স্ত্রী ও দুই সন্তান নিয়ে ঢাকায় থাকতেন রাজবাড়ীর বালিয়াকান্দি উপজেলার বাসিন্দা সমীর মণ্ডল। বুধবার জ্বরে আক্রান্ত হন সমীরের স্ত্রী জয়ন্তী মণ্ডল (৩৩) ও মেয়ে প্রতিভা মণ্ডল (৩)। অসুস্থ অবস্থায় রাজধানীর একটি বেসরকারি হাসপাতালে রবিবার সকালে মারা যান জয়ন্তী মণ্ডল। পর দিন সন্ধ্যায় মারা যায় তাদের মেয়ে প্রতিভা মণ্ডল। এভাবে ঢাকা ও ঢাকার বাইরে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে মৃতের সংখ্যা প্রতিদিনই বাড়ছে। শুধু চলতি মাসেই ডেঙ্গু জ্বরে আশঙ্কাজনক হারে বেড়েছে মৃতের সংখ্যা। গত ২৩ দিনে এডিস মশাবাহিত ডেঙ্গু জ্বরে প্রাণ হারিয়েছে ৬০ জন, আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে আরও ১১ হাজার ৬৯৭ জন। আর চলতি বছরে প্রাণ হারিয়েছে ১৮২ জন। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানায়, এ বছর ডেঙ্গুতে মৃতের ৮১ শতাংশই তিন দিন বা তার বেশি সময় জ্বরে আক্রান্ত থাকার পর হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিল। দেরিতে হাসপাতালে ভর্তিই ডেঙ্গুতে মৃত্যুর প্রধান কারণ বলে অভিমত কর্তৃপক্ষের। অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তির ৪৮ ঘণ্টার মধ্যেই প্রায় ৭৪ শতাংশ রোগীর মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে ৫০ শতাংশ মারা গেছে ডেঙ্গু শক সিনড্রোমে (ডিএসএস)। এ ছাড়া মৃতের মধ্যে ৪৩ শতাংশ ডেঙ্গু ছাড়া অন্য রোগেও আক্রান্ত ছিল। সম্প্রতি ভাইরাসজনিত এ রোগের প্রকোপ বেড়ে যাওয়ায় প্রাথমিক পর্যায়ে পরীক্ষা ও সময়মতো হাসপাতালে ভর্তি হওয়া অত্যন্ত জরুরি বলে জানিয়েছেন স্বাস্থ্য কর্মকর্তারা। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির লাইন ডিরেক্টর অধ্যাপক ডা. হালিমুর রশিদ জানান, ডেঙ্গুতে ২০ থেকে ৩০ বছর বয়সিদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি মৃত্যু হয়েছে, ১৯ জন। এরপর ০ থেকে ১০ ও ৪০ থেকে ৫০ বছর বয়সিদের মৃত্যু সবচেয়ে বেশি, ১৬ জন করে। তাদের মধ্যে ৫৩ শতাংশ পুরুষ, বাকিরা নারী। এদিকে চলতি বছর ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি রোগীর সংখ্যাও বেড়েছে। গতকাল সরেজমিন মহাখালী ডিএনসিসি ডেঙ্গু ডেডিকেটেড হাসপাতালে দেখা যায়, বিছানায় শুয়ে কাতরাচ্ছে বিভিন্ন বয়সের মানুষ। হাতে ক্যানুলা লাগিয়ে দেওয়া হচ্ছে ফ্লুইড। দায়িত্বরত নার্স জানান, বৃদ্ধ রোগীদের বিভিন্ন রকম জটিলতা থাকায় তাঁরা বেশি ঝুঁকিতে থাকেন।
সবচেয়ে বেশি সমস্যা হচ্ছে শিশুদের নিয়ে। জ্বরের তীব্রতা, সঙ্গে সুঁইয়ের খোঁচায় ছোট্ট শিশুরা খুব কষ্ট পাচ্ছে। খেলনা দিয়ে বিভিন্নভাবে তাদের হাসিখুশি রাখার চেষ্টা করছেন স্বজনরা। হাসপাতালে বর্তমানে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে ভর্তি আছে ১২৯ জন।
দেশের ডেঙ্গু পরিস্থিতি বিষয়ে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক কীটতত্ত্ববিদ কবিরুল বাশার বলেন, ‘ডেঙ্গুর বিস্তার এখন শুধু প্রাকৃতিক ঋতু পরিবর্তনের ওপর নির্ভর করে না। মশার জীবনচক্র তাপমাত্রা ও আর্দ্রতার ওপর যেমন নির্ভরশীল, তেমন জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে এ ভেক্টরগুলোর প্রজনন মৌসুমও প্রসারিত হয়েছে। হালকা বৃষ্টিপাত মশার প্রজননস্থলগুলো পুনরায় সক্রিয় করে এবং প্রাপ্তবয়স্ক মশার আয়ু ও বিস্তার বাড়িয়ে দেয়। অতি ভারী বৃষ্টি অনেক সময় মশার ডিম বা লার্ভা ধ্বংস করে দিতে পারে। এ জটিলতা বোঝা এবং ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে সঠিক পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য একটি পূর্ণাঙ্গ আবহাওয়াভিত্তিক পূর্বাভাস মডেল গড়ে তোলা আবশ্যক।’