শুধু বস্তুগত অবকাঠামো উন্নয়ন নয়, চাই নৈতিক উন্নয়ন। তাই সবার আগে চাই আদর্শ। আদর্শহীন মানুষ যেমন প্রকৃত মানুষ নয়, আদর্শহীন নেতা কখনো নেতা নন। আদর্শ বিনে রাজনীতি নয়, আদর্শ ছাড়া দেশ পরিচালনা সম্ভব নয়। শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়া ছিলেন একজন আদর্শবান। তাঁর আদর্শ ছিল সততা, দেশপ্রেম ও মানুষের জন্য মানবিক মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করা।
প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান রাজনীতির লক্ষ্য নির্ধারণ করেছিলেন শোষণমুক্ত সমাজ। বৈষম্যহীন সমাজ। তাঁর ১৯ দফা কর্মসূচি ছিল জাতির ভাগ্যোন্নয়ের চাবিকাঠি। সব শ্রেণির মানুষের কল্যাণের সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যে ১৯ দফা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন শুরু করা হয়েছিল। এ বিপ্লবী চিন্তাধারা একটি ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ রাষ্ট্র থেকে অতি অল্প সময়ে খাদ্য স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করেছিল। জাদুর কাঠির মতো কাজ করেছিল আদর্শভিত্তিক এই কর্মসূচি! ১৯ দফার চার দফা ছিল শান্তিপূর্ণ বিপ্লবী কর্মসূচি।
খাদ্যবিপ্লব : ১৯ দফার মাধ্যমে কৃষি ও খাদ্যবিপ্লবের সূচনা হলো। গৃহীত হলো পাঁচ বছরের মধ্যে খাদ্য উৎপাদন দ্বিগুণ করার কর্মসূচি। ঘোষণা করা হলো দেশে সেচের পানির অভাব, খাল খনন করতে হবে। শীতে পানি মজুত করে রাখতে হবে। আর খাল খননে শুধু সেচ নয়, বন্যা প্রতিরোধে ও পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষাতেও অনন্য ভূমিকা রাখবে। মাত্র দেড় বছরে ১ হাজার ২০০ খাল খনন হলো। ওই দেড় বছরে রেকর্ড পরিমাণ খাদ্য উৎপাদন হলো। এ ছিল এক অদ্ভুত শান্তিপূর্ণ বিপ্লব।
এমনিভাবে আলোর দিশারী হয়ে এলো গণশিক্ষা বিপ্লব। দেড় বছরে ৪০ লাখ বয়স্ক লোক লেখাপড়া শেখেন। চোখ থাকতে যারা অন্ধ ছিলেন, তারা আলো ফিরে পেলেন। জনসংখ্যা বিস্ফোরণ দমনে এলো জন্মনিয়ন্ত্রণ বিপ্লব। গ্রামগঞ্জেও ছড়িয়ে দেওয়া হলো জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের বাণী। ধ্বংসপ্রাপ্ত শিল্প-কারখানায় শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা হলো। কলের চাকা চলল দিনরাত। অভ্যন্তরীণ উৎপাদনে রেকর্ড সৃষ্টি হলো। এরপর এলো আরেক যুগান্তকারী বিপ্লব; যার নাম গ্রাম সরকার।
গ্রাম সরকার : গ্রামীণ জনপদে কল্যাণ এবং শান্তি প্রতিষ্ঠায় স্থানীয় সরকার পদ্ধতিতে নব নব চিন্তার আধার ছিল গ্রাম সরকার। ৬৫ হাজার গ্রামে গ্রাম সরকার নির্বাচনের মাধ্যমে সৃষ্টি হলো। ১৯ দফার কর্মসূচির সিংহভাগ বাস্তবায়ন শুরু হলো গ্রাম সরকারের মাধ্যমে। বিপ্লবের অংশীদার হলো গ্রামীণ সাধারণ মানুষ-এই গ্রাম সরকারের মাধ্যমে। গ্রামবাংলার মানুষের ভাগ্যোন্নয়নের মানসে জিয়া দরিদ্র কৃষক জনগণের পাশে দাঁড়িয়ে অবিস্মরণীয় ইতিহাস সৃষ্টি করেছেন। জিয়া ছিলেন এই স্বাধীন দেশের প্রথম নেতা, যিনি দেশের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত পর্যন্ত ছুটে বেড়িয়েছেন, যা তাকে দিয়েছে আকাশছোঁয়া জনপ্রিয়তা। তিনি সাড়ে তিন বছর পায়ে হেঁটে ১০ হাজার গ্রাম ঘুরেছেন এবং হৃদয়ঙ্গম করেছেন যে জনগণ তাঁর সঙ্গে রয়েছেন। তাঁকে ভালোবাসেন।
মর্যাদাশীল গণতান্ত্রিক ঐক্যবদ্ধ জাতি : একদলীয় শাসন কায়েম করে ‘গণতন্ত্র’ হত্যা করেছিল কার্যক্রম নিষিদ্ধ ঘোষিত আওয়ামী লীগ। গণতন্ত্রের মানসপুত্র, গণতন্ত্র যাঁর আদর্শে, চিন্তা চেতনায়, মননে তিনি সেই শহীদ জিয়া, শৃঙ্খলিত একদলীয় রাজনীতিকে মুক্ত করে বহুদলীয় গণতন্ত্রের পথ উন্মুক্ত করেছেন। হাজার হাজার রাজবন্দি মুক্তি পেয়ে প্রকৃত স্বাধীনতার আস্বদ লাভ করলেন। বিশুদ্ধ সমীরণে শ্বাস-প্রশ্বাস নিলেন। প্রভাতের পাখির অনাবিল শান্তির কূজন আর মুক্ত সূর্য কিরণে স্নাত হলেন।
বিদেশনীতি : কোনো রাষ্ট্র বাংলাদেশের শত্রু নয়, তারা সবাই আমাদের বন্ধু। “Friendship to all malice to none”-এ নীতি অনুসরণ করে ন্যায়ভিত্তিক সমস্যা সমাধানের প্রচেষ্টায় সফল হলেন শহীদ জিয়া। ফারাক্কার পানিবণ্টনের প্রথম লিখিত চুক্তি স্বাক্ষরিত হলো। জাপানের মতো শক্তিধর দেশকে পরাভূত করে নিরাপত্তা পরিষদে আসন করে নিল বাংলাদেশ। সদ্যঃপ্রসূত দেশ ঘুরে দাঁড়াল। দুর্ভিক্ষ দূর হলো। অর্থনীতি দৃঢ় হলো। পাউন্ডের দাম নেমে ৩০ টাকায় এলো, টাকা শক্তিশালী হলো। আফ্রিকার দুর্ভিক্ষপীড়িত গিনিকে বাংলাদেশ প্রথমবারের মতো চাল পাঠিয়ে সাহায্য করল। নবীন রাষ্ট্র বাংলাদেশ ইতিহাস সৃষ্টি করল। মেরুদণ্ড সোজা করে দাঁড়াল। দৃপ্ত কণ্ঠে, দৃঢ় পদে অগ্রসরমান হলো। হাজার বছরের ঘুমন্ত জাতি জেগে উঠল, পৃথিবীকে তাক লাগিয়ে বাংলাদেশ গর্জে উঠল। “শাবাশ বাংলাদেশ।”
বিদ্রোহী নেতা, স্বাধীনতার ত্রাতা : এই সেই অবিস্মরণীয় নেতা, যিনি জীবনবাজি রেখে বাংলার শতকোটি অবহেলিত মানুষকে যুদ্ধে ডাক দিয়েছিলেন। তিনিই একদা ঘোষণা করেছিলেন ‘We revolt’ that was a clarion call, এ ডাক ধ্বংসের নয়, এ ডাক ধ্বংসের বিরুদ্ধে, ন্যায়ের পক্ষে আহ্বান। Thus idea of revolt not an act of violence or destruction, but as a moral uprising against injustice, corruption and inequality.
রাষ্ট্রনায়ক জিয়া : জিয়া শুধু স্বাধীনতা ঘোষক নন, শুধু প্রেসিডেন্ট নন। তিনি ছিলেন একজন রাষ্ট্রনায়ক। গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, সবাই রাষ্ট্রপ্রধান, কেউ কেউ রাষ্ট্রনায়ক। এটা সত্য যে রাষ্ট্র রাজনীতিবিদরাই শাসন করেন। তবে সব রাজনীতিবিদ রাষ্ট্রনায়কোচিত গুণাবলি অর্জন করেন না। রাজনীতিবিদরা রাজনৈতিক স্বার্থে বর্তমান নিয়ে ব্যস্ত। রাষ্ট্রনায়ক শুধু বর্তমান নয়, ভবিষ্যৎ বিনির্মাণে নিয়োজিত অর্থাৎ A politician thinks about next election, the statesman thinks about the next generation. এমনিভাবে রাষ্ট্রনায়কগণ হয়ে ওঠেন জনমানুষের শ্রদ্ধার পাত্র। ভালোবাসার আধার। জিয়াও এমনভাবে একদিন রাষ্ট্রনায়ক রূপে হন আবির্ভূত।
আত্মত্যাগের মহিমায় মহিমান্বিত ছিলেন জিয়া : শহীদ জিয়া ছিলেন সততা ও ঐক্যের প্রতীক। বিভাজিত বাংলাদেশ নামক এ রাষ্ট্রকে যেমন তত্ত্বীয় ঐক্য দিয়েছিলেন, তেমনি জিয়া তাঁর কর্মদক্ষতা মেধা ও প্রজ্ঞা দিয়ে জাতীয় ঐক্য স্থাপন করতে সক্ষম হয়েছিলেন। সমসাময়িক রাষ্ট্রবিজ্ঞানী অনেকে তাঁদের বিশ্লেষণে জিয়ার সফলতা নিয়ে মন্তব্য করেছেন।
The party system is restored, political institutions resuscitated, public administration revitalized, the economy invigorated and diplomatic relations strengthened.. রাষ্ট্রীয় জীবনে সর্বত্র ছিল জিয়ার অবশ্যম্ভাবী সফলতার ছোঁয়া। অথচ জিয়া ছিলেন নির্লোভ। অর্থসম্পদ, বাড়িগাড়ি, আরাম-আয়েশ, বিলাসব্যসনের প্রতি তাঁর কোনো আগ্রহই ছিল না। তাঁর মননে চিন্তা চেতনায় ছিল-“সকলের তরে জীবন মন সকলই দাত্ত, আপনার কথা ভুলিয়া যাও।’’ বস্তুত তাই হওয়া উচিত। রাজনীতি যদি করার লক্ষ্য হয় তাহলে অর্থবিত্তের লালসা তাকে ত্যাগ করতে হবে। অর্থের লালসা আর মানুষের ভালোবাসা সমান্তরাল হতে পারে না। নৈতিক শক্তি অর্থাৎ Moral force-এর ওপর আর কোনো শক্তি নেই।
কালজয়ী এ বিশ্ববরেণ্য নেতা এ দেশের মানুষের জন্য উদারচিত্তে, নিজেকে বিলিয়ে দিতে চেয়েছিলেন।
লেখক : সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব; উপদেষ্টা, বিএনপি