যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী বাংলাদেশিরা স্বদেশে অবিলম্বে নির্বাচন চেয়েছেন। ৫ থেকে ৭ জুলাই যুক্তরাষ্ট্রে প্রবাসী সাংবাদিকদের করা জনমত জরিপে অংশ নেওয়া বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার প্রতিনিধিত্বকারী দেড় শতাধিক প্রবাসীর অভিমত থেকে এ তথ্য পাওয়া গেছে। নিউইয়র্ক, নিউজার্সি, পেনসিলভেনিয়া, ভার্জিনিয়া, বস্টন, মিশিগান, শিকাগো, জর্জিয়া, ফ্লোরিডা, লুইজিয়ানা, ক্যালিফোর্নিয়া, টেক্সাস প্রভৃতি স্থানের প্রবাসীর অংশগ্রহণে চালিত জরিপে দেখা যায়, ৮০ শতাংশের বেশি প্রবাসী মনে করেন দেশে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি উদ্বেগজনক। অন্তর্বর্তী সরকারের সময়ও আগেকার মতোই দুর্নীতি-চাঁদাবাজি-দখলবাজি অব্যাহত রয়েছে। শুধু গুমের ভীতি কমলেও খুনের ঘটনা হরদম ঘটছে পুলিশ প্রশাসনের সামনেই। দেশের ৫৪ বছরের ইতিহাসে এ রকম নাজুক পরিস্থিতির উদ্ভব কখনো হয়নি। প্রবাসীরা আইনশৃঙ্খলার এ ধরনের অবনতিশীল পরিস্থিতির অবসানে অবিলম্বে জাতীয় সংসদের নির্বাচন চেয়েছেন এবং ঐকমত্যে উপনীত হওয়া ইস্যুসমূহের ব্যাপক সংস্কারের দায়িত্ব নির্বাচিত সরকারের জন্য রেখে দেওয়ার সুপারিশ করেছেন। ৫৫% প্রবাসী বলেছেন, বৈষম্যমুক্ত রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকার পূরণে ড. ইউনূস ও তাঁর সরকার চরম ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছেন। শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ করে তাঁকে স্বৈরাচার বলা হচ্ছে, ইউনূসের অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে তা কয়েক গুণ বেড়েছে। গুটিকতক সন্ত্রাসী এবং রাজনৈতিক মাস্তান ছাড়া কেউই এখন স্বস্তিতে নেই বলেও প্রবাসীরা মন্তব্য করেছেন। ঘুষ-দুর্নীতি, চাঁদাবাজি, দখল ও বদলি বাণিজ্য হ্রাস দূরের কথা কয়েক গুণ বেড়েছে বলেও উল্লেখ করেছেন নেতৃস্থানীয় প্রবাসীরা।
জরিপে অংশগ্রহণকারীর মধ্যে ছিলেন জর্জিয়া স্টেটের সিনেটর (ডেমোক্র্যাট) শেখ রহমান, ওয়ালস্ট্রিট জার্নালের আন্তর্জাতিক অর্থনীতি বিশ্লেষক-লেখক অধ্যাপক ড. ফাইজুল ইসলাম, নিউ অর্লিন্স ইউনিভার্সিটির ইমেরিটাস প্রফেসর ড. মুস্তফা সরোয়ার, ইন্টারন্যাশনাল অ্যাসোসিয়েশন অব স্কুল অব সোশ্যাল ওয়ার্কের ভাইস প্রেসিডেন্ট অধ্যাপক গোলাম মাতবর, নিউইয়র্ক স্টেট ইউনিভার্সিটির অর্থনীতির অধ্যাপক বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. বিরূপাক্ষ পাল, নিউইয়র্কে বসবাসরত বিএনপির কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির অন্যতম সদস্য গিয়াস আহমেদ, কমিউনিটি লিডার কাজী আশরাফ হোসেন নয়ন, বাংলাদেশি-আমেরিকান চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির প্রেসিডেন্ট আতিকুর রহমান এবং ফোবানার নির্বাহী সচিব রহিম নিহাল, নির্মাণ ব্যবসায়ী ও সংগঠক মো. আবদুল কাদের মিয়া, সমাজসেবী ইঞ্জিনিয়ার মো. ফজলুল হক, ব্যবসায়ী ও গৃহিণী নাসিমা বানু প্রমুখ। সাধারণ প্রবাসীর মধ্যে ছিলেন দোকান কর্মচারী, ট্যাক্সি ড্রাইভার, রেস্টুরেন্ট ব্যবসায়ী, গ্রোসারি মালিক, শিক্ষার্থী, গৃহিণী, অভিনেতা-অভিনেত্রী-সাস্কৃতিক কর্মী, লেখক-কবি, ফেডারেল কর্মচারী এবং কমিউনিটি সংগঠক।
জরিপে অভিমত প্রকাশক প্রবাসীরা কেউই স্বস্তিবোধ করছেন না আইনের শাসন নিয়ে। তাঁদের মতে আগের মতোই রাজনৈতিক প্রতিহিংসাপরায়ণতা অব্যাহত রয়েছে। শত শত মানুষকে একটি হত্যার জন্য অভিযুক্ত করা হচ্ছে, যা হাসির খোরাক হচ্ছে।
ওয়াশিংটন ডিসি এলাকায় বসবাসরত অর্থনীতিবিদ-লেখক ড. ফাইজুল ইসলাম বলেন, ‘সব সরকারের সময়ই সমান দুর্নীতি-স্বজনপ্রীতি দেখছি। এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণে দরকার নির্বাচিত একটি সরকার।’
২৭ মে বাংলাদেশে গিয়েছিলেন এবং ২ জুলাই যুক্তরাষ্ট্রে ফিরেছেন স্টেট সিনেটর শেখ রহমান বলেন, ‘মৌলিক সংস্কারের পরই নির্বাচন দেওয়া দরকার। সংস্কারের ব্যাপারটিকে হেলাফেলা করা হলে পুনরায় বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচনের প্রত্যাশা অপূর্ণই থেকে যাবে। তাই কিছুটা হলেও করা দরকার। মানুষের প্রত্যাশার পরিপূরক একটি নির্বাচন হলেই বাংলাদেশ আবার ঘুরে দাঁড়ানোর সুযোগ পাবে।’
ইমেরিটাস অধ্যাপক ড. মুস্তফা সরোয়ার বলেন, ‘আমরা যারা প্রবাসী তাদের কোনো চাওয়াপাওয়া নেই। তবে যে দেশটি ছেড়ে এসেছি সেটির মঙ্গল কিছু দেখলে আপ্লুত হই। মন্দ কিছু ঘটলে সকলে ব্যথিত হই, দুঃখবোধে আক্রান্ত হই। সেজন্যই অন্য সবার সঙ্গে আমারও জোর দাবি অনতিবিলম্বে নির্বাচন হওয়া উচিত।’
রাষ্ট্রচিন্তক অধ্যাপক ড. গোলাম মাতবর বলেন, ‘মনে হয় দু-তিন জন বাদে অন্য কোনো উপদেষ্টাই কার্যকর কোনো দায়িত্ব পালনে সক্ষম হননি বলে সংস্কারের প্রত্যাশা থমকে রয়েছে। তাঁরা শুধু বড় বড় কথাই বলেছেন। অন্যদিকে নির্দিষ্ট কোনো রোডম্যাপও ঘোষণা করতে পারেননি নির্বাচনের ব্যাপারে। একইভাবে জনগণের প্রত্যাশার পরিপূরক ন্যূনতম সাফল্যও দেখাতে পারেননি রাষ্ট্র পরিচালনায়।’ ড. মাতবর বলেন, ‘ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে আমার মনে হয় না সুন্দর একটি নির্বাচনের জন্য তৈরি আছেন। ভোটাররা যে নিরাপদে পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দেবেন সে ধরনের পরিবেশ তৈরির জন্য কোনো পদক্ষেপ দেখছি না।’
মুহাম্মদ ইউনূস ক্ষমতা গ্রহণের পরই অধ্যাপক বিরূপাক্ষ পাল পত্রিকায় কলাম লিখেছিলেন যে, এ সরকারকে রাষ্ট্র সংস্কারের জন্য দুই বছর সময় দেওয়া উচিত। কিন্তু অধ্যাপক পাল এখন ইউনূস সরকারের মধ্যে ফখরুদ্দীন সরকারের মতো স্ট্রং ডিটারমিনেশন দেখছেন না। অধিকন্তু ইউনূসের সরকার ক্ষমতায় আসার পর বিভিন্ন টালবাহানা ধরা পড়ছে, তাঁরা সংস্কারের ব্যাপারে খুব সৎ নন। আর আওয়ামী লীগ যেহেতু একমুখো নির্বাচন করেছে, সে অবস্থায় সংস্কারের প্রত্যাশা হচ্ছে অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচনের। কিন্তু এঁরা ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়েই যেভাবে সম্ভব আওয়ামী লীগকে নিশ্চিহ্ন করার মিশন নিয়ে মাঠে নেমেছেন বলে মনে হচ্ছে। আওয়ামী লীগের সব মানুষ তো দুর্নীতি করেননি কিংবা খারাপও ছিলেন না। তাহলে কেন পুরো আওয়ামী লীগকেই নিশ্চিহ্ন করার চেষ্টা চালানো হচ্ছে। অথচ বৈষম্যমূলক সমাজ বা রাষ্ট্র গঠনের প্রতিশ্রুতির সঙ্গে এটা যায় না। বিরূপাক্ষ পাল বলেন, ‘মব কালচার বাড়ছে, বিনিয়োগ কমছে, জিডিপি গত ৩৬ বছরের মধ্যে সর্বনিম্নে নেমেছে, তাই যত দ্রুত সম্ভব নির্বাচন দিয়ে এ সরকারের সরে যাওয়া উচিত। এবং এটাই হচ্ছে সময়ের দাবি। তা না হলে রাষ্ট্র আরও খারাপের দিকে যাবে।’
নিউইয়র্কে বসবাসরত বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতা ও মূলধারার ব্যবসায়ী গিয়াস আহমেদ বলেন, ‘যারা নির্বাচনে ভোট পাবে না কিংবা জনগণের সঙ্গে সম্পর্ক নেই তেমন কিছু মানুষ একটার পর একটা ইস্যু সৃষ্টি করছেন, যেমন পিআর সিস্টেম, এটা কিন্তু সংস্কার কমিশনের কোনো এজেন্ডা ছিল না। এটা হঠাৎ করেই সামনে এনে সময়ক্ষেপণের বাহানা করা হচ্ছে। পিআর সিস্টেম সম্পর্কে বাংলাদেশের মানুষ এখনো কিছুই জানে না।’ কমিউনিটি লিডার কাজী আশরাফ হোসেন নয়ন বলেন, ‘সামগ্রিক অবজারভেশনে মুহাম্মদ ইউনূসের কারণে দেশ এগোতে পেরেছে। প্রফেসর ইউনূস না হয়ে অন্য কেউ দায়িত্ব নিলে এক মাসও টিকত না।’ ফ্লোরিডাস্থ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের প্রেসিডেন্ট, ফোবানার চেয়ারপারসন আতিকুর রহমান বলেন, ‘জুলাই-আগস্টের আন্দোলনে রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পরিপ্রেক্ষিতে জনমনে সৃষ্ট প্রত্যাশা এখন হতাশায় নিপতিত। ভোটের অধিকার আদৌ ফিরে পাওয়া যাবে কি না সুধীজনমনে সে সংশয়ও দেখা দিয়েছে।’