‘মানুষও বানাইল আল্লায় মানুষ নিল কত সাজ/কেউ আমরা প্রজা সাজি, কেউ সাজে মহারাজ/ আসলে পেটের দায়ে আমরা সবাই ধান্ধাবাজ/জিন্দাবাদ জিন্দাবাদ/বেঁচে থাকাই জিন্দাবাদ।’ ১৯৮০ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘জোকার’ সিনেমার একটি গান। গানটিতে কণ্ঠ দিয়েছেন প্রখ্যাত কণ্ঠশিল্পী সৈয়দ আবদুল হাদী। গানটির প্রতিটি চরণে একটি ধ্রুব সত্য বাঙ্ময় হয়েছে। আসলে আমরা মানুষ এই যে দুনিয়ায় বেঁচে আছি, তা কিন্তু নানা ফন্দিফিকির করেই। পেটের ভাত জোগাড় করার জন্য, মানে বেঁচে থাকার জন্য আমরা কত কী-ই না করি। কেউ ব্যবসা করি, কেউ করি চাকরি। আবার কেউবা করি চাষাবাদ। কেউ আবার মজুর খাটি। সবকিছু নিজে বা পরিবারকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য। শুধু মানুষ কেন, জগতের সব প্রাণীই বেঁচে থাকার জন্য নানা কায়দাকানুন রপ্ত ও প্রয়োগ করে থাকে। বন্য পশুরা একে অন্যকে হত্যা করে তাদের রক্তমাংস উদরস্থ করে ক্ষুণিœœবৃত্তি করে থাকে। নদীসমুদ্রের জলজ প্রাণীরাও তাই করে। এটা সৃষ্টিকর্তার বিধান। তিনিই তাঁর সৃষ্টির কে কোন পন্থায় জীবন ধারণ করবে তা স্থির করে দিয়েছেন। বড় মাছ ছোট মাছকে খেয়ে ফেলে, আমরা আবার সে বড় মাছকে শিকার করে নানারকম উপাদেয় রেসিপিতে রসনা তৃপ্ত করি। এর কোনোটাই অবৈধ বা গুনাহের কাজ নয়। আল্লাহ তাঁর প্রকৃতিকে এভাবে সুশৃঙ্খল করে তৈরি করেছেন।
পশু জগতে কোনো সমাজবদ্ধতা নেই, নেই নিয়মকানুনের বালাই। সেখানে ‘জোর যার মুল্লুক তার’ নীতিই প্রতিষ্ঠিত। সমাজ বা রাষ্ট্রের কোনো অস্তিত্ব সেখানে নেই। বনের পশুরা সব স্বাধীন। অনেকটা কবিগুরুর গানের মতো- ‘আমরা সবাই রাজা আমাদের এ রাজার রাজত্বে।’ সেখানে আইন নেই, বিধান নেই। শক্তিই টিকে থাকা ও প্রভুত্ব করার একমাত্র পথ। ওয়াইল্ড লাইভ টেলিভিশন প্রোগ্রামে দেখানো হয় বন্য পশুদের জীবনাচার। বাঘ, সিংহ, নেকড়ে, হায়েনার কাছে গরু, মহিষ, গয়াল, হরিণ, ঘোড়া, খরগোশ কত অসহায়। একটি বাঘ, সিংহ বা চিতাবাঘ যখন দৌড়ে এসে হরিণ কিংবা গরু-মহিষের ঘাড়ে কামড়ে ধরে ভূপাতিত করে, তখন আক্রান্ত নিরীহ পশুটির করুণ দশা কারও কারও হৃদয়কে নাড়া দেয় না তা নয়। কিন্তু প্রকৃতির বিধান অনুযায়ী তখন ‘সারভাইবাল ফর দ্য ফিটেস্ট’ বা ‘যোগ্যরাই টিকে থাকবে’ কথাটি পরিবর্তিত হয় ‘সারভাইবাল ফর দ্য স্ট্রংগেস্ট’ মানে ‘বলবানরাই টিকে থাকবে’ কথাতে।
বনে কোনো রাষ্ট্র নেই, সংবিধান থাকার তো প্রশ্নই আসে না। সেখানে নেই নির্বাচনব্যবস্থা। এমনকি রাজতন্ত্র কিংবা গণতন্ত্র কোনো কিছুরই অস্তিত্ব নেই। তারপরও আমরা সিংহকে বলে থাকি ‘বনের রাজা’। কেন, কোন তত্ত্বের ভিত্তিতে সিংহকে এই অভিধায় অভিহিত করা শুরু হয়েছিল, তা বোধ করি কারোরই জানা নেই। অবশ্য সাহিত্যিক ইমরুল চৌধুরী তাঁর শিশুতোষ গ্রন্থ ‘সিংহ কেন বনের রাজা’ বইতে যে কাল্পনিক কাহিনি তুলে ধরেছেন তা নিতান্তই শিশুদের বিনোদনের জন্য। একটি ছড়া তো আমরাও ছেলেবেলায় আওড়াতাম- ‘সিংহ আমি বনের রাজা, কেশর আছে ঘাড়ে/ আমার বাসা গহনগনে বন পাহাড়ের ধারে।’ যখন একটু বড় হলাম, চিন্তাশক্তি তার ডালপালা মেলল, তখন প্রশ্ন জাগল, আচ্ছা আমরা যে সিংহকে বনের রাজা বলি, বনের সিংহ কি তা জানে? যদি জানত, তাহলে সেই রাজাকে ধরে এনে চিড়িয়াখানার খাঁচায় বন্দি করে রাখা কি মানুষের পক্ষে সম্ভব হতো?
অবশ্য ইংরেজ সাহিত্যিক জর্জ অরওয়েল (আসল নাম এরিক আর্থার ব্লেয়ার) তাঁর ‘অ্যানিমেল ফার্ম’ উপন্যাসে পশুদের দলবদ্ধ হয়ে বিদ্রোহ ঘোষণা, সরকার গঠন ইত্যাদি বর্ণনা করেছেন। জর্জ অরওয়েল তাঁর লেখায় রূপক অর্থে সমাজবিপ্লবের নানা অসংগতি ও তার পরিণতি তুলে ধরেছেন। অ্যানিমেল ফার্ম উপন্যাসটিও তাই; যেখানে মি. জোন্স নামে একজন খামার মালিকের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে পশুরা বিদ্রোহ করে এবং তাকে বিতাড়িত করে খামারের কর্তৃত্ব হাতে নেয়। সে এক মজাদার কাহিনি। তবে সেটা কল্পকাহিনি, বাস্তবতার ধারেপাশে নেই। এখানে যে কথাটি আমি বলতে চাচ্ছি, তাহলো বনে যেহেতু কোনো সমাজ বা রাষ্ট্র নেই, তাই সেখানকার বাসিন্দারা যে যার মতো চড়ে বেড়ায়, আহার সংগ্রহ করে খায় এবং অপেক্ষাকৃত বলশালীদের থাবা থেকে কৌশল প্রয়োগ করে জীবন রক্ষা করে।
কিন্তু মানবসমাজে তা সম্ভব নয়। কেননা, মানুষ যে সমাজে বসবাস করে, তা লিখিত ও অলিখিত কিছু নিয়মবিধির দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। মানুষের সঙ্গে পশুর পার্থক্য হলো বিবেক। হ্যাঁ, একমাত্র বিবেকই মানুষকে পশু থেকে আলাদা করেছে। ‘বিবেকহীন মানুষ পশুতুল্য’ কথাটির প্রচলন হয়েছে সে কারণেই। বিবেকের তাড়নায় আমরা অনেক কাজ করি, আবার কিছু কিছু কাজ করতে পারি না। তারপরও কিছু মানুষ এমন সব কাজ করে, যা পশুকেও হার মানায়। পশুকুলের মধ্যে হায়েনা হলো সবচেয়ে হিংস্র। অন্যান্য হিংস্র পশু শিকার ধরে প্রথমে সেটাকে মেরে তারপর খায়। কিন্তু হায়েনা জীবন্ত শিকারকে ছিঁড়ে খাওয়া শুরু করে। পশুর এই হিংস্রতা বর্তমানে মানুষের মধ্যে ভালোভাবেই সংক্রমিত হয়েছে। মানুষ এখন একজন আরেকজনের বুকে গুলি চালাতে দ্বিধা করে না, হাত কাঁপে না কারও গলায় ছোরা বসাতে।
প্রখ্যাত কথাসাহিত্যিক ও নাট্যকার-পরিচালক হুমায়ূন আহমেদের বহুব্রীহি নাটকে অভিনেতা আবুল হায়াত ও আসাদুজ্জামান নূরের সংলাপে মানুষ ও পশুর স্বভাবের একটি পার্থক্য চমৎকারভাবে ফুটে উঠেছে। আবুল হায়াতের মানুষের চেয়ে শ্রেষ্ঠ জীব কী- এ প্রশ্নের উত্তরে নূর বলছিলেন, ‘মাঝে মাঝে পশুকে আমার মানুষের চেয়েও শ্রেষ্ঠ মনে হয়। যেমন হিংস্র বাঘ। সে নিজের জন্য ততটুকু খাবারই সংগ্রহ করবে, যতটুকু প্রয়োজন। এর বেশি কিছু নয়। কিন্তু কিছু কিছু মানুষ অপরকে বঞ্চিত করে সম্পদের পাহাড় জমা করে। এ ক্ষেত্রে পশুরা মানুষের চেয়ে শ্রেষ্ঠ।’ আসাদুজ্জামান নূরের এ ডায়ালগ, যেটির স্রষ্টা হুমায়ূন আহমেদ, তা যে কতটা অভ্রান্ত ব্যাখ্যা করে বলার দরকার পড়ে না। আসলে আমাদের ক্ষুধার জ¦ালা যেন সহজে মেটে না। দাউ দাউ করে সারাক্ষণ জ¦লতেই থাকে। না, আমি খাদ্য-খাবারের ক্ষুধার কথা বলছি না। বলছি ক্ষমতা বা অর্থসম্পদের যে সর্বগ্রাসী ক্ষুধা আমাদের অনেকের চিন্তাচেতনাকে এমনভাবে আচ্ছন্ন করে রেখেছে, তার যেন অন্ত নেই। সবার ক্ষুধা একরকম নয়। কেউ খায় খুব মেপে, পরিমিত। আর কেউ খায় গোগ্রাসে। কারও কারও খাদ্যগ্রহণ দেখলে মনে হয় তারা বাঁচার জন্য খায় না, খাওয়ার জন্যই বেঁচে আছে। পরিমিত আহার গ্রহণ স্বাস্থ্যের জন্য ভালো। আর অপরিমিত খাবার গ্রহণ শরীরে নানারকম রোগব্যাধির জন্ম দেয়।
রচনাটি শুরু করেছিলাম মানুষের দুনিয়াতে বেঁচে থাকার নানা ফন্দিফিকির নিয়ে। এই বেঁচে থাকার জন্য কেউ রাজা হয়ে প্রজার ওপর জুলুম-নির্যাতন চালায়, আবার কেউ রাজার ওপর মহারাজার আসনে বসে ছড়ি ঘোরায়। যেহেতু এখন আর কার্যকর রাজতন্ত্র নেই, তাই রাজা-মহারাজার প্রতাপও দেখা যায় না। তবে সমাজে একশ্রেণির মানুষ তাদের প্রভুত্ব বিস্তারের জন্য নানারকম কূটকৌশলের আশ্রয় নিয়ে থাকে। বেঁচে তো থাকে সবাই। তবে অন্যের ওপর প্রভুত্ব বিস্তার করে বেঁচে থাকার মজাই আলাদা। এই মজা লুটতে কেউ আশ্রয় নেয় কূটকৌশলের, আবার কেউ বেছে নেয় নৃশংসতা।
বর্তমান সময়ে মানুষের ওপর প্রভুত্ব বিস্তারের দুটি হাতিয়ার মোক্ষম হিসেবে স্বীকৃত। এক. রাজনীতি। দুই. অর্থবিত্ত। এ দুটি মাধ্যম এখন একটি আরেকটির পরিপূরক। অর্থাৎ দুইটি আপনার হাতে থাকলে আপনি অপ্রতিদ্বন্দ্বী। রাজনৈতিক ক্ষমতা হাতে থাকলে ইচ্ছা করলে বিত্তশালী হতে পারবেন। আর যদি আপনার অর্থবিত্ত থাকে, তাহলে রাজনৈতিক ক্ষমতা করায়ত্ত করা আপনার জন্য ফুসমন্তরের ব্যাপার। একটি কথা ঠাট্টাচ্ছলে অনেকেই আজকাল বলেন, ‘রাজনীতি আর আগের মতো নাইরে ভাই, রাজনীতির মধ্যে পলিটিক্স ঢুকে গেছে।’ কথাটিকে অর্থহীন মনে হওয়া স্বাভাবিক। তবে রাজনীতি নিয়ে এ শ্লেষাত্মক বাক্যটি একেবারে অর্থহীন নয়। রাজনীতি যে আজ কতিপয় মানুষের ধান্দাবাজির মাধ্যমে পরিণত হয়েছে, এ কথা অস্বীকার করার কি উপায় আছে?
রাজনীতি ছিল একসময় মানবসেবার অন্যতম বাহন। অতীতে যারাই রাজনীতিতে আত্মনিমগ্ন হয়েছেন, তারা সবাই মানবসেবাকে ব্রত হিসেবে গ্রহণ করেই এ পথে হাঁটতে শুরু করেছিলেন। তাদের চিন্তাচেতনাজুড়ে থাকত দেশ ও মানুষ। ব্যক্তিগত লাভলোকসান কিংবা স্বার্থ কোনোটাই স্থান পেত না তাদের ভাবনায়। এই দেশকে ভালোবেসে কেউ জীবন দিয়েছেন অকাতরে, কেউ কারাগারের অন্ধকার প্রকোষ্ঠে কাটিয়েছেন বছরের পর বছর। তারও আগে ইংরেজ ঔপনিবেশিক আমলে অনেকের ভাগ্যে ঘটেছে দ্বীপান্তরের শাস্তি; যা কারাগারের চেয়েও ভয়ংকর। ভারত মহাসাগরের মাঝে আন্দামান নামে এক জনমানবহীন দ্বীপে নিঃসঙ্গ বসবাসের দুর্বিষহ কাহিনি অনেক বইপুস্তকে বিধৃত আছে।
এখন সময় বদলেছে। আগের সে ধারা আর নেই। রাজনীতি এখনো জনসেবার মাধ্যম, তবে তা মৌখিক, মৌলিক নয়। আরও পরিষ্কার করে বললে বলতে হয়, এখন তা কতিপয়ের ভাগ্য গড়ার বাহন ছাড়া আর কিছুই নয়। আর সেজন্যই এখন এই মাধ্যমে নাম লেখানোর জন্য দীর্ঘ লাইন দেখতে পাওয়া যায়। এখানেও কিন্তু বেঁচে থাকার বিষয়টি জড়িত। এই বেঁচে থাকা ‘রাজনৈতিক নেতা’র পরিচয়ে মানুষের মধ্যে বেঁচে থাকার অদম্য ইচ্ছা। কিন্তু রাজনীতির খাতায় নাম লেখালেই কি সবাই মানুষের মনে বা ইতিহাসে বেঁচে থাকতে পারে? যে লোকটি আজ অর্থবিত্তের জাদুতে নেতার আসনে জেঁকে বসতে পেরেছে, সে আদৌ তার উপযুক্ত কি না, তা অনেকেই হিসাব করেন না। আর তাই ওই সব অরাজনৈতিক রাজনীতিকের পদতলে অর্ঘ্য দেওয়ার জন্য ব্যাকুল জনতার বিপুল উপস্থিতি লক্ষ করা যায়। তবে ইতিহাস হলো সব কিছুর পরিমাপক। অর্থবিত্তের বদৌলতে আজকের ‘মহান নেতা’ একসময় নিক্ষিপ্ত হন আস্তাকুঁড়ে।
♦ লেখক : সাংবাদিক ও কলাম লেখক