তেল-গ্যাস উৎপাদনকারী মধ্যপ্রাচ্যের কিছু দেশ কপ৩০-এ জীবাশ্ম জ্বালানির বিষয় আলোচনায় না আনতে জোর লবিং চালাচ্ছে। জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে ‘দ্রুত উত্তরণ’র প্রতিশ্রুতি দিতে নারাজ অনেক দেশ। সম্মেলনে তেল কোম্পানির বিপুল সংখ্যক প্রতিনিধির উপস্থিতিও বিতর্কের জন্ম দিয়েছে
ব্রাজিলের বেলেমে চলমান জলবায়ু সম্মেলনে (কপ৩০) ‘জীবাশ্ম জ্বালানি (কয়লা, তেল, গ্যাস)’ নিয়ে আলোচনা ক্রমেই উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে। কার্বন নিঃসরণ ও বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির জন্য অন্যতম দায়ী মনে করা হচ্ছে এই জ্বালানিকে। বিজ্ঞানীরা নবায়নযোগ্য জ্বালানির দিকে ধাবিত হওয়ার তাগিদ দিলেও বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে তেল রপ্তানিকারক দেশ ও কোম্পানিগুলো। সম্মেলনে অংশ নিয়েছে রেকর্ড সংখ্যক তেল কোম্পানির প্রতিনিধি, যারা বিষয়টিতে এজেন্ডার বাইরে রাখতে অব্যাহত চাপ সৃষ্টি করছে। জীবাশ্ম জ্বালানি বন্ধের ইস্যুতে বিভক্ত হয়ে গেছে রাষ্ট্রগুলোও। অন্যদিকে দূষণ না ঘটিয়েও জলবায়ু পরিবর্তনে অন্যতম ক্ষতিগ্রস্ত বাংলাদেশ, মালদ্বীপ, নেপালের মতো দেশগুলোর দাবি ‘লস অ্যান্ড ড্যামেজ’ তহবিলের কাঠামো চূড়ান্ত করা, অ্যাডাপ্টেশন ফাইন্যান্স, জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে সরে আসতে আর্থিক সহায়তা, প্রযুক্তি ও সক্ষমতা স্থানান্তর। তবে এসব বিষয়ে এখনো আসেনি কোনো আশার বাণী। সব মিলে এবারের জলবায়ু সম্মেলন কতটা সফলতা বয়ে আনবে তা নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে।
বিগত কপ২৮ সম্মেলনে বিশ্বের প্রায় ২০০টি দেশ একটি সাধারণ বিবৃতিতে সম্মত হয় যে জীবাশ্ম জ্বালানিভিত্তিক শক্তিব্যবস্থাকে ধীরে ধীরে প্রত্যাহার করা হবে। তবে বাস্তবে অনেক দেশ এখনো স্পষ্ট সময়সীমা ঘোষণা করেনি। এখনো জীবাশ্ম জ্বালানির নতুন অনুসন্ধান বা অনুসন্ধান লাইসেন্স দেওয়া এবং সাবসিডি দেওয়া চলমান রয়েছে। এ নিয়ে সরগরম এবারের কপ৩০। প্রতিটা দেশ নিজের স্বার্থ হাসিল ও ক্ষতিপূরণ আদায়ে জোর দিচ্ছে। সম্মেলনের আয়োজক দেশ ব্রাজিল অ্যামাজন বন রক্ষায় উদ্যোগী হয়েছে। তারা দক্ষিণ গোলার্ধের দেশগুলোর জন্য বেশি অর্থায়ন দাবি করেছে। দেশটি জ্বীবাশ্ম জ্বালানি বন্ধের রোডম্যাপের কথা বললেও এটা বন্ধের ব্যাপারে স্পষ্ট বক্তব্য দেয়নি। তবে দেশটির সাম্প্রতিক নতুন তেল-গ্যাস অনুসন্ধান লাইসেন্স দেওয়ার সিদ্ধান্ত সম্মেলনে সমালোচনার জন্ম দিয়েছে।
এদিকে জলবায়ু পরিবর্তনে অন্যতম ক্ষতিগ্রস্ত দেশ বাংলাদেশ। দেশের জলবায়ু ঝুঁকি মোকাবিলায় প্রণীত ‘জাতীয়ভাবে নির্ধারিত অবদান (এনডিসি ৩.০)’ বাস্তবায়নে বাংলাদেশের মোট ১১৬ দশমিক ৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার প্রয়োজন। এ নিয়ে তৎপর সরকার ও পরিবেশবাদী সংস্থাগুলো। কয়েক মাস ধরে বেশ জোরেশোরেই চলছিল কপ৩০ সম্মেলনের প্রস্তুতি। তবে ১০ নভেম্বর জলবায়ু সম্মেলন শুরুর পর তিন দিন খালি ছিল বাংলাদেশ প্যাভিলিয়ন। পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (জলবায়ু পরিবর্তন শাখা) মোহাম্মদ নাভিদ সাইফুল্লাহ ১৩ নভেম্বর সম্মেলনস্থলে পৌঁছে বাংলাদেশ প্যাভিলিয়নটি উদ্বোধন করেন। এরপরই সেখানে বিভিন্ন অধিবেশন শুরু হয়।
এবারের সম্মেলনে জলবায়ু পরিবর্তনে সর্বোচ্চ ঝুঁকিতে থাকা বাংলাদেশ, নেপাল, মালদ্বীপের মতো দেশগুলো জীবাশ্ম জ্বালানি হ্রাস করার পক্ষে মত দিলেও সেটা যাতে জ্বালানি নিরাপত্তা ও উন্নয়নকে ব্যাহত না করে সে ব্যাপারে গুরুত্বারোপ করেছে। একই সঙ্গে জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে রূপান্তরে জলবায়ু তহবিলে পর্যাপ্ত অর্থ দাবি করেছে। সর্বাধিক দূষণ সৃষ্টিকারী দেশগুলোকে তাদের প্রতিশ্রুত ক্ষতিপূরণের অর্থ দেওয়ার তাগিদ দিচ্ছে। দেশগুলোর মূল দাবির মধ্যে রয়েছে-লস অ্যান্ড ড্যামেজ ফান্ড, অ্যাডাপ্টেশন ফাইন্যান্স, প্রযুক্তি ও সক্ষমতা স্থানান্তর। তবে এখন পর্যন্ত এসব ব্যাপারে উল্লেখযোগ্য কোনো আশ্বাস আসেনি। লস অ্যান্ড ড্যামেজ ফান্ডে কে কত দেবে, কবে দেবে, কীভাবে দেবে তার কোনো তালিকা হয়নি।
বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় কার্বন নিঃসরণকারী দেশ যুক্তরাষ্ট্র এবারের সম্মেলনে জাতীয় পর্যায়ের কোনো উচ্চ প্রতিনিধিদল পাঠায়নি। দেশটি লস অ্যান্ড ড্যামেজ ফান্ডে সীমিত অর্থ দেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছে। একাধিক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে, ট্রাম্প প্রশাসন বিশ্ববাজারে ফসিল জ্বালানি সম্প্রসারণে আগ্রহী থাকায় সম্মেলনের মূল আলোচনায় যুক্ত হওয়ায় অনিচ্ছুক ছিলেন। তবে মার্কিন কয়েকটি উপজাতীয় পর্যায়ের প্রতিনিধি- যেমন ক্যালিফোর্নিয়ার গভর্নর গ্যাভিন নিউসম নিজ উদ্যোগে অংশ নিয়েছেন। তিনি যুক্তরাষ্ট্রের সম্মেলনে অংশ না নেওয়ার সিদ্ধান্তের সমালোচনাও করেছেন। সম্মেলনে একমাত্র মার্কিন ফেডারেল কর্মকর্তা হিসেবে উপস্থিত হয়েছেন সিনেটার শেলডন হোয়াইট হাউস। যুক্তরাষ্ট্র নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে বিনিয়োগ বাড়ানোর কথা বললেও জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে বের হওয়ার সময় নির্ধারণে অনীহা প্রকাশ করেছে।
ইউরোপীয় ইউনিয়ন অবশ্য প্যারিস চুক্তি অনুসারে তাপমাত্রা ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের লক্ষ্যমাত্রা বজায় রাখতে স্পষ্ট রূপরেখা চেয়েছে। তারা ২০২৩-২৪ সালের মধ্যে জীবাশ্ম জ্বালানি বন্ধের পক্ষে তাদের অবস্থান তুলে ধরেছে। বিশ্বের শীর্ষ কার্বন নিঃসরণকারী দেশ চীন অবশ্য ৩০০ সদস্যের বিশাল প্রতিনিধিদল নিয়ে সম্মেলনে হাজির হয়েছে। চীন বলছে, তারা তাদের জাতীয় স্বার্থ রক্ষা করার পাশাপাশি কার্বন নিঃসরণ কমাতে আন্তর্জাতিকভাবে অংশগ্রহণ করবে। তবে জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে উত্তরণে স্পষ্ট সময়সীমা দেয়নি।
তেল-গ্যাস উৎপাদনকারী সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাতের মতো মধ্যপ্রাচ্যের কিছু দেশ কপ৩০-এ জীবাশ্ম জ্বালানির বিষয় আলোচনায় না আনতে জোর লবিং চালাচ্ছে বলে বিভিন্ন পরিবেশবাদী সংস্থা অভিযোগ করেছে। তারা জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে ‘দ্রুত উত্তরণ’র প্রতিশ্রুতি দিতে নারাজ বা সময়সীমা দিতে সংকোচ করছে। সম্মেলনে তেল কোম্পানির বিপুল সংখ্যক প্রতিনিধির উপস্থিতিও বিতর্কের জন্ম দিয়েছে।
এবারের সম্মেলনের তাই মূল সংঘর্ষ সৃষ্টি হয়েছে- ধনী দেশগুলো কত দ্রুত ও কতটা কঠোরভাবে ‘জীবাশ্ম জ্বালানি উৎপাদন ও ব্যবহার হ্রাস’ করবে তা নিয়ে। অন্যদিকে রূপান্তর ঘটাতে উন্নয়নশীল ও জলবায়ু পরিবর্তনে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলো কি ঠিক মতো সহায়তা পাবে (অর্থ, প্রযুক্তি, সক্ষমতা)-এই আলোচনাও সামনে এসেছে। এবারের জলবায়ু সম্মেলন ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর জন্য অর্থায়ন ও প্রযুক্তি স্থানান্তরের পাশাপাশি কার্বন নিঃসরণ বন্ধে কতটা ভূমিকা রাখতে পারে সেটাই এখন দেখার বিষয়।