বয়স দুই বছর পার হলেও হাঁটা শিখছিল না মাইশা। হাঁটার জন্য দাঁড় করিয়ে দিলে বসে পড়ত। মাইশার বাবা সাদেকুল ইসলাম বলেন, ‘মেয়ের বয়সের তুলনায় ওজন কম ছিল, হাঁটতে পারত না, দুর্বলতা ছিল। চিকিৎসকের কাছে নিয়ে গেলে পরীক্ষানিরীক্ষা করে জানা যায় ভিটামিন ডি কম থাকায় এ ধরনের সমস্যা হচ্ছে। চিকিৎসক কিছু ওষুধ, ভিটামিন ডি-সমৃদ্ধ খাবার এবং একটা নির্দিষ্ট সময় মেয়ের গায়ে রোদ লাগানোর পরামর্শ দিয়েছিলেন। এখন মাইশা হাঁটতে পারে, দুর্বলতাও অনেকটা কেটে গেছে।’
শুধু মাইশা নয়, দেশে ভিটামিন ডি-স্বল্পতায় ভুগছে এমন শিশুর সংখ্যা আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে। অন্য বয়সি মানুষ বিশেষ করে নারী ও বয়স্করাও ভিটামিন ডি-স্বল্পতায় ভুগছেন। ভিটামিন ডি এক ধরনের অণুপুষ্টি কণা বা মাইক্রোনিউট্রিয়েন্ট। এ কণা মানুষের সামান্য পরিমাণে দরকার হয়, কিন্তু প্রতিদিনই তা দরকার। মানুষের চাহিদার ১০ থেকে ১৫ শতাংশ ভিটামিন ডি আসে খাদ্য থেকে। বাকি ৮৫ থেকে ৯০ শতাংশের উৎস সূর্যের আলো।
ভিটামিন ডির ঘাটতির কারণে শিশুদের রিকেট হয়। এতে হাড় নরম ও দুর্বল হয়, কঙ্কাল বিকৃত হয়। বয়স্করা ‘অস্টিওম্যালাসিয়া’ রোগে আক্রান্ত হন, এতে হাড়ে ব্যথা হয় ও মাংসপেশি দুর্বল হয়। দীর্ঘদিন ভিটামিন ডির অভাবে বয়স্ক নারী-পুরুষ ‘অস্টিওপোরোসিসে’ আক্রান্ত হন। এতে হাড় পাতলা হয়, হাড় ভঙ্গুর হয়ে পড়ে। এসব মানুষের উদ্বেগ ও বিষণ্নতা বেশি দেখা দেয়। এ দেশের ৬০ শতাংশের বেশি মানুষের ভিটামিন ডির ঘাটতি আছে। এটি একটি জাতীয় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে বলে জানান চিকিৎসকরা।
চট্টগ্রাম শহরে একটি ক্লিনিকে চিকিৎসা নিতে আসা ৫২৪ শিশুর শরীরে ভিটামিন ডির পরিমাণ নিয়ে একটি গবেষণা করেছেন চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের শিশুরোগ বিভাগের সাবেক প্রধান অধ্যাপক প্রণব কুমার চৌধুরী। শূন্য থেকে ১৮ বছর বয়সি এসব শিশু ২০১২ সালের জুলাই থেকে ২০১৭ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত ওই ক্লিনিকে চিকিৎসা নিয়েছে। গবেষণার সময় শিশুদের আর্থসামাজিক তথ্য, খাওয়ানোর অভ্যাস, জীবনযাত্রা, স্কুলের বিষয় ও পরিবেশগত বৈচিত্র্যের তথ্যের পাশাপাশি ওজন পরিমাপ করা হয়। এ ছাড়া প্রতিটি শিশুর রক্তের নমুনা সংগ্রহ করে রক্তে ভিটামিন ডির পরিমাণ পরিমাপ করা হয়।
রক্তের নমুনা পরীক্ষায় দেখা গেছে, ২৬৫টি শিশুর অর্থাৎ ৫০ দশমিক ৫৭ শতাংশ শিশুর ভিটামিন ডির ঘাটতি আছে। ভিটামিন ডির ঘাটতিতে থাকা ছেলে ও মেয়ের অনুপাত প্রায় সমানই ছিল। কিন্তু পার্থক্য দেখা গেছে গ্রাম ও শহরের শিশুদের ক্ষেত্রে। ভিটামিন ডি কম থাকা শিশু শহরে বেশি। গবেষণায় দেখা গেছে, শহরের ৭৯ দশমিক ৯ শতাংশ শিশুর এ ঘাটতি আছে। গ্রামে এ হার ৪৩ দশমিক ৬ শতাংশ। বয়স অনুপাতে যেসব শিশুর ওজন বেশি, তাদের ভিটামিন ডির ঘাটতিও বেশি।
অধ্যাপক প্রণব কুমার চৌধুরী বলেন, ‘নবজাতকদের মধ্যে ভিটামিন ডি-স্বল্পতা বাড়ছে। এজন্য অন্তঃসত্ত্বা অবস্থায় মাকে ভিটামিন ডি-সমৃদ্ধ খাবার এবং চিকিৎসকের পরামর্শে ওষুধ সেবন করতে হবে। পাঁচ বছরের বেশি বয়সি শিশুরা ভিটামিন ডি-স্বল্পতার ঝুঁকিতে আছে। এজন্য ডিম, দুধ, মাখন, ঘির মতো ভিটামিন ডি-সমৃদ্ধ খাবার খাওয়াতে হবে। সকাল ১০টা থেকে বেলা ৩টার মধ্যে এক দিন পরপর ১৫ থেকে ৩০ মিনিট শরীরে রোদ লাগাতে হবে। তবে ছয় মাসের কম বয়সি শিশুদের সরাসরি রোদে রাখা যাবে না। হয়তো বারান্দায় ২-৫ মিনিট রোদের তাপে থাকল। ভিটামিন ডির অভাবে মানুষের রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায়। সব বয়সি মানুষকেই এ বিষয়ে সচেতন হতে হবে।’
ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশনের লার্জ স্কেল ফুড ফর্টিফিকেশন কান্ট্রি অ্যাডভোকেসি বাংলাদেশের প্রোগ্রাম ম্যানেজার ডা. রীনা রাণী পাল বলেন, ‘ভিটামিন ডি চর্বিতে দ্রবণীয়। এক এক দেশে এক এক ধরনের খাবারে এ ভিটামিন যোগ করা হয়, যেমন দুধ ও দুগ্ধজাত খাবার, মার্জারিন, রুটি ইত্যাদি। কিন্তু বাংলাদেশে এসব খাবার সবাই খায় না। তবে দেশে ৮৭.৫ শতাংশ পরিবার ভোজ্য তেল ব্যবহার করে, যা বাণিজ্যিকভাবে অল্পসংখ্যক শোধনাগার দ্বারা উৎপাদিত হয়। তাই ভোজ্য তেলে ভিটামিন ডি-সমৃদ্ধ করলে এ ঘাটতি অনেকটা পূরণ করা সম্ভব।’