষকে হেয়প্রতিপন্ন করে জনমত পক্ষে আনা যায় না। বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী, এনসিপিসহ প্রতিটি দল যদি প্রতিটি আসনে যোগ্য প্রার্থী দেয় এবং প্রার্থীরা যদি ঠিকমতো জনসংযোগ করেন, তাহলে প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক নির্বাচন হতে বাধ্য।
ইলেকশন প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ হলে একটি ব্যালান্সড পার্লামেন্টও পাওয়া অসম্ভব কিছু নয়। ভোটারদেরও সচেতন হতে হবে। হুজুগে ভোট দেওয়ার রীতি থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। আমার পছন্দের দল যদি আমার এলাকায় কোনো অযোগ্য বা খারাপ লোককে মনোনয়ন দেয় তাহলে সেই অযোগ্য লোককে আমি ভোট দেব না। এটাই হওয়া উচিত ভোটারের ব্যক্তিগত নীতিবাক্য। হুজুগে গণতন্ত্র হয় না, গণতন্ত্র চায় সচেতন সিদ্ধান্ত।
লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক ও কথাসাহিত্যিক