আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের স্বার্থে জুলাই জাতীয় সনদে কিছু বিষয়ে ছাড় দেওয়ার চিন্তা করছে বিএনপি। একই সঙ্গে সংসদ নির্বাচন বাধাগ্রস্ত বা বানচাল হতে পারে এমন সিদ্ধান্ত থেকেও বিরত থাকার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি সমমনা রাজনৈতিক দলগুলোকে এক কাতারে আনার চেষ্টা দলটির। সোমবার রাতে বিএনপির সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম জাতীয় স্থায়ী কমিটির বৈঠকে এ সিদ্ধান্ত হয়েছে বলে দলটির নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা গেছে। জানা গেছে, গত সোমবার রাতে রাজধানীর গুলশানে বিএনপি চেয়ারপারসনের রাজনৈতিক কার্যালয়ে রাত ৮টা ৩০ মিনিটে এই বৈঠক শুরু হয়। আড়াই ঘণ্টাব্যাপী এ বৈঠক শেষ হয় রাত ১১টার দিকে।
এতে লন্ডন থেকে ভার্চুয়ালি যোগ দিয়ে বৈঠকে সভাপতিত্ব করেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। বৈঠকে আরও উপস্থিত ছিলেন জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন (ভার্চুয়ালি), ব্যারিস্টার জমিরউদ্দিন সরকার, মির্জা আব্বাস, গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, ড. আবদুল মঈন খান, মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর (ভার্চুয়ালি), আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, সালাহউদ্দিন আহমদ, বেগম সেলিমা রহমান, মেজর (অব.) হাফিজ উদ্দিন আহমদ (বীর বিক্রম) ও ডা. এ জেড এম জাহিদ হোসেন। সূত্র জানায়, বৈঠকে জুলাই জাতীয় সনদের পূর্ণাঙ্গ সমন্বিত খসড়া নিয়ে পুঙ্খানুপুঙ্খ বিচার-বিশ্লেষণ করছে বিএনপি। বিশেষ করে বিএনপির ১০টি প্রস্তাবে ‘নোট অব ডিসেন্ট’ নিয়ে আবারও আলোচনা হয়। এর মধ্যে সংসদে উচ্চকক্ষে পিআর পদ্ধতি, রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে ক্ষমতার কিছু ভারসাম্য, প্রধানমন্ত্রী ও দলীয়প্রধান একই ব্যক্তি থাকতে পারবেন না এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনপ্রণালি- এসব বিষয়ে ছাড় দেওয়া হতে পারে। এই তিন ইস্যুতে নোট অব ডিসেন্ট দেওয়ার আগের অবস্থানও পর্যালোচনা করা হয়। এ ছাড়াও আরও কিছু কিছু বিষয় পর্যালোচনা করছে বিএনপির হাইকমান্ড। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, জাতীয় সনদের চূড়ান্ত খসড়ায় বিস্তারিত বিষয় তুলে ধরেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ। বৈঠকে স্থায়ী কমিটির সদস্যরা বলেন, সনদ বাস্তবায়নের অঙ্গীকারনামায় জুলাই সনদকে সংবিধানের ওপরে স্থান দেওয়া হয়েছে। কিন্তু কোনো ডকুমেন্ট বা নথির অবস্থান সংবিধানের ওপর হতে পারে না। অর্থাৎ জুলাই সনদকে সংবিধানের ওপর জায়গা দেওয়ার সুযোগ নেই। যদি এমনটা করা হয়, তাহলে সেটা ভবিষ্যতের জন্য খারাপ নজির হবে। এ ছাড়া জুলাই সনদ নিয়ে কোনো আদালতে প্রশ্ন তোলা যাবে না বলে অঙ্গীকারনামায় যে কথা বলা হয়েছে, সেটাও গ্রহণযোগ্য নয়। দলটি মনে করে, এসব বিষয় নিয়ে আলোচনা প্রয়োজন। সূত্র আরও জানায়, বৈঠকে জুলাই সনদের খসড়ার মতামত দেওয়ার জন্য সালাহউদ্দিন আহমদসহ তিন সদস্যবিশিষ্ট কমিটি গঠন করা হয়। ২০ আগস্ট জুলাই সনদের খসড়া জমা দেওয়ার শেষ দিন হলে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনে সময় বাড়িয়েছে দলটি। আগামীকাল বৃহস্পতিবার কমিশনে চূড়ান্ত মতামত জমা দেবে বিএনপি। এ ছাড়াও সমমনাদের কাছ থেকেও মতামত নেওয়ার সিদ্ধান্ত হয় বৈঠকে। এরই অংশ হিসেবে গতকাল রাতে গুলশানে গণতন্ত্র মঞ্চের সঙ্গে বৈঠক বসেন বিএনপির দায়িত্বশীল নেতারা। সূত্র আরও জানিয়েছেন, জুলাই সনদের পূর্ণাঙ্গ খসড়া নিয়ে সামগ্রিকভাবে খুব বেশি আপত্তি নেই বিএনপির। জুলাই সনদের চূড়ান্ত খসড়ার সূচনা ও ২, ৩, ৪ দফায় আপত্তি দলটির। সনদে উত্থাপিত ৮৪ দফার মধ্যে যেসব বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর ঐকমত্য হয়েছে, সেগুলোর বাস্তবায়নপদ্ধতি এবং যেসব বিষয়ে দলগুলো নোট অব ডিসেন্ট দিয়েছে, সেগুলোর সমাধানের পথ কী হবে, তা নিয়ে ঐকমত্য কমিশনে দলীয় মতামত তুলে ধরবে। এ ছাড়া বৈঠকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) নির্বাচনে নিয়ে আলোচনা হয়। ফ্যাসিবাদমুক্ত পরিবেশে এবার ডাকসু নির্বাচন হওয়ায় স্বাগত জানান স্থায়ী কমিটির সদস্যরা। তবে বৈঠকে একজন সদস্য বলেন, মব তৈরি করে ছাত্রদলের নেতা-কর্মীদের মনোনয়ন ফরম সংগ্রহ করতে বাধা দেওয়া হচ্ছে। এ ছাড়া মবের ভয়ে অন্য ছাত্ররাও মনোনয়ন ফরম তুলতে সাহস পাচ্ছেন না।
সমমনাদের এক তরিতে আনার চেষ্টা : যুগপৎ আন্দোলনরত শরিকদের জুলাই জাতীয় সনদের এক তরিতে আনার চেষ্টা করছে বিএনপি। এরই অংশ হিসেবে গতকাল রাতে গুলশানে গণতন্ত্র মঞ্চের সঙ্গে বৈঠক করেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান ও দলের দায়িত্বশীল নেতারা। বৈঠকে গণতন্ত্র মঞ্চের শীর্ষ নেতারা অংশ নেন।
জানা গেছে, ফ্যাসিবাদ পতন আন্দোলনে থাকলেও জাতীয় ঐকমত্য কমিশনে বিএনপির বিপরীতে মতামত দিয়েছে গণতন্ত্র মঞ্চ। বিশেষ করে বিএনপির নোট অব ডিসেন্ট দেওয়া প্রস্তাবে তারা একমত পোষণ করেছে। ফলে যুগপৎ আন্দোলনে থাকা শরিকদের এক তরিতে রাখার জন্যই এবং খসড়ার মতামত পর্যালোচনার জন্য বৈঠকে বসেন তাঁরা। গণতন্ত্র মঞ্চের সঙ্গে অনুষ্ঠিত বৈঠকে ঐকমত্য কমিশনে নোট অব ডিসেন্ট দেওয়া প্রস্তাবগুলোর মধ্যে দুই-একটি মৌলিক প্রস্তাবে বিএনপির ছাড় দেওয়ার আভাস পাওয়া গেছে।