রংপুরের বদরগঞ্জ উপজেলার গোপালপুর ইউনিয়নের ব্যবসায়ী আশরাফুল ইসলামকে ২৬ টুকরো করে হত্যার ঘটনায় বাল্যবন্ধু জরেজ ও তার প্রেমিকা শামীমাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। গতকাল রাতে কুমিল্লার দাউদকান্দি থেকে মামলার প্রধান আসামি জরেজ মিয়াকে আটক করে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। একই দিনে জরেজের প্রেমিকা শামীমাকে আটক করে র্যাব-৩। এর আগে গতকাল এ ঘটনায় নিহত আশরাফুলের বোন আনজিনা বেগম বাদী হয়ে শাহবাগ থানায় মামলা করেন। মামলায় আশরাফুলের বন্ধু জরেজকে প্রধান আসামি করে অজ্ঞাত আরও বেশ কয়েকজনকে আসামি করা হয়।
জানা গেছে, গত মঙ্গলবার বাল্যবন্ধু জরেজ মিয়ার সঙ্গে ব্যবসায়িক কাজে ঢাকায় যান আশরাফুল। দুই বন্ধুর চট্টগ্রাম যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু বৃহস্পতিবার ঢাকার হাই কোর্ট এলাকা থেকে ড্রাম ভর্তি আশরাফুলের ২৬ টুকরো লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। এমন নৃশংস হত্যার পর জরেজ গ্রামের বাড়িতে না যাওয়ায় নিহত ব্যক্তির পরিবারের সন্দেহ হয়। তার মোবাইল ফোনটিও বন্ধ হয়ে যায়। ফলে সবার সন্দেহ হয় জরেজের দিকে।
এদিকে ব্যবসায়ী আশরাফুলের লাশ উদ্ধার হওয়ার পর থেকে পরিবার ও এলাকায় চলছে শোকের মাতম। অন্যতম উপার্জনক্ষম ব্যক্তিকে হারিয়ে দিশাহারা পরিবার। আশরাফুলকে ২৬ টুকরো করে নিমর্ম হত্যার কথা বারবার স্মরণ করে ডুকরে কাঁদছেন স্বজনরা। পরিবারের দাবি, আর্থিক লেনদেনের কারণে আশরাফুলকে হত্যা করেন তার বন্ধু জরেজ। জরেজের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানিয়েছেন তারা।
এ বিষয়ে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) রমনা বিভাগের ডিসি মাসুদ আলম বলেন, ‘মঙ্গলবার বাড়ি থেকে আশরাফুল ঢাকায় আসেন। বুধবার রাত ৯টা পর্যন্ত পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে তার কথা হয়। এরপর আর যোগাযোগ হয়নি। পরিবার ও আত্মীয়স্বজন সবাই সন্দেহ করছেন আশরাফুলের বন্ধু জরেজই এই হত্যার সঙ্গে জড়িত। আমদের একাধিক টিম এই হত্যাকাণ্ড নিয়ে কাজ করছে।’
স্থানীয় ও পরিবার সূত্রে জানা গেছে, রংপুরের ব্যবসায়ী আশরাফুল হিলি স্থলবন্দর থেকে কাঁচামাল কিনে ঢাকা-চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে পাইকারি বিক্রি করতেন। তার বন্ধু জরেজ সদর উপজেলার শ্যামপুরের বাসিন্দা ও তিনি দীর্ঘদিন মালয়েশিয়ায় ছিলেন। মাস দেড়েক আগে দেশে ফেরার পর আশরাফুলের সঙ্গে গভীর বন্ধুত্ব হয় জরেজের। আশরাফুলের সব ব্যবসাবাণিজ্য, হিসাবনিকাশ রাখতেন জরেজ। জাপান যাওয়ার জন্য আশরাফুলের কাছে তিনি ৩০ লাখ টাকা চান। স্বজনদের দাবি, ওই টাকা দেওয়ার জন্য জরেজের সঙ্গে ঢাকায় যান আশরাফুল। ওই টাকা বাদেও আশাফুলের কাছে আরও টাকা ছিল বলে ধারণা করছে পরিবার।
মঙ্গলবার আশরাফুল বন্ধু জরেজসহ ঢাকায় যান। বুধবার বিকালে আশরাফুলের সঙ্গে স্ত্রী লাকী বেগমের শেষ কথা হয়। সে সময় আশরাফুল স্ত্রীকে বলেন, ব্যস্ত আছি, পরে ফোন দেব। এরপর আর ফোন দেওয়া হয়নি আশরাফুলের। পরিবার জানায়, আশরাফুল দুটি ফোন ব্যবহার করতেন। যে ফোনে আশরাফুল সব সময় পরিবারের সঙ্গে কথা বলেন সেই ফোনে স্ত্রী ফোন দিলে ফোন ধরেন জরেজ। এ সময় জরেজ অসংলগ্ন কথা বলেন। বৃহস্পতিবার বদরগঞ্জ থানায় জিডি করতে আসেন পরিবারের সদস্যরা। সেখানে এসে জানতে পারেন আশরাফুলকে ঢাকায় নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়েছে। তার খণ্ডিত লাশ উদ্ধার করেছে পুলিশ।
আশরাফুলের শ্যালক আবদুল মজিদ বলেন, ‘বুধবার বিকালে আমার বোনের সঙ্গে আশরাফুলের শেষ কথা হয়।’ নিহত ব্যক্তির আরেক শ্যালক রেজোয়ান হোসেন বলেন, ‘আমার দুলাভাই ঢাকা যাওয়ার আগে হিমাগার থেকে ৬০ হাজার বস্তা আলু বিক্রি করেছিলেন। বিক্রির প্রায় ৩০ লাখ টাকা তার কাছে ছিল। জরেজ জাপান যাওয়ার জন্য আমার দুলাভাইয়ের কাছে টাকা চেয়েছিলেন। যেহেতু দুলাভাইয়ের মোবাইল ফোন তার কাছে পাওয়া গেছে, তাই সে টাকার জন্য এমন নির্মম হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে।’
নিহত ব্যক্তির বাবা আবদুর রশিদ বলেন, ‘মঙ্গলবার বিকালে আমাকে হাসপাতালে দেখতে যায় আশরাফুল। সঙ্গে ছিল জরেজ। আমি আশরাফুলকে বলেছিলাম, বাবা আমাকে হাসপাতালে রেখে তুই ঢাকায় যাইস না। এ সময় আমার ছেলেকে ঢাকায় যাইতে জরেজ খুব তাগাদা দেয়। আমি খুনিদের ফাঁসি চাই।’
আশরাফুলের স্ত্রী লাকী বেগম বলেন, ‘জরেজ মালয়েশিয়া থেকে আসার পর সব সময় আমার স্বামীর সঙ্গে থাকতেন। তিনি স্বামীর ব্যবসার সব তথ্য জানতেন। টাকার জন্য আমার স্বামীকে এমন নিমর্মভাবে হত্যা করা হয়েছে। আমি এর উপযুক্ত বিচার চাই।’
জানা গেছে, আশরাফুলের কোনো ভাই নেই। তার চার বোন আছে। ভাইবোনের মধ্যে আশরাফুল তৃতীয়। তার বাবা আবদুুর রশিদ একজন ক্ষুদ্র কাঁচামাল ব্যবসায়ী। ছোট থাকতেই বাবার হাত ধরে কাঁচামাল ব্যবসার সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন আশরাফুল। তার ১৩ বছর বয়সি সপ্তম শ্রেণিতে পড়ুয়া এক মেয়ে ও পাঁচ বছর বয়সি এক ছেলে রয়েছে।
বদরগঞ্জ থানার ওসি এ কে এম আতিকুর রহমান বলেন, ‘পরিবারের কাছ থেকে তথ্য সংগ্রহ করে তা ঢাকার ওসি শাহবাগ ও ডিসি রমনাকে সরবরাহ করেছি। তারা এসব তথ্য নিয়ে কাজ করছেন। পরিবার জানিয়েছে বন্ধু জরেজই আশরাফুলকে হত্যা করেছে। নিহতের পরিবারের সদস্যরা ঢাকায় মামলা করেছেন।’
এলাকার সাবেক ইউপি সদস্য আমজাদ হোসেন বলেন, ‘আশরাফুল কাঁচামালের ব্যবসা করতেন। তিনি একজন বড় ব্যবসায়ী ছিলেন। কাঁচামাল ট্রাকে করে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় পাঠাতেন। তিনি কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে জড়িত ছিলেন না। তিনি অত্যন্ত নম্র ও ভদ্র মানুষ ছিলেন। বছরের দুই ঈদে এলাকার গরিব মানুষদের দুই হাত প্রসার করে শাড়ি-লুঙ্গিসহ শুকনো খাবার বিতরণ করতেন। গরিব মানুষদের জন্য প্রতি বছর কোরবানির ঈদে একটি গরু কিনে মাংস বিতরণ করতেন। তার কোনো শত্রু ছিল না। ঢাকায় কেন তাকে নৃশংসভাবে হত্যা করা হলো, এর কারণ আমরা খুঁজে পাচ্ছি না। আমরা হত্যাকারীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চাই।’