রাজনৈতিক অস্থিরতা আর আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হওয়ায় স্থবির হয়ে পড়ছে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড ও ব্যবসাবাণিজ্য। এতে অর্থনৈতিক সংকট আরও বাড়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে। খোদ অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতিনিধিরাও স্বীকার করেছেন দেশের অর্থনীতি খুবই ভঙ্গুর অবস্থায় রয়েছে। এজন্য এলডিসি গ্র্যাজুয়েশনের জন্য সময়সীমা বৃদ্ধির আবেদন করা হচ্ছে। অন্যদিকে আর্থিক সংকটের কারণে ব্যয়ের লাগাম টানছে সরকার। শুধু তাই নয়, বাজেট ব্যয়ের পরিধিও কমিয়ে আনা হচ্ছে। আসছে ২০২৫-২৬ বাজেটের আকার কমিয়ে আনা হচ্ছে। চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেটও কাটছাঁট করে রেকর্ড হারে কমানো হচ্ছে। এতে করে জিডিপির প্রবৃদ্ধিও হ্রাস পাবে। অর্থবিভাগ সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে। অন্যদিকে স্বৈরাচারের বিদায়ের পর সাত মাস কেটে গেলেও দেশের সামগ্রিক পরিস্থতি স্থিতিশীল হয়নি। এর ফলে অর্থনৈতিক কর্মকা কমছে। একই সঙ্গে শিল্পকারখানায় উৎপাদন কমছে ধারাবাহিকভাবে। ব্যবসায়িক ক্ষেত্রের বিস্তৃতি কমছে। অনেক শিল্পকারখানা ইতোমধ্যে বন্ধ হয়ে গেছে। যদিও সেগুলো বন্ধের কারণ হিসেবে বলা হচ্ছে সংশ্লিষ্ট শিল্প মালিকদের নিজেদের কারণেই বন্ধ হয়েছে। সরকার কোনো শিল্পকারখানা বন্ধ করেনি।
এ প্রসঙ্গে ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (ডিসিসিআই) সাবেক সভাপতি আবুল কাসেম খান বলেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে নতুন করে বিনিয়োগ করার মতো যথেষ্ট আস্থা নেই। বিনিয়োগ ও ব্যবসা-বাণিজ্যের পরিবেশেরও উন্নতি হয়নি। বরং কোথাও কোথাও অবনতি হয়েছে। ফলে উৎপাদন খাতের জন্য দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগ পরিকল্পনা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু বাংলাদেশে কর ও রাজস্ব নীতিগুলো প্রতিবছর পরিবর্তিত হয়। এর ফলে বিনিয়োগকারীরা তাদের বিনিয়োগের ভবিষ্যৎ নিয়ে অনিশ্চয়তায় থাকেন। তাই অনেকেই উৎপাদন খাতে মূলধন ঝুঁকির চেয়ে বাণিজ্য ও সেবা খাতে বিনিয়োগ করাকে বেশি নিরাপদ মনে করেন। সামনে যে বাজেট আসছে সেই বাজেটে ব্যবসাসহায়ক নীতি গ্রহণ করা গেলে ও রাজনৈতিক পরিবেশ স্বাভাবিক হলে ব্যবসা-বাণিজ্যে গতি ফিরতে পারে। অন্যথায় অর্থনীতি আরও সংকটের দিকেই যাবে বলে তিনি মনে করেন। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) বলছে, দেশের অর্থনীতি আরও অন্তত দুই বছর শ্লথ থাকবে। এরপর গতি বাড়তে পারে। চলতি অর্থবছর শেষে জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৩ শতাংশে নেমে আসার আশঙ্কাও করা হচ্ছে। খোদ অন্তর্বর্তী সরকারও বলছে, অর্থনীতি ও ব্যবসা-বাণিজ্যের গতি কমায় কর্মসংস্থানও কমেছে। যার ফলে বেড়েছে বেকারত্ব।
বিশেষজ্ঞ ও শিল্প খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার প্রবণতা দেশের দীর্ঘমেয়াদি অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতাকে ঝুঁকির মুখে ফেলতে পারে। কারণ, উৎপাদন খাত ঐতিহ্যগতভাবে কর্মসংস্থান সৃষ্টি, উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি এবং রপ্তানি প্রবৃদ্ধির অন্যতম চালিকাশক্তি। সেবা খাত সম্প্রসারিত হলেও, শিল্প খাত পতনের দিকেই ধাবিত হচ্ছে। বিগত স্বৈরাচার সরকারের রেখে যাওয়া অর্থনৈতিক জঞ্জাল কাটাতে নানান রকম সংস্কারমূলক কর্মসূচি হাতে নিয়েছে সরকার। এসব সংস্কার কার্যক্রম শেষ করতে যথেষ্ট সময়েরও প্রয়োজন। এরই মধ্যে আবার রাজনীতি ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটায় বিনিয়োগকারী ও শিল্প উদ্যোক্তাদের উদ্বেগ উৎকণ্ঠা বেড়েছে। ফলে তারা নতুন করে কোনো বিনিয়োগে আগ্রহ দেখাচ্ছেন না। বিদেশি বিনিয়োগ তো আসছেই না। কারণ পুঁজি হারানোর ভয় জেঁকে বসেছে দেশি-বিদেশি উদ্যোক্তাদের মাথায়। যার ফলে বিনিয়োগ বাড়ছে না বলে মনে করে মাঝারি খাতের শিল্প উদ্যোক্তা কেপিসি ইন্ডস্ট্রিজের ব্যবস্থাপনা পরিচালক কাজী সাজেদুর রহমান। গত ২৯ জানুয়ারি বিবিএসের সর্বশেষ অর্থনৈতিক শুমারি ২০২৪-এর তথ্য অনুযায়ী, দেশে মোট ১১.৮৭ মিলিয়ন অর্থনৈতিক ইউনিট রয়েছে, যার মধ্যে ৮.৭৭ শতাংশ উৎপাদন এবং ৯১.২৩ শতাংশ সেবা খাতে যুক্ত। তুলনামূলকভাবে ২০১৩ সালে উৎপাদন খাতের অংশ ছিল ১১.৫৪ শতাংশ এবং ২০০৩ সালে ছিল ১২.১৪ শতাংশ।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য অনুসারে, ২০০৩ থেকে ২০১৩ সালের মধ্যে দেশে উৎপাদন ইউনিটের সংখ্যা প্রায় দ্বিগুণ হলেও পরবর্তী এক দশকে এ বৃদ্ধির হার কমে মাত্র ১৫ শতাংশে নেমে এসেছে। ২০০৩ সালে দেশে ৪ লাখ ৫০ হাজার ৩৪৮টি উৎপাদন ইউনিট ছিল, যা ২০১৩ সালে বেড়ে ৯ লাখ ২ হাজার ৫৮৩টিতে পৌঁছায়। তবে ২০২৪ সাল নাগাদ এ সংখ্যা সামান্য বৃদ্ধি পেয়ে ১০ লাখ ৪০ হাজারে দাঁড়িয়েছে। বর্তমান পরিস্থিতির উন্নতি না হলে দেশের অর্থনৈতিক কর্মকা আরও বেশি বাধাগ্রস্ত হবে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।