বাংলাদেশের সাগরতল এখন আর পুরোপুরি অজানা নয়। নীল জলের গভীরে লুকিয়ে থাকা জীববৈচিত্র্য, কোরালের বর্ণিল ভুবন, সামুদ্রিক প্রাণীর নীরব জীবন, সবই এখন চোখে দেখা যায় শরীফ সারওয়ারের ক্যামেরায়। তিনি বাংলাদেশের সামুদ্রিক গবেষণা ও পরিবেশ সংরক্ষণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছেন। তাঁর জন্ম ১৯৭১ সালের ৫ মে, নরসিংদীর রায়পুরা উপজেলার দরিহাইরমারা গ্রামে। তাঁর পরিবারের কেউ আন্ডারওয়াটার ফটোগ্রাফির সঙ্গে যুক্ত নন। তাঁর সাগরতলের যাত্রা শুরু ২০১২ সালের ফেব্রুয়ারিতে, বাংলাদেশের একমাত্র প্রবাল দ্বীপ সেন্টমার্টিনে। তখন তাঁর স্কুবা ডাইভিংয়ের কোনো অভিজ্ঞতা ছিল না। সাগর, সামুদ্রিক জীবন বা আলো-বাতাসের চাপ- এসব নিয়ে বিষদ জানা ছিল না। হাতে ছিল একটি ক্যানন জি বারো ক্যামেরা। আর সেটির ক্যামেরা হাউজিং এনে দিয়েছিলেন সিনিয়র ফটোসাংবাদিক জাকির হোসেন। প্রথম ডাইভেই শরীফ সারওয়ার বুঝে যান এটাই সেই জায়গা যেটা এত দিন তাঁর মন খুঁজছিল। শরীফ সারওয়ার পেশাগত জীবন শুরু করেন একজন ফটোসাংবাদিক হিসেবে। তিনি দীর্ঘদিন দেশের বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকে কাজ করেছেন। এক সময় টের পান অজানা অনেক গল্প লুকিয়ে আছে সাগরের নিচে। আন্ডারওয়াটার ফটোগ্রাফি শেখা সহজ ছিল না। তিনি নিজেকে তৈরি করেছেন আন্তর্জাতিকমানের প্রশিক্ষণের মাধ্যমে। তাঁর প্রাপ্ত সার্টিফিকেটগুলোর মধ্যে রয়েছে প্যাডি ওপেন ওয়াটার ডাইভার (২০১২, থাইল্যান্ড), প্যাডি অ্যাডভান্সড ওপেন ওয়াটার ডাইভার (২০১৪, থাইল্যান্ড), ই-এফ-আর প্রাইমারি অ্যান্ড সেকেন্ডারি কেয়ার (২০২৪, কুয়েত), রিফ চেক ইকো ডাইভার (২০২৪, মালয়েশিয়া), প্যাডি ডাইভ মাস্টার (২০২৫, মালদ্বীপ)। রিফ চেক ইকো ডাইভার সনদটি তাঁকে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত সামুদ্রিক পর্যবেক্ষক হিসেবে প্রতিষ্ঠা দিয়েছে। এই সার্টিফিকেট তাঁকে কোরাল রিফের স্বাস্থ্য নিরীক্ষা, ডেটা সংগ্রহ ও বৈজ্ঞানিকভাবে বিশ্লেষণের ক্ষমতা দিয়েছে। ফলে তিনি শুধু ছবি তোলেন না, তোলেন গবেষণার উপকরণ। শরীফ সারওয়ারের কাজ কেবল অ্যাডভেঞ্চার বা শিল্পের সীমায় সীমাবদ্ধ থাকেনি। ২০২৪ সালে মালয়েশিয়ার রিফ চেক থেকে প্রাপ্ত রিফ চেক ইকো ডাইভার সার্টিফিকেশনের মাধ্যমে তা বৈজ্ঞানিক পর্যবেক্ষণের স্তরে উন্নীত হয়েছে। এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ এবং আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত সনদ যা কোরাল এবং সামুদ্রিক বাস্তুতন্ত্রের স্বাস্থ্য নিরীক্ষা ও তথ্য সংগ্রহের ক্ষমতা প্রদান করে। দেশের বাইরে তাঁর ক্যামেরা ঘুরে বেড়িয়েছে বিশ্বের নানা সাগরে। তিনি আন্ডারওয়াটার ফটোগ্রাফি করেছেন থাইল্যান্ডের ফুকেট, পাতায়া, কো তাহো আইল্যান্ড, কো চ্যাং আইল্যান্ডসহ আন্ডামান সাগর এবং গালফ অব থাইল্যান্ডে। এ ছাড়া মালয়েশিয়ার দক্ষিণ চীন সাগর এবং মালদ্বীপের ভারত মহাসাগরেও তাঁর ক্যামেরায় ধরা পড়েছে সাগরতলের বর্ণিল জীববৈচিত্র্য ও প্রবাল জগতের অনন্য সৌন্দর্য। তাঁর তোলা ছবি ব্যবহার হচ্ছে বিভিন্ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানে। বাংলাদেশ ওশানোগ্রাফিক রিসার্চ ইনস্টিটিউট, পরিবেশ অধিদপ্তর, কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট, শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বোটানি, জুলজি ও এনভায়রনমেন্ট বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের মেরিন সায়েন্স বিভাগসহ বহু প্রতিষ্ঠানে। তাঁর ফটোগ্রাফি ব্যবহার হয় প্রজাতি শনাক্তকরণ, বাসস্থান পর্যবেক্ষণ, সামুদ্রিক দূষণ বিশ্লেষণ, কোরাল ব্লিচিং পর্যবেক্ষণ এবং জীববৈচিত্র্যের তালিকাভুক্ত কাজে। তিনি বলেন, ‘আমি এখন গবেষণামূলক কাজের জন্যই ছবি তুলি। কেউ যদি গঠনমূলক প্রয়োজনে ছবি নিতে চান, আমি সহযোগিতা করি।’ সাগরতলে কাজ মানেই ঝুঁকি। কখনো অক্সিজেন ট্যাঙ্ক ফুরিয়ে যাওয়া, কখনো শরীরে চাপের ভারসাম্য হারানো। বিপদ যেন সব সময়ের সঙ্গী। বলেন, ‘অনেকবার মৃত্যুর মুখে পড়েছি। কিন্তু প্রশিক্ষণ ও শান্ত মন আমাকে বাঁচিয়েছে। একবার ডাইভিং শেষে ট্যাঙ্কের বাতাস প্রায় শেষ হয়ে গিয়েছিল। কয়েক সেকেন্ডের ভুল সিদ্ধান্তেই হারাতে পারতাম প্রাণ। আজও সে কথা ভাবলে গা শিউরে ওঠে।’ চৌদ্দ বছরের অপেক্ষা, শত ডাইভ, হাজার স্বপ্ন সব মিলিয়ে শরীফ সারওয়ারের জীবনের এক অধ্যায়ের নাম মান্তা রে। পানির নিচের জগৎ তাঁর নেশা, তাঁর ভালোবাসা। কিন্তু সেই ভালোবাসার এক অপূর্ণতা ছিল স্বপ্নের প্রাণী মান্তা রে-কে কখনো কাছ থেকে দেখা হয়নি।
অবশেষে সেই স্বপ্নের রাত এলো মালদ্বীপের ঋবংফযড়ড় ঘরমযঃ গধহঃধ চড়রহঃ-এ। অন্ধকার সমুদ্রে নিঃশব্দে নামলেন তিনি। হঠাৎই গভীর জলের তলে ভেসে উঠল বিশাল এক ছায়া। ডানা মেলে রাজকীয় ভঙ্গিতে ভাসছে এক অপূর্ব মান্তা রে! টর্চের আলোয় ঝলমল করছে তার শরীর, সাঁতারের ভঙ্গিটা যেন এক নীরব কবিতা। ‘আমি স্থির হয়ে গিয়েছিলাম’, বলেন শরীফ সারওয়ার। ‘ক্যামেরা চালাচ্ছিলাম ঠিকই, কিন্তু মনে হচ্ছিল সময় থেমে গেছে।’ সেই মুহূর্তে তিনি বুঝেছিলেন, চেষ্টা ও ভালোবাসা থাকলে কোনো স্বপ্নই অসম্ভব নয়। মান্তা রে শুধু এক সামুদ্রিক প্রাণী নয়, ছিল তাঁর জীবনের সবচেয়ে আনন্দময় প্রাপ্তি, এক পূর্ণতার প্রতীক। মান্তা রে সাগরের গভীরে ভেসে থাকা এক বিস্ময়। পাখনার প্রস্থ কখনো কখনো ২০ ফুট পর্যন্ত হয়। যেন নীল জলের ভিতর ভেসে থাকা এক বিশাল জীবন্ত ছায়া। প্রাণীটি আসলে স্বভাবের দিক থেকে একেবারে নিরীহ। মাথার দুই পাশের শিং-সদৃশ ফ্ল্যাপগুলো ভয় দেখানোর জন্য নয়, বরং ক্ষুদ্র প্ল্যাঙ্কটন ধরার নরম হাত। বিজ্ঞানীরা বলেন, মান্তা রে পৃথিবীর সবচেয়ে বুদ্ধিমান মাছগুলোর একটি। আয়নায় নিজেকে চিনে ফেলার ক্ষমতাও তাঁর আছে।
শুরুতে শরীফের পরিবার ছিল অনিশ্চয়তায়। কেউ কেউ বলেছিল, ‘মাছের ছবি তুলে লাভ কী?’ আবার কেউ বলেছে, ‘এটা বিদেশিদের কাজ, বাংলাদেশে চলবে না।’ কিন্তু ধৈর্য, নিষ্ঠা ও সাফল্যই সব প্রশ্নের জবাব দিয়েছে। আজ শরীফ সারওয়ার বাংলাদেশের পরিবেশ সাংবাদিকতা ও সামুদ্রিক গবেষণার এক গুরুত্বপূর্ণ নাম। ২০০০ সাল থেকে এখন পর্যন্ত শরীফ সারওয়ার পেয়েছেন ২০টিরও বেশি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পুরস্কার। তাঁর উল্লেখযোগ্য পুরস্কারের মধ্যে রয়েছে- বাংলাদেশ পরিবেশ সাংবাদিক ফোরাম পুরস্কার, বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন পুরস্কার, বাংলাদেশ ফটোগ্রাফিক সোসাইটি পুরস্কার এবং বাংলাদেশ ফটো জার্নালিস্ট অ্যাসোসিয়েশন প্রদত্ত ‘ম্যান অব দ্য ইয়ার ২০০৯’ সম্মাননা। এসব স্বীকৃতি শুধু তাঁর পেশাগত সাফল্যের সাক্ষ্যই নয় বরং বাংলাদেশের সামুদ্রিক গবেষণা ও আন্ডারওয়াটার ফটোগ্রাফিতে তাঁর অগ্রণী অবদানেরও স্বীকৃতি বহন করে। শরীফ সারওয়ার এখন চান একটি বিজ্ঞানভিত্তিক আন্ডারওয়াটার ডেটাবেস তৈরি করতে, যেখানে বাংলাদেশের সামুদ্রিক জীববৈচিত্র্যের বিস্তারিত ভিজ্যুয়াল রেকর্ড থাকবে। তিনি বলেন, ‘আমি চাই ভবিষ্যৎ প্রজন্ম জানুক আমাদের সাগরের প্রকৃত রূপ। যেন তাঁরা সংরক্ষণে ভূমিকা রাখতে পারে। আমি শুধু ছবি তুলছি না, আমি সংরক্ষণ করছি এক জীবন্ত ইতিহাস।’