পবিত্র মাহে রমজানের শেষ সপ্তাহে এই নিবন্ধ লিখতে গিয়ে বারবার খেই হারিয়ে ফেলছি। যা দেখছি তা বিশ্বাস হচ্ছে না, যা বিশ্বাস করছি তা ঘটছে না। প্রতিদিনই পরস্পরবিরোধী ঘটনার তাড়নায় মাঝেমধ্যে স্মরণশক্তি হারিয়ে ফেলছি, যা আমার অতীত জীবনে কখনো ঘটেনি। বর্তমানে আমি যে কাজকর্ম করছি তা ২০১০-১২ সালের তুলনায় কিছুই না। সেই সময়ে জাতীয় সংসদের সদস্যরূপে মাসে একবার নির্বাচনি এলাকায় যেতাম। দৈনিক কম করে হলেও হাজারখানেক লোকের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে হতো। প্রতি মাসেই ব্যবসা উপলক্ষে বিদেশ যেতাম, মাসে ৩০-৩৫টি টক শো, সংসদে হাজিরা, তিনটি জাতীয় দৈনিকে প্রতি সপ্তাহে চারটি লেখার জন্য কমপক্ষে ৭ হাজার শব্দের জোগান মনমস্তিষ্ক থেকে দিতে হতো।
উল্লিখিত কর্ম ছাড়াও নিজের শিল্পপ্রতিষ্ঠানে কয়েক হাজার কর্মচারীর নেতৃত্ব প্রদান, সংসারে স্ত্রীকে সাহায্য, তিনটি ছেলেমেয়ের লেখাপড়ার দায়িত্ব- তাদের স্কুলে পৌঁছে দেওয়া, বৃদ্ধ পিতামাতার সেবা ছাড়াও আত্মীয়স্বজনের প্রতি দায়িত্ব ও কর্তব্য পালন করার পরও মনে হতো আমি কিছুই করছি না, তখন আমার হাতে প্রচুর সময় ছিল। আহারেবিহারে রুচি ছিল এবং প্রচণ্ড স্মরণশক্তি ছিল। সবার টেলিফোন ধরতাম, কেউ দাওয়াত দিলে অংশগ্রহণ করতাম এবং বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে চুটিয়ে আড্ডা দিতাম। হাল আমলে আমার আদিকালের কোনো কিছুই নেই, কিন্তু আমি এখন ভীষণ ব্যস্ত। ব্যস্ততায় ঘুম আসে না আর একবার ঘুমালে মনে হয় মরে গেছি। অর্থাৎ ঘুম থেকে আর উঠতে ইচ্ছে করে না। আগের মতো ক্ষুধা লাগে না এবং খাবার টেবিলে বসলে মনে হয় সিদ্ধিগুরু বাল্মীকি হয়ে গেছি অর্থাৎ না খেয়ে কবি হওয়ার ধ্যান করার পর্যায়ে পৌঁছে গেছি।
ইদানীংকালে আমার যে সমস্যা আমাকে নিদারুণভাবে ভোগায়, তা হলো হুটহাট করে অনেক কিছু ভুলে যাওয়া এবং পরবর্তী সময়ে মনে পড়লে তা করার জন্য যে উথালপাথাল শুরু করি তার ফলে একদিকে যেমন নিজের ওপর অত্যাচার শুরু করি অন্যদিকে আমার আপনজনদের জীবনও দুর্বিষহ করে তুলি। এই ধরুন, আজকের নিবন্ধের বিষয়টির কথাই বলা যাক। বাংলাদেশ প্রতিদিন পত্রিকায় আমার কলাম প্রকাশিত হয় প্রতি সোমবার। বিভাগীয় সম্পাদকের অনুরোধে আমি শনিবার বিকালের মধ্যেই লেখা পাঠিয়ে দিই। অথচ চলতি শনিবার আমি সারা দিন বগল বাজালাম কত হেনতেন ভাবলাম- কিন্তু দিনটি যে শনিবার তা একটিবারের জন্য মনে এলো না। রবিবার ভোর ৫টার সময় মনে হলো, আরে আমি তো শনিবারের নির্ধারিত কর্ম করিনি। তারপর সেই ভোরেই শুরু করলাম আজকের শিরোনাম নিয়ে আপনাদের কাছে দু-চারটি সুখদুঃখের কাহিনি বলার প্রচেষ্টা।
আলোচনার শুরুতেই যেটা বলেছিলাম অর্থাৎ যা দেখছি তা বিশ্বাস হচ্ছে না এবং যা বিশ্বাস করছি তা ঘটছে না, এই রসায়নের কারণে চলমান বাংলাদেশে আমার মতো অনেকের জীবনেই ছন্দপতন ঘটেছে। মানুষের জীবনের কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বিভাগ-অনুবিভাগ রয়েছে। যেকোনো অত্যাধুনিক মেশিনের মতো মানুষের যেমন সফটওয়্যার-হার্ডওয়্যার রয়েছে তদ্রুপ চিন্তা ও কল্পনা করার স্বপ্ন দেখার অসাধারণ ক্ষমতা রয়েছে, যা কোনো মেশিন তো দূরের কথা এমনকি অন্য কোনো প্রাণীরও নেই। মানুষের স্মরণশক্তি, বিচারবিবেচনা শক্তি, ভালোমন্দের পার্থক্য করার শক্তি এবং নিজের অজান্তে ভালো পথ অনুসরণ করার সুপ্ত বাসনার কারণে পৃথিবীতে বাহারি সব মনের সভ্যতার জন্ম হয়ে থাকে। মানুষের মানবিক সত্তার উন্নয়ন এবং মানব শরীরের কর্মক্ষমতা অর্জনের জন্য পরিবেশ-প্রতিবেশ, ঘরসংসার বা সমাজসংসার এবং রাষ্ট্রীয় বিধিব্যবস্থা সর্বোপরি রাজনীতি বহুলাংশে দায়ী।
চলমান রাজনীতির দুরবস্থা, অকার্যকর রাষ্ট্রীয় বিধিব্যবস্থা এবং সর্বত্র কচিকাঁচার মেলার ভেঁপুর শব্দ, লেবেনচুষের লালার যন্ত্রণা এবং সমাজে শিশুতোষ কর্মের অত্যাচারে শ্রমজীবীর শ্রমের শক্তি হ্রাস পেয়েছে, ব্যবসায়ীর ঝুঁকি নেওয়ার সামর্থ্য শেষ হয়েছে, কবির কবিতা লেখার বাসনার সলিলসমাধি ঘটেছে এবং মানুষের বেঁচে থাকার আশা হাহাকারে পরিণত হয়েছে। ফলে যে মানুষ গত ২৫-৩০ বছরে একটিবারের জন্যও আর্থিক সংকটে পড়েননি তারাও দুমুঠো অন্নের চিন্তায় ছোটাছুটি শুরু করেছেন। মানুষের বেঁচে থাকার অদম্যশক্তিতে ঘুণ ধরেছে। ফলে যে যার অবস্থানে থেকে তার মানবিক সত্তা হারিয়ে ফেলেছে।
সমাজে পরস্পরবিরোধী কর্মকাণ্ড প্রবল থেকে প্রবলতর হচ্ছে। কিন্তু পণ্যের মূল্য এতটা কমেছে, যার কারণে প্রান্তিক চাষিরা রীতিমতো দেউলিয়া হয়ে পড়েছে। শহরের বাজারগুলোতে ২৫ টাকা কেজি পিঁয়াজ ও ১০ টাকা কেজি আলুর দামের মধ্যে দেশ জাতির কত বড় সর্বনাশ লুকায়িত তা অনুধাবন না করেই সরকার সমর্থকরা উদাম নৃত্য শুরু করেছে ইতিহাসের ভয়াবহ দরপতনের উৎসব উদযাপনের জন্য। অন্যদিকে পর্যাপ্ত সরবরাহ থাকা সত্ত্বেও কেন ভোজ্য তেল উধাও, কেন চালের দাম হু হু করে বাড়ছে এবং হঠাৎ গত সাত মাসে কীভাবে নতুন ৫ হাজার কোটিপতি জাতির ঘাড়ে চেপে বসল তা নিয়ে কেউ টুঁ-শব্দটি করছে না।
আওয়ামী লীগের পতনের পর বাজারে দরবেশ নেই, নেই সেই আমলের সিন্ডিকেট। ছাত্রলীগ-যুবলীগের চাঁদাবাজি বন্ধ। তাহলে এখন কেন শেয়ারমার্কেট ঘুরে দাঁড়াতে পারছে না। ইতিহাসের সবচেয়ে বেশি পরিমাণ রেমিট্যান্স আসার পরও কেন রিজার্ভের পরিমাণ বাড়ছে না। আওয়ামী জমানার টাকা পাচার বন্ধ। উল্টো আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের বাসাবাড়ি, মিলকারখানা, অফিসসমূহে মব চালিয়ে শত শত কোটি নগদ অর্থ ও স্বর্ণালংকার হস্তগত করার পর ক্রোধের বসে বাড়িঘর, আসপাব, পোশাকপরিচ্ছদ তছনছ করা হচ্ছে এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে আগুন লাগিয়ে দেওয়া হচ্ছে। গুলশান-বনানী-ধানমন্ডি-বসুন্ধরা-উত্তরার মতো অভিজাত এলাকায় টার্গেট করে মব চালানো হচ্ছে। মব ডাকাতির লোপাট করা অর্থের ভাগাভাগির পূর্বপরিকল্পনা করে মব সন্ত্রাসীরা রাতবিরাতে যে নির্মম পৈশাচিক ঘটনা ঘটাচ্ছে, যা গত কয়েক শ বছরের ইতিহাসে বাংলার জমিনে ঘটেনি। ফলে যারা মবের দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে তারা ছাড়াও সাধারণ আমজনতা, যারা এসব দেখছে, শুনছে তাদের মধ্যে ভয়ানক আতঙ্ক তৈরি হচ্ছে। ফলে মানুষের চিন্তা ও কর্মে যে স্বাভাবিক গতিময়তা থাকে, তা মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে।
গত মাত-আট মাসে মানুষের চিন্তা ও চেতনার যে বিবর্তন ঘটেছে তা ইতোপূর্বে ঘটেনি। ১৯৭৪ সালে যখন দুর্ভিক্ষ হয়েছিল তখনো মানুষের মনে আশা ছিল যে তারা বেঁচে থাকতে পারবে। ক্ষুধার্তরা বিশ্বাস করত গৃহস্থরা ভাতের মাড়ের সঙ্গে একমুঠো ভাত অবশ্যই দেবে। ধনীরা পকেট উজাড় করে মানুষকে দানখয়রাত করত। ১৯৭৫ সাল থেকে পুরো আশির দশকের মাঝামাঝি সময় অর্থাৎ টানা ১০ বছর পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টির দাপট, ডাকাতি ও সন্ত্রাসের মহাউৎসব ছিল। কিন্তু জনগণের বিশ্বাস ও আস্থায় চিড় ধরেনি। গণধর্ষণ, শিল্প-কলকারখানায় অগ্নিসংযোগ অথবা বুলডোজার দিয়ে কারও বসতবাড়ি কোনো সর্বহারা দলের কর্মী অথবা ডাকাতের দল গুঁড়িয়ে দেবে এমন কথা কল্পনাও করা যেত না। ফলে তখনকার দিনের মানুষের মানবিক ও আত্মিক উন্নয়ন থেমে থাকেনি। তারা বর্তমান জমানার মজলুমদের মতো বলত না, কই যাব।
কোর্টকাচারি, অফিস-আদালতে কী চলছে, তার একটি নমুনা কয়েক দিন আগে জাতীয় দৈনিকগুলোর শিরোনাম হয়েছিল। গ্রেপ্তার হওয়া পুলিশের সাবেক আইজি আবদুল্লাহ আল-মামুন কোর্টে তার উকিলের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে উকিলকে কম কথা বলার পরামর্শ দিয়েছেন। কারণ তিনি মনে করেন, তার উকিল যত যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করবেন ততই তার দুর্ভোগ বাড়বে এবং তিনি নিত্যনতুন রিমান্ডের কবলে পড়বেন। পুলিশের সাবেক আইজির যদি এমন দশা হয় তবে সাধারণ মানুষ কী করবে!
আমরা আজকের আলোচনার শেষ পর্যায়ে চলে এসেছি। এবার শিরোনামে বর্ণিত শেষ প্রশ্ন নিয়ে সংক্ষেপে আলোচনা করে নিবন্ধের ইতি টানব। শিরোনামের শেষ প্রশ্ন ছিল কী খাব! বাংলাদেশের এই মুহূর্তের খাদ্যনিরাপত্তা, কৃষির বেহাল, কৃষি মন্ত্রণালয় ও খাদ্য মন্ত্রণালয়ের সমন্বয়হীনতা, ভারতের সঙ্গে সম্পর্কের বিপর্যয় ইত্যাদি কারণে খাদ্যসংকট অনিবার্য হয়ে পড়েছে। ২০২৫ সালের সম্ভাব্য খাদ্যসংকট এবং দুর্ভিক্ষের আগাম সতর্কতা আমরা ২০২২-২৩ সাল থেকে শুনে আসছি। যারা দেশ চালাচ্ছেন তারা কি একবারও ভেবেছেন যে আগামী দুটো মৌসুমে কৃষি ফলনে হেরফের হলে দেশের ১৮ কোটি মানুষ কী খাবে?
লেখক : সাবেক সংসদ সদস্য ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক