যুক্তরাষ্ট্রে সরকারি খাতে দেখা দিয়েছে নজিরবিহীন পরিবর্তন। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার (এআই) প্রভাব যখন বিশ্বব্যাপী চাকরির বাজারে উদ্বেগ বাড়াচ্ছে, তখন ঠিক উল্টো চিত্র দেখা যাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রে। দেশটির হাজার হাজার কেন্দ্রীয় সরকারি কর্মী স্বেচ্ছায় চাকরি ছেড়ে যাচ্ছেন, যার ফলে ব্রেইন ড্রেইনের কবলে পড়া যুক্তরাষ্ট্রে সৃষ্টি হয়েছে প্রশাসনিক দক্ষতার সংকট।
প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ‘ডিলেইড রেজিগনেশন প্রোগ্রাম’ (ডিআরপি) অনুসরণ করে গতকাল মঙ্গলবারই কেন্দ্রীয় সরকার থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে অবসরে যান প্রায় ১ লাখ কর্মী। এছাড়া যুক্তরাষ্ট্রে চলতি সপ্তাহে চাকরি ছাড়ছেন রেকর্ড ১ লাখ ৫৪ হাজারেরও বেশি সরকারি চাকরিজীবী। এই চাকরিজীবীদের সবাই বেসামরিক প্রশাসনের বিভিন্ন দপ্তর, বিভাগ ও পরিষেবা খাতে কর্মরত। ৮০ বছরের মধ্যে এক বছরে এত বিপুলসংখ্যক সরকারি কর্মীর বিদায়ের ঘটনা এটি প্রথম। এর ফলে প্রশাসনে প্রাতিষ্ঠানিক দক্ষতার এক মারাত্মক সংকট তৈরি হতে যাচ্ছে বলে সতর্ক করেছেন বিশেষজ্ঞরা।
সরকারের মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে থাকা অফিস অব পার্সোনেল ম্যানেজমেন্ট (ওপিএম) জানিয়েছে, সব মিলিয়ে প্রায় ১ লাখ ৫৪ হাজার কর্মী এই প্যাকেজ গ্রহণ করেছেন, যাদের বাকিরা এ বছরের শেষ নাগাদ বিদায় নেবেন।
শোনা যাচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্রের আবহাওয়া দপ্তর, স্বাস্থ্যসেবা খাত, মহাকাশ গবেষণা কেন্দ্র বা নাসার বিভিন্ন প্রকল্প, কৃষি ও কৃষি গবেষণা সংক্রান্ত প্রকল্প, খাদ্য নিরাপত্তা সমুদ্র গবেষণা বিভাগসহ বেসামরিক প্রশসানের বিভিন্ন খাতের হাজার হাজার কর্মকর্তা ও কর্মচারী রয়েছেন এই বাইআউট প্রস্তাব গ্রহণকারীদের তালিকায়।
ওপিএমের দাবি, এই বিশাল কর্মী সংকোচনের ফলে দীর্ঘমেয়াদি ব্যয় কমে বছরে প্রায় ২ হাজার ৮০০ কোটি ডলার সাশ্রয় হবে। যদিও গত জুলাই মাসে সিনেটের এক বিশ্লেষণে বলা হয়েছিল, প্রায় ২ লাখ কর্মীকে আট মাস পর্যন্ত সবেতন ছুটিতে রাখতে এই কর্মসূচিতে সরকারের খরচই হবে প্রায় ১ হাজার ৪৮০ কোটি ডলার।
প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প জানুয়ারিতে ক্ষমতা গ্রহণের পর থেকেই কেন্দ্রীয় সরকারের আকার ছোট করার ওপর জোর দিয়ে আসছেন। টেসলার প্রধান নির্বাহী ইলন মাস্কের নেতৃত্বে তিনি 'ডিপার্টমেন্ট অব গভর্নমেন্ট এফিশিয়েন্সি' (ডোজ) নামে একটি নতুন বিভাগও প্রতিষ্ঠা করেন। এই বিভাগ প্রথমে সরকারি কাজে ২ ট্রিলিয়ন ডলারের অপচয়, জালিয়াতি ও দুর্নীতি নির্মূলের প্রতিশ্রুতি দিলেও পরে মাস্ক নিজেই সেই লক্ষ্য কমিয়ে ১৫০ বিলিয়ন ডলারে নামিয়ে আনেন।
গত ফেব্রুয়ারিতে প্রায় ২০ লাখ সরকারি কর্মীর কাছে 'অ্যা ফর্ক ইন দ্য রোড' শিরোনামে একটি ই-মেইল পাঠানো হয়। মাস্কের এই শিরোনামটি কুখ্যাত, কারণ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম টুইটার (বর্তমান এক্স) অধিগ্রহণের পরও তিনি কর্মীদের কাছে একই শিরোনামে বার্তা পাঠিয়েছিলেন। সরকারি কর্মীদের পাঠানো ওই বার্তায় সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বেতন নিয়ে পদত্যাগ করার প্রস্তাব দেওয়া হয়। এর পরপরই হাজার হাজার কর্মীকে ছাঁটাই করার পর কার্যত ইউএসএআইডির সব কর্মীকে চাকরিচ্যুত করা হয়।
সব মিলিয়ে ছাঁটাই, প্রবেশনারি কর্মীদের বিদায় এবং পদত্যাগ কর্মসূচি গ্রহণকারীদের নিয়ে এ বছরের শেষ নাগাদ কেন্দ্রীয় সরকারের কর্মী সংখ্যা প্রায় ৩ লাখ কমবে, যা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এক বছরে সবচেয়ে বড় কর্মী হ্রাসের ঘটনা।
মিশিগান বিশ্ববিদ্যালয়ের ফোর্ড স্কুল অব পাবলিক পলিসির অধ্যাপক ডন ময়নিহান বলেন, এত বিপুলসংখ্যক অভিজ্ঞ সরকারি কর্মীর বিদায়ের সবচেয়ে বড় প্রভাব হবে মেধা শূন্যতা তৈরি হওয়া। তিনি মনে করেন, প্রতিভার এই ক্ষতি সহজে পূরণ হওয়ার নয়। ময়নিহান বলেন, 'এই কর্মীরা যেসব সরকারি কর্মসূচি চালাতেন, সে বিষয়ে গভীর জ্ঞান ও দক্ষতা অর্জন করতে বছরের পর বছর সময় লাগে। এখন সেই জ্ঞানের ভান্ডার দরজা দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে।'
এক ডজনের বেশি বর্তমান ও সাবেক সরকারি কর্মী এবং ইউনিয়ন কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, প্রাতিষ্ঠানিক দক্ষতার এই ঘাটতির কারণে অনেক সরকারি সংস্থার পক্ষেই এখন তাদের স্বাভাবিক কার্যক্রম চালানো এবং জনগণকে সেবা দেওয়া কঠিন হয়ে পড়ছে।
আবহাওয়া পূর্বাভাস, খাদ্য নিরাপত্তা, স্বাস্থ্য কর্মসূচি ও মহাকাশ প্রকল্পের মতো সরকারের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ কার্যক্রম মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ট্রাম্প প্রশাসনের প্রস্তাব গ্রহণ করে মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসার প্রায় ৪ হাজার কর্মী চাকরি ছেড়েছেন। নাসার কর্মীদের প্রতিনিধিত্বকারী একটি ইউনিয়নের প্রেসিডেন্ট ম্যাট বিগস বলেন, 'সংস্থাটি বিশ্বের সেরা কিছু প্রকৌশলী ও মহাকাশ বিজ্ঞানীকে হারাচ্ছে, কিন্তু তাদের জায়গায় নতুন কাউকে নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে না।' এভাবে নাসা থেকে শুরু করে স্বাস্থ্য খাত, যুক্তরাষ্ট্রের সর্বত্রই প্রভাব পড়ছে।
তথ্যসূত্র : রয়টার্স।
বিডি-প্রতিদিন/শআ