কধুরখীল উচ্চ বিদ্যালয়। কক্ষ আটটি। পিলার ৭৫টি। এটি দেশের একমাত্র ১০৮ বছর বয়সি মাটির স্কুল। স্কুলটির ছাদ কাঠ ও টিনের তৈরি। এটির দৈর্ঘ্য ২০৩ ফুট এবং প্রস্থ ৪৫ ফুট। স্কুলটির পুরো অবয়ব নান্দনিক স্থাপত্যের। এটির নকশা মোগল আমলের স্থাপত্যশৈলীর কথাই জানান দেয়। কালের সাক্ষী হয়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে।
চট্টগ্রামের বোয়ালখালী উপজেলার আকুবদন্ডী গ্রামে অবস্থিত এ স্কুলটি। ১৯১৭ সালের ১ জানুয়ারি প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় স্থানীয়দের শিক্ষা প্রসারে স্কুলটি নির্মিত হয়। স্কুলের পাশেই আছে ঐতহাসিক ‘পার্বতী চরণ দীঘি’। ২০১৫ সালের ৩ ডিসেম্বর স্কুলটিকে দেশের অন্যতম প্রাচীন মৃৎভবন ঘোষণা দিয়ে এটিকে সংরক্ষিত পুরাকীর্তি হিসেবে তালিকাভুক্ত করে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর। এ স্কুলেই আছে দেশের স্কুল পর্যায়ে নির্মিত প্রথম শহীদ মিনার। শিক্ষা মন্ত্রণালয় ২০১৮ সালে স্কুলটিকে জাতীয়করণ করে।
তবে শতবর্ষী এ স্কুলটির অবস্থা এখন নাজুক। ফাটল ধরেছে মাটির দেয়ালগুলোর। ছাদে টিনের চালার নিচে দেওয়া কাঠ ও বাঁশের চাটাইগুলো বিভিন্ন স্থানে খুলে পড়েছে। দেয়ালের কয়েকটি জায়গায় গর্ত তৈরি হয়েছে। বর্ষাকালে ছাদের বিভিন্ন জায়গা থেকে বৃষ্টির পানি পড়ে। গেজেট জারির পর প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ স্কুলের একটি কক্ষের দেয়ালের কিছু অংশ সংস্কার করলেও পরে আর কোনো কাজ হয়নি।
স্কুলের প্রধান শিক্ষক বিশ্বজিৎ বড়ুয়া বলেন, এটি দেশের একমাত্র শতবর্ষী মাটির স্কুল। তাই এটিকে পুরাকীর্তি হিসেবে ঘোষণা করা হয়। আমরা চাই, এটির মূল অবকাঠামো ঠিক রেখে সংস্কার করা হোক। তিনি বলেন, বর্তমানে স্কুলে ৭৩৯ জন শিক্ষার্থী ও ১৪ জন শিক্ষক আছেন। মাটির স্কুলটাও এখন ক্লাস, শিক্ষক রুমসহ নানা কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে। কিন্তু সব কাজ করা হয় ঝুঁকি নিয়ে।
বোয়ালখালী উপজেলা নির্বাহী অফিসার মোহাম্মদ রহমত উল্লাহ বলেন, আমি ইতোমধ্যে স্কুলটি পরিদর্শন করেছি। এটি দেশের অন্যতম একটি পুরাকীর্তি। আমরা এ পুরাকীর্তির মূল কাঠামো অক্ষত রেখেই নতুন করে ঢেলে সাজাতে একটা পরিকল্পনা হাতে নিয়েছি। এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে নতুন করে সৌন্দর্যবর্ধন করা হবে। এ নিয়ে আমরা এ অর্থবছরেই একটি বাজেট পরিকল্পনা করব। দেশের অন্যতম বৃহৎ প্রাচীন এ মৃৎভবনকে নান্দনিক অবয়ব দেওয়া হবে।
ইতিহাস সূত্রে জানা যায়, গ্রামের পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীকে শিক্ষার আলোয় আলোকিত করতে এ অঞ্চলের কয়েকজন শিক্ষাবিদ স্কুলটি প্রতিষ্ঠা করেন। শুরুতে বোয়ালখালীর প্রাণকৃষ্ণ চৌধুরীর দান করা ৯ একর জমিতে বাঁশের বেড়া ও মাটি দিয়ে একটি অস্থায়ী ঘর বানানো হয়। প্রথমে স্কুলটিতে শুধু সপ্তম এবং অষ্টম শ্রেণির কার্যক্রম ছিল। পরে অন্যান্য শ্রেণির কার্যক্রম শুরু করা হয়। সেই সময় ভারতবর্ষজুড়ে চলা স্বদেশি আন্দোলনের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করে বাঁশের বেড়া, মাটি, ছন এবং অন্যান্য স্থানীয় উপকরণ ব্যবহার করে স্কুল ভবনটি তৈরি করা হয়। স্কুলের নির্মাণকাজ শেষ করতে ১৯১৮ থেকে ১৯২০ সাল পর্যন্ত প্রায় দুই বছর সময় লেগেছিল। বিধুভূষণ চৌধুরী ছিলেন স্কুলের প্রতিষ্ঠাকালীন প্রধান শিক্ষক। তিনি ছিলেন তৎকালীন ভারতবর্ষের ‘অল বেঙ্গল টিচার্স অ্যাসোসিয়েশনের’ একজন প্রভাবশালী শিক্ষক নেতা। তিনি ১৯১৭ থেকে ১৯২১ এবং ১৯২৫ থেকে ১৯৫৭ সাল পর্যন্ত স্কুলের প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব পালন করেছিলেন। স্কুলটি প্রথম ১৯১৯ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বীকৃতি লাভ করে এবং ১৯৪৬ সালে একই প্রতিষ্ঠান থেকে স্থায়ী স্বীকৃতি পায়। এ মাটির স্কুলের একটি কক্ষেই ১৯৪৩ সালের বাংলার কিশোর কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য ‘ক্ষুধার্ত বাতাসে শুনি এখানে নিভৃত এক নাম চট্টগ্রাম : বীর চট্টগ্রাম’ কবিতাটি লিখেছিলেন। বর্তমানে ওই কক্ষটি শিক্ষার্থীদের কাছে ‘সুকান্ত কক্ষ’ নামে পরিচিত। এ স্কুলে আছে প্রাচীন একটি গ্রন্থাগার। এখানে সংরক্ষিত আছে ব্রিটিশ আমলের নানা বই। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হন এ স্কুলের চার ছাত্র ও দুই শিক্ষক।