দেশের খুচরা বাজারের মানচিত্র পাল্টে দিয়েছে সুপারশপ। সাধারণ দোকানগুলোর চেয়ে সুপারশপের দাম বেশি নয়, পণ্যের মানও ভালো- সাধারণ ক্রেতাদের মধ্যে এই আস্থা অর্জনের মাধ্যমে সুপারশপগুলো পেয়েছে সাফল্য। তাই সুপারশপগুলো এখন আর শুধু ধনী ক্রেতানির্ভর নয়; সাধারণ ক্রেতার সংখ্যা বাড়ছে দ্রুত। ফলে সুপারশপের সংখ্যাও বাড়ছে। বাড়ছে এ খাতের বিনিয়োগ। বর্তমানে এ খাতে বছরে লেনদেন হচ্ছে প্রায় ৬ হাজার কোটি টাকা।
রাজধানীর মগবাজারের স্বপ্নের আউটলেটে কেনাকাটা করতে এসেছিলেন আজহার মাহমুদ নামে এক ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী। তিনি বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, বাংলাদেশে সুপারশপের নাম শুনলেই মনে হতো সেখানে বড়লোকরাই যায়। দাম বেশি। তবে সেই ধারণা ভেঙেছে। বাইরে থেকে যে জিনিস কিনি একই দামে সেটা এখানে পাওয়া যায়। হিমেল চৌধুরী নামে আরেকজন বলেন, সুপারশপে সুন্দর পরিবেশে ঘুরে ঘুরে নিজের পছন্দমতো পণ্য কেনা যায়। দামও হাতের নাগালে। অনেক সময় দোকান থেকেও কম দামে পণ্য পাওয়া যায়। বিভিন্ন পণ্যে ছাড় চলে সবসময়।
সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ী ও ক্রেতারা জানান, দ্রুত নগরায়ণ, নাগরিক সুবিধা সংবলিত বাজারের অভাব, স্বাস্থ্যসম্মত ও নির্ভরযোগ্য পণ্যের চাহিদা পূরণ করে সুপারশপগুলো সবার আস্থা অর্জন করেছে। এ ছাড়া ডিজিটাল পেমেন্ট সুবিধা এই খাতের দ্রুত বৃদ্ধির মূল চালিকাশক্তি। সুপারশপ ব্যবসায়ীরা জানান, চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে অতিরিক্ত ৭ দশমিক ৫ শতাংশ ভ্যাট প্রত্যাহারের পর বিক্রির পরিমাণ বেড়েছে দ্বিগুণ, কারণ এখন ক্রেতাদের আলাদা ভ্যাট দেওয়ার প্রয়োজন পড়ে না। মীনা বাজারের ব্যবস্থাপক শামীম আহমেদ জায়গীরদার বাংলাদেশ প্রতিদিনকে জানান, বছরে সুপারশপগুলোতে প্রায় ৬ হাজার কোটি টাকা লেনদেন হয়।
জানা যায়, দেশে বর্তমানে বিভিন্ন নামে প্রায় শ খানেকের মতো সুপারশপ রয়েছে, যার মধ্যে সাত-আটটি বড় চেইন শপ। এই খাতে বর্তমানে মোট বিনিয়োগ প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা। সুপারশপগুলোতে কর্মরত আছেন প্রায় ২২ হাজার জনবল। সুপারশপের মধ্যে স্বপ্ন, আগোরা, মীনা বাজার, ইউনিমার্ট ও ডেইলি শপিং এখন ব্র্যান্ড নেইম। স্বপ্ন একাই বাজারের অর্ধেকের বেশি অংশ দখল করছে।
স্বপ্নের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সাব্বির হাসান নাসির বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, স্বপ্নের বর্তমান ফ্র্যাঞ্চাইজি আউটলেট সংখ্যা ৭৩৩টি। এর সঙ্গে যুক্ত ৯ হাজারের বেশি কর্মী। ২০২৪ সালের জানুয়ারি মাসে স্বপ্নের আউটলেট সংখ্যা ছিল ৪৪০টির মতো। সেই হিসাবে, দেড় বছরে সেটা বেড়েছে দেড়গুণের বেশি। আগামী পাঁচ বছরে স্বপ্নের আউটলেট সংখ্যা ৩ হাজার উন্নীত করার পরিকল্পনা রয়েছে বলেও জানান তিনি।
আউটলেট সংখ্যা বৃদ্ধির বিষয়ে তিনি বলেন, মানুষের আগে ধারণা ছিল সুপারশপে পণ্যের দাম সাধারণ দোকানগুলোর চেয়ে বেশি থাকে। প্রথমত সে ভুল ধারণাটা ভেঙেছে। আর দ্বিতীয়ত, মানুষ আসল পণ্য খোঁজে। সে বিশ্বাস সুপারশপগুলো অর্জন করতে পেরেছে। তাই সুপারশপগুলোতে ক্রেতার সংখ্যা বাড়ছে। শুধু ধনীরাই সুপারশপে যেতে পারে সে ধারণা অনেক আগেই কেটে গেছে। বিশেষ করে ফেব্রুয়ারিতে ভ্যাট ছাড়ের পর বিক্রি হু হু করে বেড়েছে। আমরা গুলশান শাখায় দেশের প্রথম সেলফ-চেকআউট চালু করেছি এবং গ্রাহক প্রতিক্রিয়ার ভিত্তিতে এ সেবা আরও বিস্তৃত করা হবে।
‘ডেইলি শপিং’ বাংলাদেশের বৃহত্তম বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের সহযোগী প্রতিষ্ঠান। প্রতিষ্ঠানটির বিপণন পরিচালক কামরুজ্জামান কামাল বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ভোক্তাদের কেনাকাটার অভ্যাস ও আস্থা উল্লেখযোগ্যভাবে বদলেছে। তাছাড়া সুপারশপে সাধারণ মানুষের আস্থা বেড়েছে। সহনীয় মূল্যে, বিভিন্ন ছাড়, ভালো সার্ভিসসহ বিভিন্ন কারণে মানুষ এখন সুপারশপগুলোতে ভিড় করছে। এখানে একই ছাদের নিচে ক্রেতারা সব কিনতে পারছেন যেটা সাধারণ মুদি দোকানে পারা যায় না। সুপার মার্কেটগুলো হোম ডেলিভারির সুবিধাও দিচ্ছে। সব মিলিয়ে সামনে সুপার মার্কেটের প্রভাব আরও বাড়তে পারে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, সুপার মার্কেট খাতের সম্ভাবনা বিশাল। ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে জীবনযাত্রার পরিবর্তন এবং চেইন ব্যবসার মান নিয়ন্ত্রণ এই খাতকে আরও সম্প্রসারিত করবে। তবে শিল্পের উন্নয়নে বিদেশি বিনিয়োগ, খুচরা জায়গার সাশ্রয়ী ভাড়া, নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ ও ইন্টারনেট এবং সরকারি প্রণোদনা জরুরি।