গ্রিসের ইলিয়া প্রদেশের নেয়া মানোলাদা যেন এক খণ্ড বাংলাদেশ। রাজধানী এথেন্স থেকে প্রায় সাড়ে তিন শ কিলোমিটার দূরে কয়েকটি গ্রাম নেয়া মানোলাদা, লাপ্পা ও ভার্দা। এসব গ্রামে বাস করেন প্রায় ১০ হাজারের মতো বাংলাদেশি। তারাই গ্রিসের কৃষি খাতে বাজিমাত করেন। কাজ করেন গ্রিসের ‘লাল সোনা’ খ্যাত স্ট্রবেরি খামারে। গ্রিসের অর্থনীতির বড় উৎস স্ট্রবেরি। দেশটির ইলিয়া প্রদেশের নেয়া মানোলাদা অঞ্চলকে বলা হয় ‘স্ট্রবেরি রাজধানী’। অনেকেই বলেন ‘লাল সোনার’ খনি। এই অঞ্চলে উৎপাদিত স্ট্রবেরি সারা ইউরোপে সমাদৃত, যা গ্রিসের অর্থনীতিতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখে।
গ্রিসের ৯০ শতাংশ স্ট্রবেরি উৎপাদন হয় এসব অঞ্চলে। প্রতিবছরই আগের বছরের রেকর্ড ভেঙে নতুন রেকর্ড গড়ে। করোনা মহামারিতে যখন সব খাতই ছিল বিপর্যস্ত, তখনো এই ‘লাল সোনা’ দেখিয়েছে বিপুল লাভের মুখ। এই সাফল্যের নায়ক বাংলাদেশিরা। এই এলাকায় যে স্ট্রবেরির চাষ হয়, তার বেশির ভাগই ইউরোপের বিভিন্ন দেশে রপ্তানি হচ্ছে। যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো জার্মানি, পোল্যান্ড, রোমানিয়া, এস্তোনিয়া ও স্পেন। নেয়া মানোলাদায় সরেজমিনে গেলে সেখানে কর্মরত বাংলাদেশিরা বাংলাদেশ প্রতিদিনকে জানান, মানোলাদা ও আশপাশের এলাকায় প্রায় ১০ হাজারের বেশি বাংলাদেশি কাজ করেন। তারা দিন-রাত পরিশ্রম করে দেশটির অর্থনীতিকে শক্তিশালী করলেও মানবেতর জীবনযাপন করছেন। তাদের অনেকেই থাকেন খোলা আকাশের নিচে- তাঁবু বা স্থানীয় ভাষায় যাকে বলা হয় ‘পারাঙ্গা’। এটি এক ধরনের অস্থায়ী ঘর। প্রবাসী মোহাম্মদ আলী বলেন, ‘আমি আট বছর ধরে স্ট্রবেরি খামারে কাজ করছি। বোনাস বা অতিরিক্ত সুবিধা পাই না। রাজধানীতে যারা হোটেল বা অন্যান্য খাতে কাজ করেন তারা ছুটি, বোনাস, স্বাস্থ্যসেবা পান। আমরা কৃষিশ্রমিকরা এসব সুবিধা থেকে বঞ্চিত।’
রফিকুল ইসলাম নামের আরেকজন বলেন, আমাদের স্থায়ী বাসস্থান নেই। পলিথিনের তাঁবুতে থাকতে হয়। গ্রীষ্মে অসহ্য গরম। শীতে প্রচণ্ড ঠান্ডা। কিছু মালিক শ্রমিকদের জন্য নিজস্ব ভবন তৈরি করেছেন। আমরা নির্দিষ্ট কোনো মালিকের কাজ না করায় ‘পারাঙ্গা’তে থাকি। কিছুদিন পর পর অগ্নিকাণ্ডের ঘটনাও ঘটে। সম্প্রতি অগ্নিকাণ্ডে ৭ শতাধিক বাংলাদেশি সবকিছু হারিয়েছেন। ২০১৮ ও ২০২১ সালে অগ্নিকাণ্ডে বাংলাদেশিরা ক্ষতিগ্রস্ত হন। কামরুল হাসান বলেন, আমি ছয় বছর ধরে কাজ করছি। অন্য খাতের শ্রমিকরা বিভিন্ন সুবিধা পান। আমরা এসব থেকে বঞ্চিত। বিশ্লেষকরা মনে করেন, স্ট্রবেরি শিল্পের সাফল্যের অবিচ্ছেদ্য কারণ হলো পাইনিওস নদীর ওপর বাঁধ, যা ওই অঞ্চলের মাটিকে উর্বর করেছে। আরেকটি কারণ হলো ‘সস্তা শ্রম’। প্রায় ২০ বছর আগেও মানোলাদায় কৃষিতে কাজ করতেন আলবেনিয়া, রোমানিয়া, বুলগেরিয়া এবং মিসরের নাগরিকরা। এর পর সেখানে বাংলাদেশিদেরও যাওয়া শুরু হয়। বাংলাদেশিরা কম বেতনে কাজ করেন। একপর্যায়ে গ্রিসে বসবাসকারী অনিয়মিত বাংলাদেশিদের বেশির ভাগ কৃষিকাজে যুক্ত হন। খামার মালিকরাও কম বেতনে পেয়ে বাংলাদেশিদের নিযুক্ত করতে শুরু করেন। এভাবেই আধিপত্য বিস্তার করেন বাংলাদেশিরা। তবে কাগজপত্র না থাকায় অনেকে সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত হতেন। বর্তমানে সেই চিত্র কিছুটা বদলেছে। এখন বেশির ভাগই বৈধতা পেয়েছেন। কর্মী সংকট থাকায় বেড়েছে তাদের কদর। আগের তুলনায় বেতনও কিছুটা বেড়েছে।
বিশ্লেষকরা মনে করছেন, বাংলাদেশ সরকার, গ্রিসের স্থানীয় প্রশাসন এবং আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলোর উচিত এই প্রবাসী কৃষি শ্রমিকদের জীবনমান উন্নয়নে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া।